বন্ধু যদি অসাম্প্রদায়িক হও তবে প্রতিবাদ কর, প্রতিরোধ গড় - Women Words

বন্ধু যদি অসাম্প্রদায়িক হও তবে প্রতিবাদ কর, প্রতিরোধ গড়

রীমা দাস

ফেইসবুকে আমি খুব সক্রিয়, এ নিয়ে আমার বন্ধু মহলে আমার ‘সুনাম’-‘বদনাম’ আছে। কোথাও গেলে, কিছু করলে,গুলটিকে নিয়ে, বাবাকে নিয়ে বা বন্ধুদের নিয়ে সারাক্ষণ মেতে থাকি ফেবুতে। সেই আমার এখন ফেবুতে আসতে ভালোলাগে না। লাইক. কমেন্ট করতে ভালোলাগে না। আমার আনন্দ প্রকাশের ইচ্ছাগুলো মরে গেছে বা পাথর হয়ে গেছে। আমার বুকের ভেতর চাপা কষ্ট, আমার চোখে আগুন জ্বলছে। সে আগুন, যদি পারত তবে সব ভস্মিভূত করে দিত। কিন্তু সে আগুন ছাই চাপা আগুনের মত নিজেকে পুড়ছে কেবল, কেবল নিজেকে জ্বালাচ্ছে।
আমরা সবাই মানুষ। আমি ভালো আছি কিন্তু আমার মা বোন,বন্ধু নিরাপদ নয়। তাদের জন্য আমার বুকের ভেতর দীর্ঘশ্বাস শুধু দীর্ঘ হচ্ছে। আগ্নেয়গিরির মত বুকের ভেতর লাভা জমছে, যা যে কোনো দিন বাইরে আসবে, নিজে জ্বলবে, জ্বালাবে সব। মনে পড়ে ১৯৯১ সালের কথা। তখন আমি স্কুলে পড়ি। বাবরি মসজিদ উপলক্ষে তখনও আমাদের মানে হিন্দুদের উপর ঝড় বয়ে গেছিল। আমরা খুব আতঙ্কিত ছিলাম।আমার শিশু মনে এই ঘটনা বিরাট রেখাপাত করেছিলো। জিন্দাবাজারের ১৩ পলাশীর ছোট্ট ঘরে মা, বাবা, ৪বোন, ভাই ও আত্মীয় মিলে কাটত আমাদের আতঙ্কের রাত। আমি নিজের চোখে দেখেছি আমাদের জিন্দাবাজারের মন্দিরের প্রতিমাকে পুড়ানোর ছাই। কি কালো, কি কালো সেই ছাই!! মা ১৯৭১ সালে দেখেছেন। সে সময় বাবা ছিলেন সাথে। সেই সময়ের আতঙ্ক মা’র মধ্যে দেখা যায় ১৯৯১ সালেও। এমন সময় আমাদের প্রতিবেশী ১৪ পলাশীর লোকজন আমাদের পাশে দাঁড়ায়।তাদের এই ভরসায় মা’র চোখে আমি নির্ভরতা দেখি,যা তিনি ১৯৭১ সালেও পেয়েছিলেন। উল্লেখ্য যে আমাদের ১৪ পলাশীর প্রতিবেশীরা মানুষ ছিলেন আর তাদের ধর্ম ছিল ইসলাম। বাবার সবচেয়ে প্রিয়জন খালেক কাকু, বশির কাকু, এহতেশাম কাকুরা মানুষ, ইসলাম তাদের ধর্ম। এখনো বিভিন্ন জায়গায় আমি খালেক কাকু, এহতেশাম কাকুর গল্প করি। একবার আমি আর বোনু ঢাকা গিয়েছিলাম একা একা, বাবাকে ছাড়া। সেবার এহতেশাম কাকু বাবার ছায়ায় আমাদের দুবোন কে রেখেছিলেন। খালেক কাকু আমাদের বাসায় এলে আমার আবদার আমি তাঁর মেয়ে। সবাই আমাদের এত এত আদর, স্নেহ ভালোবাসা দিয়েছেন তাতে আমরা কখনও হিন্দু/ মুসলিম ভাববার সুযোগই পাইনি। বন্ধুত্ব যখন বুঝলাম তখনও দেখিনি কে হিন্দু কে মুসলিম। এখনও যার সাথে রিক্সায় ঘুরতে পছন্দ করি, মায়ের/বোনের পর যাকে খুব কাছের মনে হয়,যার সাথে নিজের জীবনের পাওয়া না পাওয়া সুখ দুখের গল্প করি তারা সবাই মানুষ। আমাদের পথ চলায় কখনও ধর্ম বাধা হয়ে আসেনি। কিন্তু এখন মনের মধ্যে প্রচন্ড দ্বিধা, প্রচন্ড ক্ষোভ।কিছু সংখ্যক লোক(!) চায় না আমরা সবার সাথে চলি।আমাদের সাথে সবাই মিশুক, আমাদের দুঃখে কষ্টে তারা কাঁদুক। সেই সংখ্যা কি খুব বেশি? বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, না খুব বেশি নয়। তবু কাছের মানুষের / নিজের মানুষের নিরবতা আমাদের ( আমরা যারা ব্যথিত) কাঁদায়। আমাদের বিশ্বাসের ভিত নষ্ট করে দেয়। নাসির নগর, হবিগঞ্জ,ছাতক, গোপালগঞ্জ, খুলনা যশোর আরো আরো নাম না জানা স্থানে যে সব মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে তাদের পাশে না দাঁড়ালে,তাদের কথা না বললে সেই শক্তিকেই মদদ দেয়া হয়।
বন্ধু যদি অসাম্প্রদায়িক হও, যদি মনে প্রাণে মানুষকে ভালোবাস তবে প্রতিবাদ কর, প্রতিরোধ গড়। তবু আশায় ঘর বাঁধি। আক্রান্তরা বলে, কেন বাধোঁ? এদেশ কি তোমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে এখানে থাকার?? নোংরা রাজনীতির শিকার হচ্ছি সব সময় আমরা। নিজেদের যোগ্যতা প্রকাশ করার জন্য সব সময় আমাদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে। বাংলাদেশের হিন্দুরা নিজেদের লুকিয়ে বাঁচে, যাদের সুযোগ আছে তারা পালিয়ে বাঁচে আর একদল বাঁচে অন্যের পা চেটে চেটে। আর আমরা কিছু সংখ্যক মানুষ যুদ্ধের ময়দানে মাথা উঁচু করে লড়াই করে বাঁচি, আমরা হিন্দু নই মুসলিম নই আমরা মানুষ। আমাদের রক্ত খুব শীতল, সেই শীতল রক্তকে দানবরা আরো শীতল করে দেবার জন্য আজকের এই চক্রান্ত। এখন সবাই সবার সহযোদ্ধা হবার সময়, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিরোধ করার সময়। সেই সময় যদি চলে যায় তবে এই দেশ আর সোনার বাংলা থাকবে না।।