সমুদ্রে ব্রিটের মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া ২৯ ঘন্টা - Women Words

সমুদ্রে ব্রিটের মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া ২৯ ঘন্টা

যেদিকে দুচোখ যায় শুধু জল আর জল। প্রতিবেশী বলতে হাঙর, জেলিফিশ। মাথার উপর উড়ছে একদল সিগাল। সামুদ্রিক জল-হাওয়ার কারণে শরীরে পানির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এই অবস্থায় টানা ২৯ ঘণ্টা সমুদ্রের মধ্যে আটকে ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার নাগরিক ব্রেট আর্কিবাড। অল্পের জন্য খোয়াতে বসেছিলেন দু’টো চোখও।
২০১৩ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে একটি প্রমোদতরীতে আট বন্ধুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিলেন ব্রেট। দিব্যি চলছিল সব। কিন্তু হঠাৎই একদিন রাতের অন্ধকারে জ্ঞান হারিয়ে মাঝসমুদ্রে পড়ে যান ব্রেট। সঙ্গে ছিল না লাইফ জ্যাকেটও। হাঙর জেলিফিশ আর সিগালের মুখ থেকে বেঁচে ফিরে আসাটা প্রায় অসম্ভব হলেও সেদিন শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তির জোরে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। ওই কয়েকটা ঘণ্টা পরিবারের সবার মুখগুলো মনে করেই মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছিলেন দুই সন্তানের জনক ব্রেট। কেমন ছিল ওই স্নায়ু ক্ষয়ি সময়গুলো। সেই ভয়ঙ্কর কয়েক ঘণ্টাকে ডায়রিবন্দি করেছিলেন ব্রেট। সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে ব্রেটের সেই ডায়েরি—

১৭ এপ্রিল, বুধবার

রাত ৮.৩০
জলের মধ্যে প্রায় ১৯ ঘণ্টা কেটে গিয়েছিল। সমুদ্রের ওই ভয়ঙ্কর নোনা জল তখন আমি গিলতে শুরু করেছি। শরীরটা অবশ হয়ে আসছিল। খুব তেষ্টা পাচ্ছিল। দু’চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসছে। হঠাৎ মনে হল কী একটা যেন মাথায় এসে খুব জোরে গোত্তা মারল। কোনও একটা ভয়ঙ্কর শক্তি আমাকে জাগিয়ে দিল। মুখের ওপর একটা ভারী বাতাস টের পাচ্ছিলাম, যেন ঝড় উঠেছে। খচমচ খচমচ শব্দে মাথার উপর দিয়ে কারা যেন ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে।
ওই আবছা আলোয় দেখতে পেলাম একদল সিগাল মাথার উপর ঘুরপাক খাচ্ছে। ফের আরও একবার আমার মাথা লক্ষ্য করে ওরা নেমে এল। আমি চিৎকার করে উঠলাম। মাথায় একটা ফন্দি এল। যতটা পারি হাত ছড়িয়ে একটাকে ধরে ফেললাম। মুচড়ে ভেঙে দিলাম ঘাড়। মাথায় দাঁত বসিয়ে দিলাম । পাখিটার রক্তে আমার ভেজা ঠোঁট আরও ভিজে গেল। এত বড় পাখি আমি জীবনে দেখিনি। ঠিক এমন সময় এটা আমার নাকের হাড়ে আঘাত করল। আমার চোখ দু’টো উপড়ে নেওয়ার জন্য লাফ মেরেছিল। শেষ মুহূর্তে মাথা সরিয়ে নিয়ে বাঁচলাম। ঝরঝর করে রক্ত বেরোচ্ছে নাক দিয়ে। আবার চিৎকার করে উঠলাম। ওরা ফিরে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল সিগাল তো সমুদ্রে ঘুমায় না। নিশ্চই কাছেই ডাঙা। আশায় চকচক করে উঠল আমার মুখ।

রাত ৯.৩০
হঠাৎ গলা-ঘাড়ের কাছে একটা তীব্র যন্ত্রণা অনুভব হল। বুঝতে বাকি রইল না এটা জেলিফিশ। ইলেকট্রিকের চাবুক যেন শরীরে ছুটে বেড়াচ্ছে। মনে হল জেলিফিশের আঠালো মাথাটা আমার গলায় আটকে। হাত দিয়ে খামচে বের করে যতদূর সম্ভব ছুড়ে ফেললাম এটাকে। গার্গেলের মতো শব্দ করতে করতে এটা জলে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমার গোটা গলা-ঘাড় জুড়ে তখন তীব্র যন্ত্রণা। সারা শরীর জ্বলছে যেন একটা ঠাণ্ডা জ্বালায়। কয়েকটা জেলিফিশ আবার গায়ে ওঠার চেষ্টা করছে। অন্ধকারেই একটা ছোট্ট নৌকা দেখলাম। বছর ছয়েকের দুই ইন্দোনেশীয় বালককেও দেখলাম। চিৎকার করে বললাম, ‘‘তোমরা আমায় বাঁচিয়েছ, ধন্যবাদ।’’ হঠাৎ দমকা হাওয়া আমার কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি, কোথায় নৌকা আর কোথায়ই বা ওই দু’টি ছেলে। বুঝলাম মনের ভ্রম। বা সামুদ্রিক কোনও ভুত!

রাত ১১.৩০
শক্তি ফুরিয়ে আসছে। তবু শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে ডাঙার দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম শরীরটাকে‌। জিভটা শুকনো, চোখের পাতা পাথরের মতো ভারী। সামান্যই দেখতে পাচ্ছি। দূরে তিনটে আলো চোখে পড়ল। ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়েও দেখলাম ওগুলো একই জায়গায় রয়েছে। বুঝলাম ওগুলো ডাঙা, হয়তো কয়েকটা গ্রাম। নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম কতদূরে ওগুলো? ১০ মাইল? চেষ্টা করলে ভোরের আগেই ঠিক পৌঁছে যাবে ওখানে। আমি সাঁতার শুরু করলাম। কিন্তু স্রোতের বিপক্ষে সাঁতরানোয় আমি কোথাও পৌঁছচ্ছিলাম না।
চেষ্টা করছিলাম মুখটাকে জলের উপরে রাখার। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। আলোগুলো যেন আমায় সাইরেনের মতো ডাকছে। মনে হচ্ছিল মৃত্যু একটা অপরাধ। মনে পড়ছে স্ত্রী অনিতা আর বাচ্চাদের মুখ। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা। আর টানতে পারছি না।

রাত ২.৩০
নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল খুব। চারপাশে শুধুই কালো জল, এতটুকু বাতাস নেই যেন কোথাও। জলটাকে মনে হচ্ছিল কালো সিমেন্ট। সব দরজা ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসছিল। আর আমি তলিয়ে যাচ্ছিলাম।

১৭ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার

ভোর ৪.৩০
অনিতার গলা শুনতে পাচ্ছিলাম যেন। চোখ খুলে ডাঙার দিকে সাঁতার কাটতে লাগলাম। দূরে একটা মাছ ধরার নৌকো দেখতে পেলাম। প্রত্যেক মুহূর্তে মনে হচ্ছিল ওটা আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। ওটাই শেষ আশা। পৌঁছতেই হবে। এগোতেই দেখি জলের উপর একটা কালো ক্রস।

সকাল ৬.৫৮
ডরিস নৌকা ইতিমধ্যে তল্লাশি শুরু করেছে। অস্ট্রেলীয় উদ্ধারকারীরা আমার খোঁজে চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে ডেকে নিজের জায়গা নিয়েছে। আশ্চর্যজনক ভাবে আমার এক ইন্দোনেশীয় বন্ধুই জলের মধ্যে প্রায় ডুবন্ত এক মানুষকে দেখে চিৎকার করে ওঠে। ১০০ মিটার দূরে তখন উল্লাস। ভোরের আলোয় চকচক করছে একটা মানুষের মাথা।

সকাল ৭.১৫
নুন জল বমি করছিলাম। সাক্ষাৎ মৃত্যুদূতের মতো ওই কালো ক্রসটা আমাকে তাড়া করছে। পরক্ষণেই বুঝলাম ওটা জাহাজের মাস্তুল। আচমকা ওটা সরে যেতে লাগল। আমি চিৎকার করলাম, ‘‘প্লিজ চলে যেও না, আমার দিকে দেখো।’’ আমি নিজেকে যতটা সম্ভব উঁচু করে মেলে ধরার চেষ্টা করছিলাম। ঠিক এমন সময় কে যেন একটা লাইফ-রিং ছুড়ে ফেলল। কিন্তু আমার শক্তি শেষ। এত কাছে তবুও ওটাকে ধরতে পাচ্ছিনা।  ডুবে যাচ্ছি। তখনই দু’টো হাত আমাকে চেপে ধরল। দেখলাম আমার চারপাশে কমলা রঙের একটা লাইফ রিং। একটা কন্ঠস্বর— ‘‘তোমাকে ফিরে পেয়েছি বন্ধু।’’
মেনতাওয়াই স্ট্রেটের কাছে সমুদ্রে প্রায় ৫০ নটিক্যাল মাইল সাঁতার কেটেছিলেন ব্রেট। সুমাত্রা ও ইন্দোনেশিয়ার মেনতাওয়াই দ্বীপকে আলাদা করে এই মেনতাওয়াই স্ট্রেট। সিপুরা দ্বীপের কাছ থেকে ব্রেটকে তাঁর বন্ধুরা ও অস্ট্রেলীয় উদ্ধারকারী দল উদ্ধার করেন। সে সময় ব্রেটের রক্তচাপ মারাত্মক কম। হাত, পা-সহ শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে গিয়েছিল। নাকের যেখানে সিগাল ঠুকরেছিল, সেখানে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। চিকিৎসকেরা প্রাথমিক চিকিৎসা করার পর তাঁর স্ত্রীকে খবর দেন। রাত দু’টো নাগাদ ফের নিজের জাহাজে ফেরত পাঠানো হয় ব্রেটকে। শারীরিক ভাবে সুস্থ হওয়ার পরও বেশ কিছু দিন পর্যন্ত ব্রেটকে তাড়া করে বেরিয়েছে ওই ভয়ঙ্কর স্মৃতি। তবে আপাতত সুস্থ তিনি। মৃত্যুর একদম মুখ থেকে ফিরে এসে জীবনকে নতুন করে বুঝতে শিখেছেন ব্রেট।

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা