‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?’ - Women Words

‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?’

চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময়ে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নেতৃত্ব দিয়ে পুলিশ বাহিনীতে নিজে আলাদা করে তুলেছেন বাবুল আক্তার। সদ্য পেয়েছেন পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি। সৎ, নির্ভিক ও পরোপকারী এই পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতুকে মাথায় গুলি করে হত্যা করেছে দুবৃত্তরা। আজ সকাল পৌনে ৭টার দিকে এই ঘটনা ঘটে। সকালে ঘুম থেকে উঠে এ খবর জেনে পুরো দেশবাসী স্তম্ভিত। সকাল থেকেই ফেসবুকে এই ঘটনার প্রতিবাদে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে যাচ্ছেন সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে সেলিব্রেটিরা। সংবাদের মানুষ যারা তারাও কাজের বাইরে ফেসবুকে আলাদাভাবে জানিয়েছেন নিজেদের প্রতিক্রিয়া। সেসব থেকে কয়েকটি স্ট্যাটাস তুলে ধরা হলো-

আমাদের সময়ের সাবেক সম্পাদক কবি আবু হাসান শাহরিয়ার তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?’ শিরোনামে লিখেছেন, বিশেষ-বিশেষ দিনে বিশেষ কিছু অঞ্চল নিরাপত্তা-চাদরে মুড়িয়ে রাখার দাবি করলেও জননিরাপত্তার প্রশ্নে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে মুড়ানোর মতো রুমালটিও যে নেই, পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তারকে বাড়ির সামনে গুলি করে হত্যা করে অপরাধীরা সে-কথাই জানিয়ে দিল।
সাগর-রুনি থেকে ত্বকী, ত্বকী থেকে তনু, তনু থেকে মাহমুদা- সব হত্যাই সমান বেদনাদায়ক। সুশাসন মানে এই যে, রাষ্ট্রের সব নাগরিকই সমান গুরুত্বপূর্ণ। সবার নিরাপত্তার জন্য সুষম চাদর না-বিছালে কৃপণ রুমালে দেবলায়কেও সুরক্ষা দেওয়া যায় না।’
একুশে টেলিভিশনের কারেন্ট এ্যাফেয়ার এর ডেপুটি হেড অঞ্জন রায় লিখেছেন, ‘জঙ্গী দমনে সফলতার কথা বলে যারা স্বস্তিতে ছিলেন, যারা জঙ্গীদের ব্যাবহার করছিলেন, যারা এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা টার্গেট কিলিং বলছিলেন- তাদের কেউ কি মাহমুদা আক্তার মিতুর জীবনকে নিরাপদ করতে পেরেছেন? পারেন নাই। চট্টগ্রামে জঙ্গিবিরোধী বিভিন্ন অভিযানের নেতৃত্ব দেওয়া পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতুকে চট্টগ্রামে তাদের বাসার কাছে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এই নিয়ে কোন বিবৃতি বা পাল্টা বিবৃতি দেখতে চাই না। দেখতে চাই অপরাধীদের গ্রেফতার- দ্রুত বিচার।’

নাগরিক টেলিভিশনের হেড অব এনসিএ সাইফুল হাসান রিকু লিখেছেন, ‘পাশাপাশি জেলার মানুষ, এসপি বাবুল আক্তার। যদিও কর্মসুত্রেই আলাপ। সাহসী পুলিশ অফিসার। প্রায় এক দশক ধরে তাকে চিনি। বিনয়ী, স্পষ্টভাষী, সাংবাদিকবান্ধব, বহু সাংবাদিকের পরিচিত-ঘনিষ্ঠজন বাবুল ভাই। প্রতি ঈদ বা উৎসবে উনার ফোন থেকে শুভেচ্ছাসহ মেসেজ আসে। বাবুল ভাই কাজে বিশ্বাসী দক্ষ, সৎ ও পেশাদার কর্মকর্তা। ভালো কাজের পুরস্কারও তিনি সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন। এই বাবুল ভাইয়ের স্ত্রীকে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে, গুলি করে হত্যা করেছে চট্টগ্রামে- বিশ্বাসই হচ্ছে না। আল্লাহ বাবুল ভাই ও তার বাচ্চাদের এই শোক কাটিয়ে ওঠার শক্তি দান করো। ভাবীকে বেহেস্ত নসিব করো। দেশটাকে সন্ত্রাসের অভয়ারন্য বানিয়ে ফেলেছে সন্ত্রাসীরা। আশা করি অপরাধীরা ধরা পড়বে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সম্ভবত সারাদেশে সন্ত্রাস বিরোধী একটি অভিযান চালানো।’

ইন্ডিপেনডেন্ট এর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক তারেক মোরতাজা লিখেছেন, ‘বাবুল ভাই ও তার সন্তানদের কাছে এ সমাজের জবাব কি? সকালে আচমকা খবরটা কানে আছে। টিভি ছাড়ি। পর্দায় বাবুল আকতারের স্ত্রীর রক্তাক্ত ছবি। প্রচন্ড রকমের ধাক্কা খেলাম, একজন পেশাদার, নীতির প্রশ্নের আপসহীন পুলিশ অফিসারের স্ত্রীর এ হত্যাকান্ড নিশ্চিতভাবেই পরিকল্পিত। এর রহস্য ভেদ করতে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ নিবে এটাই আশা করি। বাবুল আকতারের সাথে ২০১২ সালের অক্টোবরে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছিল। দেখাও হয়েছিল। সে সময় তিনি কক্সবাজারে ছিলেন। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১২ রামু কান্ডের পর সেখানে গিয়েছিলাম রিপোর্ট করার জন্য। সম্ভব সব রকমের সহায়তা পেয়েছি। কোনো হুটহাট মন্তব্য না করেই কথা বলেছেন। রামুকান্ডের এক আসামী গ্রেপ্তার হওয়ার পর ফের কথা হয়েছিল ২০১৩ সালে। সে সময় তিনি সদ্য চট্টগ্রাম এসেছিলেন। সাধারণত পুলিশের প্রতি এক ধরণের রাগ ক্ষোভ আছে, আমাদের। কিন্তু বাবুলরা সেখানে অনন্য। তাদের সহায়তার হাত এতটাই প্রসারিত যে অস্বস্তিতে থাকা মানুষের কাছে তারা স্বস্তি নিয়ে আসেন। তার পরিবারের ওপর যে আক্রমণ, তার সন্তানদের মাকে খুনের যে নৃশংস বর্বরতা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, এটা ক্ষয়িষ্ণু সমাজেরই একটি ঘৃণ্যতম চিত্র। বাবুল ভাইয়ের সাত বছর বয়সি ছেলে আর চার বয়সী কন্যার কাছে এ সমাজের কি কোনো উত্তর আছে? নেই। নিশ্চিতভাবেই নেই! বিচারের অপেক্ষায় থাকলাম। বাবুল আকতার ও তাঁর সন্তানদের এ কঠিন সময়ে আল্লাহ সহায় হোন।’

প্রথম আলো’র সিনিয়র ফটোজার্নালিস্ট শাহাদাত পারভেজ লিখেছেন, ‘আর মানা যায় না’।

বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোরের কূটনৈতিক প্রতিনিধি জেসমিন পাঁপড়ি লিখেছেন, ‘সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের ত্রাস হিসেবে পরিচিত সেই বাবুল আক্তারকে প্রথম দেখা চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত বাংলানিউজের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে। নাতিদীর্ঘ এক বক্তৃতা রেখেছিলেন তিনি, কী বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, কী তীব্র মানসিক জোর। এর আগে শোনা গল্প আর সেদিনের দেখা সব মিলিয়ে এসপি বাবুল আক্তার একজন পুলিশ কর্মকর্তার বাইরে স্বপ্নের নায়কে পরিণত হয়েছিলেন আমার কাছে। মনে হয়েছিল অসসতায় ভরা বাংলাদেশে ভরসার নাম তিনি।
থাইল্যান্ডের ফুকেট শহরে ঘুম ভেঙেই যে খবরটি দেখলাম, তাতে আমিও মুষড়ে গিয়েছি। বিছানা থেকে নামতে পারছি না।
তবে কি বাবুল আক্তারের সততা আর সাহসের এই পরিণাম দিলো রাষ্ট্র? তবে কি এই দেশে ন্যায়ের পথে চলা মানুষদের স্ত্রী সন্তানরাও নিরাপদ নয়? ওরা কি সাবধান করে গেলো, আর কোন বাবুল আক্তার যেন না জন্মায় বাংলাদেশে?’

ছড়াশিল্পী ও কালের কণ্ঠের মৌলভীবাজার প্রতিনিধি আব্দুল হামিদ মাহবুব প্রতিবাদ জানিয়েছেন একটু ভিন্নভাবে। ‘ বেড রুমে মারে নাই’ শিরোনামে তিনি লিখেছেন,

বেড রুমে পাহারা
চায়নি তো কেউ
রাস্তায় গুলি করে
জঙ্গি না ফেউ?
তোমাকে ছোঁবে না
তুমি দোষ করোনি
রাস্তায় লাশ কেনো;
এসপি’র ঘরণী?
বেড রুমে মারে নাই!
মেরেছে রাস্তায়
তবু আছি নিরাপদ
রাখবো কি আস্থায়?

চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের সিলেট প্রতিনিধি গুলজার আহমদের স্ট্যাটাসে পুলিশ বাহিনীর প্রতি আকুতি, ‘পুলিশ ভাইয়েরা আপনাদের কসম লাগে … বাবুল আক্তারের মতো একজন সৎ সাহসী পুলিশ অফিসারের মনোবল ভাঙবেন না প্লিজ । অন্তত তাঁর স্ত্রীর হত্যাকারীদের চিহিৃত করুন । আমার বিশ্বাস আপনারা পারবেন । ’
আমরা সব সময় সময় এ ব্যাপারে সহযোগীতার জন্য আপনাদের পাশে আছি ।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস-কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজমের শিক্ষার্থী রাশেদ নিজামের ফেসবুক আইডি নেম শিক্ষানবীস রাশেদ নিজাম । তার স্ট্যাটাসে পাওয়া যায় চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের মানবিক চরিত্রটি,

বাবুল আক্তার র‌্যাব থেকে ২০০৮ সালে যখন সিএমপির কোতোয়ালী জোনের এসি হিসেবে যোগ দেন তখনই চট্টগ্রামবাসীকে নিজ কর্মগুণে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন নিজের জাত। ঐবছরই কোতোয়ালী থানার টাইগারপাস এলাকায় এক ছিনতাইকারীকে জীবনের ঝুকি নিয়ে অস্ত্রসহ ঝাপটে ধরে আলোচনায়য় বাবুল ভাই।
১১ বছরের পুলিশ জীবনে, নিজের জন্য বোধহয় একটা স্বপ্নও দেখেননি। তার অসাধারণ সাহসী অপারেশনের বহু গল্প পুলিশে, সাংবাদিক সমাজে আলোচনা হয়। গ্রেনেড হামলা শিকার হয়েছেন, জঙ্গী ধরার সময়।
শুধুমাত্র অপরাধ দমনেই সীমাবদ্ধ ছিলেন এমন কিন্তু না। মানুষের বিপদে পাশে দাড়িয়েছেন, অনায়াসে। যা আমাদের বহু বড় বড় কর্মকর্তার জন্য শিক্ষণীয়।
হাটহাজারীতে ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়াকালীন এক গরীব স্কুল ছাত্রীর লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছিলো তার বাবা মা। অথচ সে ঐ স্কুলের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রী। কী করা যায়? স্কুল শিক্ষক সার্কেল এএসপি বাবুল আক্তারকে বিষয়টি জানান। তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, মেয়েটি এতটাই গরীব যে স্কুল ড্রেস সেলাই করার সামর্থ্য নেই, পাঠ্যপুস্তকসহ আনুষাঙ্গিক খরচ তো দূরের কথা। বাবুল আক্তার এলাকার দুজন বিত্তশালী ব্যবসায়িকে অনুরোধ করেন, ফল, শুধু স্কুল ড্রেস নয়, এসএসসি পর্যন্ত তার লেখাপড়ার খরচ চালাতেও সানন্দে রাজী হন দুজন ব্যবসায়ী।

হাটহাজারীতেই এক চোরের ঘটনা। ধরা পড়ার পর সে বাবুল ভাইকে খুলে বলে সব কথা। তিনি জেল থেকে মুক্ত হয়ে তার সাথে দেখা করতে বললেন। একদিন সে ঠিক হাজির হলো। বাবুল আক্তার নিজের পকেট থেকে কিছু টাকা দিয়ে আখ মাড়াইয়ের মেশিন কিনে দেন একটা। যুবক তো থ। বুঝতে পারছে না, এটা আদৌ সম্ভব কিনা! প্রথম দিন সে দেড় হাজার টাকার মতো বিক্রি করেছে। তা থেকে একটাকাও খরচ না করে নিয়ে এলো বাবুল আক্তারের কাছে। বললো, “স্যার আমার উপার্জনের প্রথম টাকা আপনার নিতেই হবে। বাবুল আক্তার ফিরিয়ে দিলেন তাকে। ক’দিন পর আবার এলা সে। বলো “স্যার দাঁড়ানো অবস্থায় পা দেখা যায় এমন কোন ছবি পাইনি আপনার। আমি ক্যামেরাম্যান আনছি। একটা ছবি তুলতে দিয়েন। অতঃপর ছবি তোলা হলো। তার পরের কাহিনী, যুবকটি বাবুল আক্তারের ছবিটা বাঁধিয়ে তার ঘরের দরজায় টাঙিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে।
এমন ঘটনার অভাব নেই, কিন্তু দেশকে সব উজাড় করে দেয়ার পুরস্কার। সেই দেশেরই কয়েকজন নির্মমভাবে খুন করলো, বাবুল ভাইর স্ত্রী কে। স্বামী জঙ্গী ধরেছেন, গ্রেফতার করেছেন সন্ত্রাসীদের, এটা কি স্ত্রীর দোষ!!!
৮ বছরের চট্টগ্রাম রেঞ্জের চাকরীকে বিদায় জানিয়ে, মাত্রই ঢাকায় সদর দপ্তরে জয়েন করেছিলেন, বাবুল আক্তার। আফসোস, আর এক সপ্তাহ আগে চলে আসলে হয়তো, এমন হতো না। কোনভাবেই মানতে পারছিনা এ কাপুরুষত্ব, এ খুন।
মাফ করবেন বড় বড় বুলি, আওড়ানো, নেতা, মন্ত্রী, আইনশৃংখলা কর্তারা। আপনার আসলেই ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছেন ‘