ভিতরের খারাপ মানুষটা জন্ম নেয় ইগো থেকে - Women Words

ভিতরের খারাপ মানুষটা জন্ম নেয় ইগো থেকে

আনন্দবাজার পত্রিকার আয়োজনে আনন্দ প্লাসে মুখোমুখি হয়েছিলেন তারা। একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী মনীষা কৈরালা। আরেকজন কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, পেশায় চিকিৎসক ও পরিচালক। কমলেশ্বর নিলেন ক্যাসমার জয়ী মনীষার সাক্ষাৎকার। যেখানে উঠে এসেছে খ্যাতি মানুষের ভেতরে খারাপ মানুষটা কিভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠে।নিজের ভেতরের সেই মানুষটাকে কিভাবে পরাস্ত করেছেন মনীষা। মৃত্যুর কাছাকাছি গিয়ে জীবন সম্পর্কে তার উপলব্ধি। উইমেন ওয়ার্ডসের পাঠকদের জন্য সেখান থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরা হলো-

কমলেশ্বর প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি স্পেশাল অভিনেত্রী। নব্বইয়ের দশকে একমাত্র আপনি সব শীর্ষ পরিচালকের সাথে কাজ করেছেন। সুভাষ ঘাই, মণিরত্নমের সঙ্গে দু’টো ছবি, মনসুর খান, সঞ্জয় বনশালী, রাম গোপাল বর্মা। তারা মনীষার সৌন্দর্য্যের দিকটি তুলে ধরেছেন। কিন্ত এর বিপরীতে  আপনার ‘বিস্ট’ দিকটা জানতে চাই।
মনীষার জবাব, ভেরি ইন্টারেস্টিং প্রশ্ন। অবশ্যই আমার মধ্যে ‘বিস্ট’ আছে। একটা সাঙ্ঘাতিক খারাপ দিক, যেটা বোধহয় সব মানুষেরই থাকে। ভিতরের এই খারাপ মানুষটাকে যাতে আমি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি, সে জন্যই বিক্রম চৌধুরীর ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলাম। আমি একটু বিস্তারিত বলি, ভিতরের খারাপ মানুষটা কেন জন্ম নেয় জানেন? জন্ম নেয় ইগোর জন্য। এবং আমরা যারা সেলিব্রিটি, তারা প্রথমদিন থেকেই এতটা প্যাম্পার্ড হই যে, আমাদের মধ্যে সেই ইগোটা অনেক বেশি থাকে। এর সঙ্গে যোগ করুন আমাদের ইনসিকিওরিটি, আমাদের অতিরিক্ত সেন্সিটিভ হওয়া। সব জায়গায় পাত্তা পাওয়া, না চাইলেও বেস্ট খাবার, বেস্ট গাড়ি, বিজনেস ক্লাসে ট্রাভেল, এগুলি কন্টিনিউয়াসলি পেতে পেতে আমাদের ইগোটা কিং সাইজ হয়ে যায়। সেখান থেকেই ভিতরের খারাপ মানুষের জন্ম।
এরপর শুরু হয় অন্যকে ক্রিটিসাইজ করা। আমরা সবার ভুল ধরতে শুরু করি। অমুক এরকম, তমুক ওরকম। কিন্তু নিজেদের ভুলটা আর আমরা অ্যানালাইজ করতে পারি না। তখন আর  ভাবি না, আমাদের সামনের মানুষটা হয়তো বাড়িতে বাচ্চা আর বৌকে ফেলে রেখে আমাদের ডিউটি করছে। আমরা দুর্ব্যবহার শুরু করি। এগুলো থেকে বেরোতেই আমার এই ক্লাসে ভর্তি হওয়া।
এই ক্লাসে যখন আপনি ভর্তি হন, তখন আপনার সঙ্গে যাঁরা রয়েছেন তাঁরা কেউ আপনাকে চেনেন না। আপনাকে তোষামোদের কোনও কারণ ওঁদের নেই। আমার মনে হয় এই ক্লাস সব সেলিব্রিটির করা উচিত। এতে ধীরে ধীরে পুরোনো মানুষটার সন্ধান পাওয়া যায়। যে সাধারণ ছিল। যে স্কুলে মজা করত। এই ক্লাসগুলো করে করেই আমি নিজের ভিতরের ‘বিস্ট’টাকে নিয়ন্ত্র্রণে আনতে পেরেছি। তারপর ক্যানসার ধরা পড়ার পরে তো আমি অনেকটাই বদলে গেলাম। আজকে আমি আগের থেকে অনেক বেশি ঠান্ডা। গুড নেচারড। কিন্তু ভিতরের ‘বিস্ট’টা এখনও মাঝে মাঝে চাড়া দেয়। (হাসি) ওটা বোধহয় কোনও দিন যাওয়ার নয়।

খুব এনরিচিং লাগল এক্সপ্ল্যানেশনটা। আপনার কথা শুনে বেটি ডেভিসের সেই বিখ্যাত লাইনটা মনে পড়ে গেল ‘টু বি আ স্টার, ইউ হ্যাভ টু বি আ মনস্টার’।
আমি একথার সাথে একমত। তবে সবাই এক হয় না। আজকে এতটা পথ এসে, আমার মনে হয় আপনি দুর্দান্ত শিল্পী হতে পারেন, কিন্তু যদি মানুষ হিসেবে ভাল না হন, আমি সেভাবে আপনাকে ভালবাসতে পারব না। মানুষ ভাল না হলে আমার আকর্ষণও সীমাবদ্ধ থাকবে।

আমি নিজে ডাক্তার। আমি জানি ওই সময়টা কী ভয়ঙ্কর হতে পারে। আপনি কোথায় ছিলেন যেদিন শুনলেন আপনার ক্যানসার হয়েছে?
(মাটির দিকে তাকিয়ে) আমি নেপালে ছিলাম। তার কিছুদিন আগে থেকেই শরীরটা ভাল যাচ্ছিল না। আমার কাকিমা নিজে একজন গায়নোকলজিস্ট। তিনি আমাকে দেখছিলেন। কিন্তু তিনিও বুঝতে পারেননি আমার ক্যানসার ধরা পড়বে।
খবরটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কাকিমা আমাকে বলেন মুম্বাই ফিরে যেতে। আমি মুম্বই ফিরে আসি। সেখানে এসে জানতে পারি, অসম্ভব জটিল একটা অপারেশন করতে হবে। মায়ের কয়েক  স্কুলের বন্ধু থাকেন নিউ ইয়র্কে। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তারপর নিউ ইয়র্কে গিয়ে অপারেশন।

এই অসুখটা তো মানসিকভাবেও একজন মানুষকে শেষ করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট, সেটা অনেকক্ষেত্রে হয়ও।
হ্যাঁ, অবশ্যই। আর আমি খবরটা শোনার পর থেকেই একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাই। আই ওয়াজ ইন আ ট্রান্স।
সেই সময় আমার দু’টো সত্তা কাজ করছিল। একদিকে নিউ ইয়র্কে কোথায় থাকব, কোন ডাক্তার দেখাব, কত ফি‍’জ — এ সব নিয়ে ভাবছিলাম। অন্যদিকে সবার সামনে হাসছিলাম, আশেপাশের লোকজনকে এই বার্তাই দিতে চাইছিলাম, তোমরা চিন্তা কোরো না। আমি ঠিক আছি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সাংঘাতিক ভয় করছিল।

পরিবারের প্রতিক্রিয়া?
মা আমার সামনে নিজেকে অসম্ভব দৃঢ় দেখানোর চেষ্টা করতেন সেই সময়। কিন্তু রাতে ঘুম ভাঙলে শুনতে পেতাম পাশের ঘরে শুয়ে মা কাঁদছেন। সেই সময় মনে জোর পেতে স্পিরিচুয়ালিটির দিকে ঝুঁকি। জীবনের ওই সময় আধ্যাত্মিক চিন্তার থেকে বড় স্ট্রেংথ কিছু হতে পারে না, এটা আমি বুঝে গেছি। ক্যানসার আমার জীবনের একটা বিরাট শিক্ষা, জানেন? ক্যানসারের আগে আমি জীবনকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছি। আমি আমার জীবনের মূল্য বুঝিনি।

আপনার কথাগুলো অসম্ভব প্রেরণাদায়ক। এখন তো আপনি জাতিসংঘের পপুলেশন ফান্ডের গুডউইল অ্যাম্বাসেডর। ক্যানসার অ্যাওয়ারনেসের সঙ্গে জড়িত…
হ্যাঁ, আমার মনে হয় যারা যারা ক্যানসার সারভাইভ করেছে তারা অটোমেটিক্যালি ক্যানসার অ্যাওয়ারনেসের সঙ্গে জড়াতে বাধ্য। আমি, যুবরাজ সিংহ। আজকে আমি মানুষকে একটা কথাই বলি, নিজের শরীরকে অবহেলা কোরো না। ক্যানসারের কিছু আর্লি সাইন আছে, সেগুলো হলেই পুরো চেক আপ করাও। আর সব সময় মনে রেখো, জীবনের চেয়ে সুন্দর কিছু নেই। এই জীবনটাই আমাদের সবচেয়ে বড় গিফট। আর কিছু না। আর এ ছাড়া বলব, সামনের মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা শুনলে জেনুইন সহানুভূতি দেখাও। আ লিটিল এমপ্যাথি। ওটা সেই মানুষটা কোনও দিন ভুলবে না।