ঈদের মিছিল - Women Words

ঈদের মিছিল

ফাহমিদা ফাম্মী

আমি ছোটবেলা থেকেই রাতের চেয়ে দিনে ঘুমাতে বেশি পছন্দ করতাম। আম্মু সকালে অফিসে চলে যেতেন, তাই আব্বু আমাকে তার কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতেন। আমার মনে আছে আমার ছোটবেলাটা শুরু হয় সিলেটের কাজি টুলার চয়নিকা ভিলা নামক এক টিন শেডের বাসায়, ঠিক টিন শেড না হাফ বিল্ডিঙের এক বাসা … দুই কামড়ার সেই বাসাটায় থাকতাম আমি, আম্মু আর আব্বু … পাশের বাসায় থাকতো আরেকটা পরিবার। কিন্তু বেশি দিন ছিল না তারা, অল্প কিছু দিন পর কি এক কারণে বাসা ছেড়ে চলে যায় তারা … তারপর আরেকটা ফ্যামিলি আসে ঐ বাসাটায় । একজন আন্টি, একজন আঙ্কেল, একটা বড় আপু আর তাদের একটা ছোট ছেলে। তারা আসেন রংপুর থেকে। আপুটা আমার বছর চারেকের বড় কিন্তু ছোট ছেলেটা আমার চেয়ে দুই বছরের ছোট। সেই ছেলেটা অল্প কয়েকদিনের মধ্যে আমার খুব ভালো একটা খেলার সাথীতে পরিনত হয় …। যার নাম ছিল শিমুল … সে খুব দুষ্টু ছিল আমিও কম ছিলাম না … আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দুষ্টুমি করতাম …। দুটোয় মিলে এক কথায় পাড়া চষে বেড়াতাম … এর জন্য অবশ্য অনেক বকাও খেতে হত … শিমুলের বড় বোন নীলা আপু , তিনি বাসার পাশেই এক স্কুলে পড়তেন। স্কুল থেকে ফেরার সময় শিমুলের জন্য চকলেট- আচার এইসব সেই নিয়ে আসতেন … আমার খুব খারাপ লাগত; এক তো আমি তখনও স্কুলে ভর্তি হইনি, আরেক হল আমার তখনও কোন ভাই বোন হয় নি …। তখনও আমি আমার বাবা মায়ের এক মাত্র মেয়ে । আমি আর শিমুল, সাথে পাশের বাসার এক ভাইয়াও থাকতো, তিনি অবশ্য আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড়- ঠিক কতটা বড় আমি এখনো তা জানি না … নাম তার তামিম। তামিম ভাইয়া, আমি, শিমুল আমরা সবাই মিলে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রতিযোগিতা করতাম … আমাদের বাসার পাশেই একটা মাজারের মত ছিল-যেখানে একজন আউলিয়ার কবর ছিল … সবাই শবে বরাত এর রাতে সেখানে যেত, আমাকে নেওয়া হত না মেয়ে বলে ।। তখন খুব আক্ষেপ লাগতো কেন আমি মেয়ে হলাম, যদি ছেলে হতাম তাহলে নিশ্চয়ই ঐ টিলার উপরে আমাকে নিয়ে যেত …

এখনকার ঈদে তেমন একটা মজা পাই না … কিন্তু তখনকার ঈদটা ছিল অন্যরকম … রোজা আসলেই সবাই এক বাসা থেকে আরেক বাসায় ইফতার পাঠাতো …আর ঈদ এর আগের দিন রাতে আমরা ঈদ মোবারক বলে বলে মিছিল করতাম … ঐ মিছিলে সামনের কলোনির পিচ্চিরা, আমি, শিমুল,তামিম ভাইয়া,নীলা আপু আমরা সবাই থাকতাম। আর ঈদের দিন সকালে যেতাম আমাদের সামনের বাসায়। কেয়ারটেকারের বাসা, তামিম ভাইয়াদের বাসা। ভাইয়ার দুইটা বোন ছিল একজনের নাম রিমা, আরেক জন রিপা … রিমা আপু ছিলেন খুব শান্ত শিষ্ট একটা মেয়ে … আর রিপা আপু ছিলেন একটু চঞ্চল প্রকৃতির… ঈদের সকালে যখন যেতাম তখন রিমা আপুর আম্মা আমাকে ধরে আদর করে দিতেন। তার পাশে গেলেই জর্দার গন্ধ পাওয়া যেত … আন্টি এক ধরনের সেমাই বানাতেন যেটা বাজারের বাংলা সেমাই নামে পরিচিত , আমি আন্টির হাতে বানানো সেই সেমাইয়ের মত সেমাই আর কখনো খাই নি … ঈদ এর জামাটা বরাবরই লুকিয়ে রাখতাম, পাছে কেউ দেখে না ফেলে, দেখে ফেললেই তো ঈদ শেষ! ঈদ শেষ হয়ে যেত না কখনোই- লুকানো জামাটা পরে বাসায় বাসায় যেতাম, উদ্দেশ্যটা হয়তো নতুন কাপড় দেখানো আর সালামি নেওয়া… এখন আর সালামি নেওয়া হয় না, বরং দেওয়ার সময় চলে এসেছে… ছোটদের ঈদ দেখতে মজা লাগে… আসর করে মেহেদি দেওয়া, মায়ের পিঠা বানানোতে বাধা দেওয়া এবং নিজে নিজেই পিঠা বানাতে খাট পিড়ি নিয়ে বসে যাওয়া… এই ছিল আমার ঈদ … আমার সেই ছোট্ট বেলাকার ঈদ… আমার সেই রূপকথায় রাঙা নতুন জামার ঈদ… সবাইকে ঈদ মোবারক…