অনন্যা হক
সহমরণ বন্ধ হয়েছিল, বিধবা বিবাহ চালু হয়েছিল একসময়।নারীদের কে তখন জন্তু, জানোয়ারের মত এবং শুধু মাত্র ভোগ্য পণ্য হিসেবে গণ্য করা হতো। একই মানুষ, শুধু শারীরিক গঠনে ভিন্ন বইতো আর কিছু না।
মানুষের মধ্যে কতটা পশু প্রবৃত্তি থাকলে, এসব বর্বরতা করা সম্ভব!
অন্দরমহলে নারীদের অব্যাহত লড়াই তো ছিলই, আর কিছু গভীর অনুভূতি সম্পন্ন, সাহসী, আলোকিত পুরুষ এগিয়ে আসার কারণে, এসব বর্বরতা থেকে বেরিয়ে আসার পথ তৈরি হয়। হয়তো কিছু অন্ধকারে আলো ঢুকেছে, তাই বলে কি সব অন্ধকার ঘুচে গিয়েছে ?কখনও না । এরই আলোকে এই লেখাটা।সেটা হলো, শারীরিক নির্যাতন।
এখনও ঘরে ঘরে অন্দরমহলে, নিম্নবিত্তে তো অহরহ, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত সব মহলে নারীদের উপর, বহু শারীরিক নির্যাতনের নজির আছে। যে গুলো নারীরা একেবারে নিরুপায় না হলে ,পারতপক্ষে গোচরে আনে না কিন্তু অগোচরে বেশি দিন ঢেকেও থাকে না। কিন্তু এসবের পাশে দাঁড়ানোর কাউকে পাওয়া যায় না, খুব কাছের পরিজন কেও না। যেন এসব একটা মামুলি ব্যাপার, একেবারে নারীদের যার যার ব্যক্তিগত কষ্ট!
এই শারীরিক নির্যাতন টা একেবারেই একপাক্ষিক ভাবে চালু রয়ে গেছে। এই ব্যাপার টা, একটা চরম অপমান এবং অসন্মানের। এর সাথে শারীরিক কষ্ট তো আছেই, তার থেকে বেশী আছে মানসিক কষ্ট।
সংসার শুরু করে, দুজন মানুষ দুজনের সমান প্রয়োজনে।এখানে দুজনেরই স্বার্থ জড়িত আছে।কেউ কারো দাসী না, গলগ্রহ না, অধীন না।সংসার করতে গেলে মতবিরোধ হবে, পছন্দ অপছন্দের বিষয় আসবেই। মানুষের রাগ প্রকাশ করার অনেক রকম পদ্ধতি থাকে।কিন্তু কারো গায়ে হাত দেয়ার অধিকার কিন্তু কেউ কাউকে দেয় না। পুরুষেরা যেন একাই এই অধিকার অর্জন করে বসে আছে।
এমন অনেক কাজ আছে, যা পুরুষেরা করে যায়, যে গুলো কিনা স্ত্রীর অনেক মনোকষ্টের কারণ হয়ে থাকে, তখন কি কোন স্ত্রী ভুলেও তার স্বামী কে শারীরিক অত্যাচার করার কথা ভাবে? হয় তারা সহ্য করে, না হয় বড় জোর ঝগড়া করে, অথবা আপোষ করে ঠিক করতে চেষ্টা করে যায়।
তাহলে পুরুষের মধ্যে এই প্রবণতা কেন? এটা কি বউ কে অধীন, কেনা গোলাম, নাকি ব্যাক্তিগত সম্পদ মনে করার কারণে?
আসলে তো এই পৃথিবীতে কেউ কারো অধীনেও না, কেনা দাসীও না । আর সংসার টা কোন শক্তি প্রদর্শনের ময়দান নয়। এই আচরণ হলো একটা মানসিকতার প্রতিফলন।সম্পূর্ণ ভুল এবং বিকারগ্রস্ত মানসিকতা।
মানুষের মতবিরোধ সব সম্পর্কের ক্ষেত্রেই হতে পারে, হয়। তাহলে স্ত্রীর ক্ষেত্রে এসে এই নির্যাতন কেন? এটা কি পৌরুষত্ব দেখানোর অপচেষ্টা? এগুলো হলো এক ধরনের চারিত্রিক দুর্বলতা।জোর করে বশে আনার চেষ্টা অথবা পশু প্রবৃত্তির প্রকাশ। যে সব স্ত্রীরা এমন নির্যাতনের শিকার হয়, এর পরেও তাদের ঐ স্বামী বেচারার প্রতি, কতটুকু শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালবাসা অবশিষ্ট থাকার কথা? দেখা যায়, এসবের পরেও তারা ঘরে শান্তি, সুখ সবই আশা করে।
কি অসীম শক্তির আধার এই নারীরা, যে দেখা যায়, সব থাকা সত্বেও, শুধু সংসার, মায়া, সম্পর্কের মোহে, এসব নীরবে সহ্য করে যায়।নিম্নবিত্ত দের ঘরে এটা তো দৈনন্দিন চিত্র ।
যতগুলো বুয়া রেখেছি, খোঁজ নিয়ে দেখেছি তাদের জীবনের।তারা নিজেরাই আয় করে, বর অনেক সময় কাজে যায় ইচ্ছে হলে, অথবা যায় না, যা ইচ্ছে তাই করে ,জুয়া খেলে, নেশা করে ঘরে এসে, অহেতুক বিবাদ করে বউ পেটায়। সেই বউ গুলো কেই পরদিন কাজ ঠেকাতে বাসা বাড়িতে কাজে আসতে হয় গায়ে গতরে ব্যাথা নিয়ে।
আবার তাকেই ভালবাসে,যত্ন করে, মঙ্গল কামনা করে তার। এমন নারী দের কাছে,, সমাজ, পৃথিবী, তথাপি এই পুরুষ দের ঋণের কোন শেষ নেই।
এখন এই যুগে অনেক নারী অবশ্য সুতো ছিঁড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সংসার ভাঙ্গার দায় শুধু মাত্র নিজের কাঁধে নিয়ে। তাদের প্রতি থাকবে আমাদের সবার ভালবাসা এবং আশীর্বাদ, আবার নতুন জীবনে ঘুরে দাঁড়াবার জন্য।
অত্যাচার করে শুধু মাত্র পশুত্বের নিবৃত্তি হয়, কিন্তু কোন মানুষ কে জয় করা যায় না।সে এক সময় শেকল ছিঁড়বেই, অন্তত মনের শেকল। তখন এই সংসার একটা নরকে পরিণত হয় ।
সব মানুষ তো এক সময় স্বর্গে যেতে চায়, তাহলে পৃথিবীর জীবন এমন নরকে পরিণত করা কেন? প্রশ্ন জাগে মনে।
এসব নরকে অনেক সময় মৃত্যুও সংঘটিত হতে পারে, হয়ও। কারণ মানুষ তখন পশু হয়ে যায়। এসব ব্যবহার এর ব্যাখ্যা কে দিতে পারবে? অথচ আমি দেখি, সংসারের যে কোন জড় বস্তুর প্রতিও মানুষের কত মায়া,তার গায়ে একটা আঁচড় কাটতেও সবার কত দ্বিধা। কোন জীবন্ত মানুষের মূল্য,মায়া নিশ্চয় জড়ের থেকে বেশী?
ঠিক অত্যাচারিত ব্যাক্তির জায়গায় অবশ্যই যে কেউ নিজেকে ফেলে, বারবার ভেবে দেখা উচিত।
একটা পরিচ্ছন্ন, সুন্দর, নির্মল জীবন সবার কাম্য । মনে রাখা উচিত, এই পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষ এক একটা আলাদা সত্বা।তাই অধীন ভেবে বশে আনা বা জয় করতে চাওয়া অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ। এই পৈশাচিক মনোবৃত্তির কি অবসান নেই? এর একটা জবাবদিহিতা অবশ্যই জরুরী।
কত রকমের পাশবিক নির্যাতনের শিকার এক নারী কে হতে হয় এই ধরনীর বুকে এসে, তার কোন হিসাব নেই ।