হারিয়ে যাইনি, এটাই জরুরী খবর - Women Words

হারিয়ে যাইনি, এটাই জরুরী খবর

শবনম সুরিতা ডানা
বেশ কিছুক্ষণ যাবত একটা প্রবন্ধ চোখের সামনে মেলে বসে আছি। বারবার চোখ বোলাচ্ছি, কিন্ত কিছুই মাথায় ঢুকছে না। ক্রমাগত একটাই প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরঘুর করছে সকাল থেকে। আমাদের ভেতর এত ঘৃণা কেন? কিছু মানুষ আছেন যাঁদের এক বেলারও ভাত হজম হয়না অন্যের নিন্দা, বা সামনে থাকা কাউকে তিরস্কার না করে। কূটকাচালির আলাপ থেকে সপ্তমে গলা চড়িয়ে গালি দেওয়া যেন তাদের আবশ্যিক, প্রাত্যহিক পুদিনহরা! রোজ ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে ঘুমানোর আগমূহুর্ত পর্যন্ত তারা একাধিক মানুষের প্রতি তাদের ক্ষোভ, অতৃপ্তি জাহির করেন কারনে-অকারণে। কখনো আলোচ্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে চলে ঠেস দিয়ে কথার লড়াই, আবার তার অনুপস্থিতিতে চলে বেদম চরিত্রহনন। এমন ব্যবহারের কোন কারণ থাকাও যে জরুরী সব সময়, এমনটা নয়। কী এক অজানা বিদ্বেষ, ক্ষোভ বা নিপাট ইগো’র বশে এমন করে থাকেন তারা বলে আমার ধারনা। অথচ, আমার ধারণায় কীই বা আসে যায়।

আমি ভাবি অন্য কথা বরং।

আমার কাজের জন্য জাতিসত্ত্বা বিষয়ক পড়াশোনা করতে হয় মাঝেমাঝেই। সেভাবেই একটা অদ্ভুত লেখা পড়লাম গতকাল। জাতি হিসেবে নিজেদের সত্ত্বা নির্ধারণ নাকি বেশ অনেকখানিই নির্ভর করে আশেপাশের অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীদের মতামতের ওপর। মানে ধরুন, আমি জানি আমি একজন ভীতু বাঙালি যে বাজ পড়লে, সাপ দেখলে, ভূতের ছবি দেখলে ভয় পায়। অথচ, মনের কোন এক কোণায় আমি নিজেকে বোঝাতে থাকি প্রতিদিন, যে একদিন এই সব ভীতি থেকে বের হয়ে আসতে পারব নিশ্চয়ই। কিন্ত আশেপাশে থাকা অন্য গোষ্ঠীর বা মানুষদের ক্রমাগত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, তাচ্ছিল্য দ্বারা জর্জরিত হয়ে আমার মনে ধীরে ধীরে অন্য একটা ধারনা জন্ম নেয়। আমি বিশ্বাস করতে শিখি, যে আসলেই আমি হয়ত চিরভীতু, আমার দ্বারা ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। আদতে সারা জীবন ভীতু হয়ে পড়ে থাকার সম্ভাবনা না থাকলেও আমি ভীতুই রয়ে যাই।

আসলে মানুষের কথা বিশ্বাস করে ফেলি আমরা সবাই বড্ড তাড়াতাড়ি, সে প্রশংসা হোক বা নিন্দা। আর বক্তা যদি হয় আমাদের পরিচিত বা কাছের কোন মানুষ, তাহলে আরোই সমস্যা কম। উদাহরণস্বরূপ, আমার এক আত্মীয় ব্যক্তির কথাই ধরি নাহয়। দিনের বেশিরভাগ সময় তিনি কাটান তাঁর ফোনের সাথে। এবং সেই ফোনের সাহায্যে তাঁর সারাদিন কাটে বিভিন্ন মানুষ বিষয়ক কূটকাচালি গল্পে, খবর চালাচালি করে। আমার আরেক পরিচিত ব্যক্তি আছেন যার দৈনন্দিনতার একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট মানুষের প্রশংসা এবং নিন্দা। এবং এই কাজে তাঁর কোন ফোন বা ইন্টারনেটের প্রয়োজন যে রয়েছে তা নয়। সামনে বসা মানুষদের (যার প্রতি আলোচ্য ব্যক্তিবর্গের দূর-দূরান্তে কোন সম্পর্ক বা আগ্রহ নেই) সাথে তিনি অতিরঞ্জিত সমস্ত বাক্যালাপে মেতে ওঠেন। অবশ্য এসব কিছুই ভিন্ন ভিন্ন মানুষের ব্যক্তিগত অভ্যাসসমূহ। আমি কেন এসব নিয়ে লিখে সময় নষ্ট করছি?

আমি লিখছি, কারণ আমি এই প্রবণতার ভুক্তভোগী। একটা সময় ছিল, যখন বিভিন্ন সমাগমে ক্রমাগতভাবে বলা হত যে আমি বখে যাওয়া একটি মেয়ে। একটা সময়ের পর আমিও সেটা বিশ্বাস করতে লাগলাম। এবং সেই ধারনা থেকে বেরিয়ে আসতে আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল মানসিকভাবে। এরপর একটা সময় আসল যখন আমার পারিবারিকমহলে আমার প্রেমিক বিষয়ক নানান গুজব, রটনা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সময়ানুপাতে দশ ঘন্টা পিছিয়ে থাকা দেশ থেকেও আচমকা চিন্তিত (!) আত্মীয়ের ফোন এসে গেল আমি-বিষয়ক গসিপ কুড়োতে। আমি ওসবে কান দিইনি বলাই বাহুল্য। ফলস্বরূপ বাজারে আমদানি হলো নতুন গল্প, যার নিয়মিত পরিবেশনে নিত্যনতুন ঢঙে কালিমাচর্চিত হতে থাকে আমার শিক্ষা, আদর্শ ও ব্যক্তিত্ব।

মানুষ যখন নিজেকে সবজান্তা বিজয়ী ভেবে ফেলে তখনই কিন্ত সমস্ত সমস্যার আগমন। আপনি ভাবলেন আত্মরক্ষাহীন কাউকে তিরস্কার করে, তাকে ছোট করে আপনি বিশাল দাঁও মেরে বসলেন। কিন্ত আসলে হিসেব করে দেখুন, আপনার অনুপস্থিতিতেও আপনাকে উজ্জ্বল করে রাখে এমন বার্তা কিন্ত মোটেই সুনিশ্চিত নয়। আসলে আপনিও জানেন যে রাতে আপনার চরম অনিদ্রা। সারাদিনের রাজা-উজির মেরে আপনার একটি রাতের শান্তির ঘুম নিশ্চিত করে রাখবে এমন ভালোবাসার প্রহরী আপনার জীবনে কেউ নেই বললেই চলে। আর যারা আপনাকে সত্যিই ভালোবাসে আপনার সমস্ত তিক্ততার উর্ধ্বে উঠে, তাদের সাথে কাটানোর পরিবর্তে আপনি সময় নষ্ট করেন খেলো পরচর্চায়।

আমি আশৈশব ভালোবাসতে শিখেছি। চরম খারাপ দিনেও বিশ্বাস করেছি নির্ভেজাল আলিঙ্গনে। আমার ছেলেবেলা থেকে প্রাপ্তবয়স্কতা- গোটা সময় জুড়েই ছিল অসংখ্য ওঠাপড়া, প্রেম-অপ্রেম, হতাশা-তামাশা, অন্য পাঁচজনের মতই। কিন্ত আমার পারিপার্শ্বিক নেতিবাচকতাকে শুষে নিইনি নিজের ভেতর, জিততে দিইনি তাকে একবিন্দুও।

আপনি হেরে গেছেন। আপনি দেখতে পাচ্ছেন না, আপনার ছড়ানো বিষবায়ুতে সবচেয়ে বেশি নিঃশ্বাস নিচ্ছেন আপনি একা। আর যারা আপনার বিষমণ্ডলে যুক্ত হতে চাইছে না বলে আপনার এত বিরক্তি, তারাও কিন্ত আপনার দ্রুত আরোগ্য চায়।

আপনি, আপনারা সেরে উঠুন। খুব বেশি অন্ধকার লাগলে টর্চ জ্বালুন, মোমবাতি ধরান একটা নিদেনপক্ষে। পৃথিবীটা সত্যিই বড্ড বেশি সুন্দর।