অনন্যা হক
জামিলা গোসল সেরে ঘরে গিয়ে জানালার কাছে বসে। যতই দাদির সাথে মুখ চালিয়ে যা মনে আসে বলুক, কিন্তু মনে তার ছটফটানি থাকে, কেমন হবে ছেলেটা।তার নিজের পছন্দ হবে কিনা, এটাই সে বেশি ভাবতে থাকে।
জামিলা একটু বেপরোয়া, সাহসী মেয়ে, বুদ্ধির ঝিলিক তার চোখে মুখে। এটা তার চেহারায় একটা সৌন্দর্য যোগ করে। একেবারে গেরস্ত ঘরের মেয়ে। জমি জমা আর বাজারের দোকান পাট থেকে তাদের সংসার চলে। সে গ্রামের কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে।এর পরে ঘরে বসে আছে।আর পড়াতে পারবে না বাবা। একটা ভাই কে অনেক কষ্টে বাইরে পড়ায়।
তার বিয়ের খোঁজ চলছে।সে সংসারের সব কাজে পটু হয়েছে।চঞ্চল মেয়ে, ছুটে ছুটে চলে বেড়ায়।কালো হলেও চালচলন দেখে তাকে ভাল লেগে যায়। তার মনে একটা বিশ্বাস কাজ করে, ছেলে তাকে পছন্দ করে ফেলবে ঠিকই কিন্তু অভিভাবকদের নিয়ে ভয় আছে।
সে খাটের নীচে থেকে ট্র্যাংক টা টেনে বের করে, কোন শাড়ি টা পরবে ভেবে।এমন সময় মা আর দাদি ঘরে ঢোকে। দাদি বলে কি করিস একা, বেশি সময় নেই।
ওরা খবর দিয়েছে দিন থাকতে আসবে, মনে হয় তোকে দিনের আলোয় পরখ করে দেখবে।
দাদি থাম তো, শুনলে গা জ্বলে যায়। আমি ভেবে মরছি, সে ব্যাটা কেমন, আর তুমি শুধু একপেশে করে কথা কয়ে যাচ্ছো,যেন আমার মতের কোন বালাই নেই।
জামিলার মা মরিয়ম বলে, দেখছেন মা, এই মেয়েকে নিয়ে, আমার ভয়ের কোন শেষ নেই।কি যে করবে, ওরা না ফিরে যায়। মা জামিলা একটু স্হির হও, বুঝতে চেষ্টা কর, এরা বড় ঘর, ছেলে স্কুলের শিক্ষক, এমন ঘর বার বার আসে না।
দাদি বলে সর এখান থেকে, আমি ঠিক করে দেই কোন টা পরবি। একটা লাল কমলা রঙ মেশানো শাড়ি নিয়ে বের করলো।ধর এটা, এটাই পরবি, এটা চাপা গায়ের রঙের মেয়েদের পরলে উজ্জ্বল দেখায়।
জামিলা হাত পেতে শাড়ি টা নেয়। বলে, তোমরা এবার যাও, আমি আমার মত সাজবো।
মা বের হয়ে আসে, চার পাঁচ জন লোক আসার কথা, খাওয়া দাওয়া করবে, কাজ আছে আরও বাকী তার।
দাদি আর নাতি তাদের নৈমিত্তিক রঙ্গ তামাশার ভেতরে সাজগোজ সারতে থাকে ।জামিলা বলে, দাদি আমি তাদের যখন খাবার দেব, তখনই তো তারা আমারে দেখবে।বাকি টা তুমি সামলাবে।
তাহলে তুই চুল গুলো খুলে রাখ, যেন খুলে দেখাতে না হয়, তোর যেমন মত। এত সুন্দর পিঠ ভাসা চুল কয়টা মেয়ের হয়! এত জেদ করিস না, তোর যেমন ছেলে দেখার সাধ, ওদেরও তেমন, সারাজীবন বলে কথা!
হবে না অস্বীকার করি নাকি? তাই বলে তোমাদের মত নড়িয়ে চড়িয়ে, টোকা দিয়ে হবে না ।
আর একদিন দেখে কি মানুষ চেনা যায় দাদি? সারা জীবন এক ঘরে থাকা, চাট্টিখানি কথা না।
দাদি হেসে বলে, এত কথা তোর মনে, আর পারি না আমি ।
এমন সময় জানালা দিয়ে দেখলো, একটা অটো এসে থামলো। দুই জন মহিলা, তিন জন পুরুষ মিলে মোট পাঁচ জন নামলো। দাদি শব্দ পেয়ে তড়িঘড়ি বের হয়ে গেল।
জামিলা দূর থেকে যতদূর দেখা যায় দেখলো।বয়স দেখে বোঝা যায়, কোন টা ছেলে।
মনে একটা রংয়ের ছটা লাগে, হাজার হোক কাঁচা বয়স।দাঁড়িয়ে আছে, বাড়ির লোক না বের হওয়া পর্যন্ত ।
এর মধ্যেই জামিলা দেখলো কম বয়সী ছেলেটা সত্যি কালো।কিন্তু কেমন যেন একটা ভাব আছে চেহারায়, এ তো একবারে তুচ্ছ করার মত না ।
মনটা একটু নরম হয়, এবার ভাবনা ঢোকে, তাকে পছন্দ হবে তো! সে দাদির কথা মত চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে, কপালে একটা লাল টিপ দেয়। অল্প বয়স, ঢলঢলে, নিস্পাপ একটা মুখ।সাথে একটা দুরন্ত, চঞ্চল মন।কোথা থেকে যেন এখনই একটু রঙ এসে লাগলো, চোখে মুখে । রুপ টা একটা আচানক হাওয়ায় খুলে গেল যেন। আয়নায় নিজেকেই নিজের ভাল লাগলো। ছেলে কালো, সে কালো সব মন থেকে দূর হয়ে গেল।
আবার দাদি আসে,বলে, চল আমার সাথে। এর মধ্যে জামিলা বুদ্ধি করে, নিজের মোবাইল নম্বর টা কাগজে লিখে, হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছে।
দাদির সাথে নাস্তার ট্রে টা নিয়ে বাইরের ঘরে পা রাখে। ট্রে টা টেবিলে রেখে বসে দাদির পাশে।
সবাই বসে আছে।ছেলে তাকে বেশ কৌতুহল নিয়ে দেখছে।জামিলাও একটু করে দেখে নেয়, চোরা চাহনি তে।
দাদিই কথা বলতে থাকে, এটা সেটা,অন্য দেরকে সুযোগ কম দিয়ে। এর মধ্যেই বলে, যাও জামিলা সবাইকে নাস্তা টা দাও আগে।জামিলা উঠে যায়।
ছেলে, ছেলের দুলাভাই, এক চাচা আর মা, বোন এসেছে দেখতে। মা আর বোনের একটু থমথমে চেহারা, দেখে খুশি বোঝা যায় না।
দাদি ভয়ে আছে, কি হবে বুঝতে পারছে না।নাস্তা খাওয়া শেষ হতেই দাদি বুদ্ধি করে বলে, ছেলে মেয়ে একটু কথা বলুক, চলেন আমাদের বাড়ি ঘর দেখবেন আপনারা।
জামিলা দাদিকে মনে মনে হাজার বার ধন্যবাদ দেয়।সবাই দাদির সাথে উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু ছেলের বোন বলে,
মিজানও আস, ঘর বাড়ি দেখ, কথা পরে বোল।
সবাই আগে বের হয়ে যায়, ছেলের একটু কৌতূহল ছিল তাই পিছে থাকে সবার।সেই ফাঁকে জামিলা মোবাইল নম্বরের কাগজ টা এগিয়ে দিয়ে বলে, এটা রাখেন, পরে কথা বলবেন। শুধু দেখলে কি হয়, মুখের কথা হলো আসল।কথা বলে তারপরে মত দিব দুজনে ।
মিজান তো একটা ঝাকি খেল যেন। একটু ভড়কে গেলেও হেসে দেয়।মনে মনে ভাবে, এ কি রে বাবা !
মিজান মেধাবী, বুদ্ধিমান ছেলে, বোঝে এ যুগের মেয়ে। এমন চপলা, বুদ্ধিমতী মেয়েই তার পছন্দ বরাবর। প্যান্টের পকেটে কাগজটা রেখে, খুশি মনে সবার সাথে বাড়ি দেখতে বের হয়ে যায়।
যাবার সময় বলে যায়, কথা হবে পরে।
জামিলাও বের হয়ে, হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে তার ঘরে ঢুকে যায়।
এই বুদ্ধিটা সে করেই রেখেছিল, হয় সে না হয় দাদি কে দিয়ে, যদি একটু ভাল লাগে, মোবাইল নম্বরটা দিতেই হবে।
চলবে…
গল্পটির প্রথম অংশ