‘পিতৃতান্ত্রিক পরিবারগুলো নারী লেখকদের সবচেয়ে বড় শত্রু’ - Women Words

‘পিতৃতান্ত্রিক পরিবারগুলো নারী লেখকদের সবচেয়ে বড় শত্রু’

তাঁকে অনেক বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায়। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, কবি, অনুবাদক, গবেষক। তিনি অদিতি ফাল্গুনী। ১৯৭৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি যশোরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। অদিতির লেখালিখিতে আত্মপ্রকাশ ঘটে কুড়ি বছর বয়সে দৈনিক ভোরের কাগজ পত্রিকার সাহিত্য পাতায় প্রথম গল্প লিখে। ১৯৯৯ সালে তার প্রথম গল্প ‘ইমানুয়েলের গৃহ প্রবেশ’ স্টুডেন্ট ওয়েজ থেকে প্রকাশিত হয়। এ পর্যন্ত তাঁর ২৫ টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘খসড়া খাতা :নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’, অনুবাদগ্রন্থ ‘আমার জীবন’ (মার্ক শাগালের ‘মাই লাইফ’), অনুবাদগ্রন্থ ‘গোত্রপিতার হেমন্ত’ (গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘দ্য অটাম অব দ্য প্যাট্রিয়ার্ক’), গল্পগ্রন্থ ‘চিহ্নিত বারুদ বিনিময়’, অনুবাদ গ্রন্থ ‘মিকেলেঞ্জেলো :জীবন ও কর্ম’ (মূল :আলেক্সান্দ্রা গ্রুমলিং) ,কাব্যগ্রন্থ ‘অধিবর্ষ অপরিচয়ের’, ‘হে প্রেম হে ঈশ্বর আমার’,  গল্পগ্রন্থ ‘তিতা মিঞার জঙ্গনামা’, আখ্যান সংকলন, ‘নক্ষত্র, শাপলা, স্পার্টাকাস ও ভাসান যাত্রার গল্প’, গল্পগ্রন্থ ‘অপৌরুষেয় ১৯৭১’ অনুবাদগ্রন্থ ‘আপেল’ প্রভৃতি। বর্তমানে তিনি বাংলা একাডেমীর উপ পরিচালক (অনুবাদ বিভাগ) হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এর আগে তিনি ইউএনডিপি, ডেনিডা, একশন এইড এবং কয়েকটি ইংরেজি দৈনিকে কাজ করেছেন। প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কার ২০১১ সহ মোট তিনটি পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।  

উইমেন ওয়ার্ডস এর পাঠকদের জন্য অদিতি ফাল্গুনীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন

বাশিরুল আমিন


বাশিরুল আমিন: আপনার লেখা পড়লে বুঝা যায় আপনি কবিতা পাগল। আর একজন কবিও। কিন্তু আমাদের মাঝে খ্যাতি পেলেন গল্পকার আর অনুবাদক হিসেবে… কেউ কি কখনো আপনাকে কবি সম্বোধন করে বা করেছিল? আপনার প্রথম গল্প ছাপা হয় ভোরের কাগজে। আর প্রথম বইও গল্পের “ইমানুয়েলের গৃহ প্রবেশ”। তখন কবিতা লিখতেন? ছাপা  হয়েছিল কোথাও?

অদিতি ফাল্গুনী: এ পর্যন্ত চারটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে আমার। প্রথম কবিতার বই ‘অধিবর্ষ অপরিচয়ের (২০০৮)’ ফেব্রুয়ারি বই মেলার ১৮ তারিখে মেলায় আসার পরও দিন সাতেকের ভেতর প্রকাশক নিজেই বলেন যে ৬০ কপির মত বই বিক্রি হয়ে গেছে। সাত দিনে কবিতার বই ৬০ কপি বিক্রি হওয়া খুব খারাপ না। আবার শেষ কবিতার বই ‘আগামীকাল আমরা জিনিয়া ফোটাব (২০১৬)’  ২৬ ফেব্রুয়ারি মেলায় আসায় ‘চৈতন্যে’র প্রকাশক হয়তো ১০ কপিও বিক্রি করতে পারেন নি। যেহেতু মেলা শেষই হয়ে যায় ২৮ তারিখ। আর কবিতার বই ত’ কমই বিক্রি হয় উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ বা অনুবাদের চেয়ে। আসলে লেখক হিসেবে আত্ম-প্রকাশের আগে…মানে পত্র-পত্রিকায় ছাপতে শুরু করার আগে…বাসায় কবিতা-গল্প দু’টোই লিখতাম। ইন্টার পরীক্ষার পর বাসায় বসে গ্রিক ট্রাজেডি বা এলিয়টের কবিতা অনুবাদ করেছি যা আজো অমুদ্রিত। তবে, জীবনের বড় ভুলটা করেছি বোধ করি কুড়ি বছর বয়সে দৈনিক ‘ভোরের কাগজ’-এ কবিতা ছাপতে না দিয়ে গল্প ছাপতে দেয়ায়। সেই গল্প ছাপা হলো। তারপর সবাই শুধু গদ্য চায়। বাঙালী খুব ত’ শ্রমপাগল জাতি নয়। কবির সংখ্যা তাই যত বেশি, গদ্য লেখা মানুষ তত নয়। মইনুল আহসান সাবের ভাই যখন ‘ভোরের কাগজ’-এর সাহিত্য সম্পাদক, খুব যত্ন করে আমার গল্প এবং রিলকের (জার্মান কবি) উপর অনুবাদ ছাপছেন- ১৯৯৮ সালের কথা, আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশের আগেই- কিন্তু, একবার কবিতা দেবার পর বললেন, ‘ভাই- প্রতিদিন কবিতা আসে হাজারে হাজার। আপনি বরং গদ্য লেখেন।’ এর ভেতরেও ‘নব্বই দশকের কবিতা’-য় আমার কবিতা একটি ছাপা হয় যা শুরুতে ‘শৈলী’তেও ছাপা হয়েছিল। ‘শৈলী’ আমার চে গুয়েভারাকে নিয়ে লেখা ‘আপুনতা বেন’সহ আরো একাধিক কবিতা ছেপেছিল ১৯৯৬-৯৮ পর্বে। দৈনিক ‘জনকন্ঠে’-ও একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল ১৯৯৬ নাগাদ। সেই হাতে গোণা তিন/চারটি কবিতা যারা পড়েছেন তখন, তারাই বলেছেন ‘একটু অন্যরকম।’ তবু, আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করা হলো নব্বই দশকের কবিতায় আমার কবিতা প্রকাশিত হবার জন্য। তাকে ‘ঐতিহাসিক কবিতা’ বলে কেউ কেউ নিবন্ধ লিখলেন। সমবেত টিটকিরিতে আমি কিছুদিন আর প্রকাশের পথে গেলাম না। ২০০৪-এ ‘রাতের চিহ্ন’ নামে একটি লিটল ম্যাগে আমার ‘অধিবর্ষ অপরিচয়ের’ কবিতাটি পড়ে সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের মত খ্যাতনামা কবি ‘রাতের চিহ্নে’র পরবর্র্তী সংখ্যায় নব্বই দশকের কবিতা নিয়ে বলতে গিয়ে আমাকে নিয়ে আলাদা ভাবে দুই লাইন লেখেন বিশেষ প্রশংসা করে, যদিও তাঁর সাথে আমার পরিচয় ছিল না। অথচ, তখন খ্যাতনামা নানা পত্রিকায় লেখা বহু কবির নাম এক পংক্তিতে নিয়েছিলেন তিনি। কবি ব্রাত্য রাইসুর কাছ থেকে সুব্রত দা’র ই-মেইল নম্বর নিয়ে তাঁর সাথে যোগাযোগ করি। তিনি আমার প্রথম কবিতার বইয়ে ১৭টি কবিতায় ছন্দের ক্ষেত্রে সাহায্য করেন। আমার জীবনে একটি সমস্যা হলো জীবনের একটা পর্যায়ে- ২০০৫ থেকে ২০১৩ অবধি বিশেষ করে- সাহিত্যভুবনে সতীর্থ বা কিছুটা অগ্রজদের কাছ থেকে এত বিরামহীণ গালি সহ্য করেছি বা করতে হয়েছে অকারণেই যে আমার নিজের মনও বোধ করি ছোট হয়ে গেল…যে সুব্রত দা কবি হিসেবে আমার প্রথম স্বীকৃতি দিলেন- তাঁকে আমার প্রথম কবিতার বই ডেডিকেটও করি আমি- তাঁরই ‘মাতৃমূর্তি ক্যাথিড্রাল’ গল্পগ্রন্থর খুঁতখুঁতে সমালোচনা করি আমি। অনবদ্য ভাষা- ভিন্ন ধরণের ফিকশন- তবু, বোধ করি খুব বেশি সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যবোধে ফিকশন লেখার বিচারবুদ্ধিও কিছু আচ্ছন্ন করেছিল। তা’ ওনার ‘নির্বাচিত কবিতা’র তুলনা হয় না। সেটা নিয়ে আজো লেখা হয়ে ওঠেনি। কিন্তÍ অন্য একটি কবিতার বইয়ের অনেক প্রশংসা করলেও কিছু সমালোচনাও করেছিলাম। সব মিলিয়ে খুব ভুল বোঝাবুঝি হয়। আজও ওনাকে সামনা-সামনি দেখিনি। উনি থাকেন  দূর পরবাসে। তবে, ওনার মত কবি আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন সেটা ঠিক।

Audity Falguni 02 Women-words যাহোক- এরপর সিলেটের ‘সুনৃত’ বা ‘হরিণা’ আমার বেশ কিছু কবিতা ছাপে। ছাপে ‘কালের খেয়া’ বা ‘সমকালে’র সাহিত্য পত্রিকাও। এরপর ২০১২-তে ‘শুদ্ধস্বর’ আমার দ্বিতীয় কবিতার বই ‘খঞ্জ হংসীর গান’ বা ২০১৪-এ ‘জাগৃতি’ আমার তৃতীয় কবিতার বই ‘হে প্রেম হে ঈশ্বর আমার’ ছাপে। ২০১৬-এ প্রকাশিত শেষ কবিতার বই সহ চারটি কবিতার বইয়ে আমার মোট ৩০০ কবিতা প্রকাশিত হয়েছে ও ফেসবুকে নোট আকারে আরো ৩০০ অপ্রকাশিত কবিতা রয়েছে। অদ্ভুত বিষয় হলো – এমূহুর্তে ঢাকার বড় পত্রিকাগুলো আমার কবিতা ছাপছে না, প্রতিনিধিত্বকারী সঙ্কলণগুলোয় আমি নেই, স্বীকৃত কবিরা আমাকে ‘কবি’ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করছেন না- অথচ, আনুষ্ঠানিকতার বলয়ের বাইরে মৌনতার, ফিসফাসের স্বীকৃতিটা ভয়ানক ভাবে পাচ্ছি। তরুণ কবিরা কেউ কেউ বলছেন জোরেসোরেই। ২০০৮-এ আমার প্রথম কবিতার বই প্রকাশের পরই কবি সিদ্ধার্থ টিপু তাঁর প্রথম বই প্রকাশের আগে আমাকে দিয়ে তাঁর বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা লেখান। বলেছিলেন যে আমার কবিতা তাঁর এত ভাল লেগেছে যে আমাকে দিয়েই ফ্ল্যাপ লেখাতে চান। সেই বই তাঁর পরে পুরষ্কারও পায়। কোন বড় পত্রিকার তরুণ সাহিত্য সম্পাদক হয়তো সিনিয়রের নিষেধাজ্ঞায় আমার কবিতা ছাপছেন না- কিন্তু, হাউস থেকে বের হয়েই বলছেন যে আমার কবিতা খুব পছন্দ করেন। আমার কবিতার বই কিনেছেন ও কিনবেন কিম্বা আমাকে তাঁর প্রকাশিত কবিতার বইগুলো দেবেন। আমি দেখেছি কিনা তাঁর সর্বশেষ কবিতার বই? এখন এর চেয়ে স্বীকৃতি আমি আর কি পেতে পারি? ফেসবুকে আমার কবিতা পড়তে পছন্দ করেন অনেকেই। ওপারের অনেকেও পছন্দ করেছেন। ওপারের গৌতম ঘোষ দস্তিদার ‘রক্তমাংস’ বা ‘নতুন কৃত্তিবাস’-এ আমার কবিতা ছেপেছেন। ওপারের শ্যামল ভট্টাচার্য আমার একটি কবিতার বই নিয়ে ফেসবুকে লিখেছেন। এখন সাহিত্যের  ভুবনে নানা রাজনীতি  থাকে। কাউকে বেশি বাড়তে দেবার না রাজনীতি। কারো নানামাত্রিকতা সহ্য না করার রাজনীতি। যিনি বা যারা করছেন, তারাও জানেন যে কি করছেন তারা! কি বলবেন? চেঁচাবেন? তোমার প্রশ্নটাই কি আমার কবিসত্ত্বার প্রতি সহমর্মীতা ও স্বীকৃতি নয় বাশিরুল? আমার মৃত্যুর পর এমনটাও হতে পারে যে হয়তো আমার কবিতা টিঁকলো- গল্প টিঁকলো না? কোন কোন পাঠক তো আমার কবিতা বেশি পছন্দ করেন বলেও মত প্রকাশ করেন। ওপারের বিখ্যাত কবি যশোধরা রায় চৌধুরী বা যশোধরা দি হয়তো আমার একাধিক কবিতা শেয়ার দিলেন। সেটা কি স্বীকৃতি নয়? গতবছর ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’-এ কবিতা পড়েছি। সাহিত্য ভুবনের আধিপত্যের রাজনীতির নানা কূটকৌশল বেশিদিন টিঁকবে না- টিঁকছেও না। আমার বড় ভাই কবি তাপস গায়েন আমার কবি স্বীকৃতি না মেলায় খুব দু:খ করে। আবার ’৭১-টিভির নামী এ্যাঙ্কর মিথিলা ফারজানা আর তাঁর জীবনসঙ্গী জ্যোতি জয়নুদ্দীন ভাই ফেসবুকে পড়েই আমার কবিতার অনুরাগী। জ্যোতি ভাই নাকি একবার এক বড় পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদককে ফোনই করেছিলেন আমার কবিতা তাঁরা কেন ছাপেন না এই অভিযোগ করার জন্য- এই গল্প করে মিথিলা হাসছিল আমার কাছে! এখন নাইবা বললো আমাকে কেউ ‘কবি।’ জীবনানন্দের সময়ে থাকত ট্রাঙ্কে অপ্রকাশিত খাতা আর আমাদের সময়ে ফেসবুকের নোটগুলো তো থাকবে। দু:খ এটাই যে অনেক পরে এলো ফেসবুক।
আর অনুবাদকের স্বীকৃতিও আমাকে কেউ দেয় নি। ২০০৩-০৪ নাগাদ একটি বড় পত্রিকা যখন আমাকে প্রায় দেড়/দুই বছর টানা রুদ্ধ করে রেখেছে- তারা এমন প্রায়ই করে- নিজেরাই কিউবার উপর মার্কিনী অবরোধের মত অবরোধ দেয়, আবার খোলে- হাস্যকর, অপরিণত নানা আচরণ করে- তখন টিঁকে থাকার স্ট্রাগল থেকে মার্কেজের বই অনুবাদ করেছিলাম। এভাবে স্বীকৃতি তৈরি করতে হয়েছে।

অনুবাদ ধরলেন কখন? মার্কেজ থেকে নিয়ে সোয়েতলানা পর্যন্ত অনুবাদ করলেন, কবিতাও তো অনুবাদ করেছেন অনেক। কোথায় স্বতঃস্ফূর্ততা পেয়েছেন বেশি?

সেই অর্থে জীবনে প্রথম অনুবাদ ধরি বোধ করি ১১/১২ বছর বয়সে। বাসায় একটি সুন্দর চৈনিক রূপকথার বই ছিল। কয়েক পাতা একটি নিউজপ্রিন্টের রাফ খাতায় ইংরেজি থেকে বাংলা করেছিলাম। পরে বাবার বদলির চাকরিতে শহর বদলের সময় সেই খাতা ও বই দু’টোই হারায়। ইন্টারের পর ‘দ্য ট্রোজান ওমেন’ আর ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ করেছিলাম নিউজপ্রিন্টের বাঁধাই খাতায়- আজো অমুদ্রিত। ২০০০ সালে দৈনিক ‘সংবাদ’-এ ধারাবাহিক ভাবে মার্ক শাগালের আত্মজীবনীর অনুবাদ প্রকাশ হয় যা পরের বছর ‘ঐতিহ্য’ বই করে। অনুবাদ কখন বেশি করি জানেন? যখন আমার পরিবার, সমাজ বা কর্মক্ষেত্র- সবাই শুধু নারী হিসেবে আমার পায়ে জেন্ডার নর্মসের অসংখ্য শেকল পরাতে চায়- আমি পাবর্ত্য চট্টগ্রাম থেকে হাওর পর্যন্ত ছুটতে চাই আমার ফিকশনের কাজে- অথচ, শুধু বাঁধা পাই- তখন সেই অসহায়ত্ব ভুলতে অনুবাদ করি। ২০১৪ সালে প্যালেস্টাইনে ইসরাইলী হামলার সময় ৯০টার মত ফিলিস্তিনী কবিতা অনুবাদ করি। এখন অল্প/স্বল্প ফরাসী কবিতা অনুবাদ করছি। গদ্যের চেয়ে কবিতা অনুবাদে শ্রম কম, কাজেই স্ফূর্তিও বেশি। এছাড়া কবিতায় চিত্রকল্প থাকে। সেটা অনুবাদ করার আনন্দ তো বেশি হবেই। 

আপনি উপন্যাসে অতীত ও বর্তমানকে সমান্তরালে এনে কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যান। যেমন রেললাইনের দু-স্লিপারে চলতে থাকা ট্রেন… “ক্রমাগত হত্যার সেরেনাদে” … এইটা কি আপনার স্টাইল?

অনেকটা সেরকমই। প্যারালেল টেলিং বলে একে সাহিত্যের পরিভাষায়। ২০১৫ সালে ‘ইত্তেফাক’ ঈদ সংখ্যায় দেশে মুক্তচিন্তক বা ব্লগার হত্যা নিয়ে একটি উপন্যাসের খসড়া- প্রায় ২৪,০০০ শব্দ লিখেছিলাম যা প্রকাশিত হয়েছিল। তবে, শুধুই সমকালের ঘটনা তাতে থাকে নি। ভারতের সাধিকা মীরা বাঈ, এলিয়টের ‘মার্ডার ইন দ্য ক্যাথেড্রাল’ বা ইসলামের খলিফাদের উপর সংঘটিত হত্যাকান্ডের ঘটনাগুলো কিছু এসেছিল। পরে অনেকে বই করতে মানা করায়- নিরাপত্তার বিবেচনায়- আমি আর প্রকাশ করি নি। যদিও ‘হলি আর্টিজান’ নিয়ে আলাদাভাবে ‘রিনাসসিতা’ নামে গল্প লিখেছি যেটা চাইলে মূল উপন্যাসের ভেতর সংযুক্ত করাই যেতে পারে। উপন্যাসটি এখনো যে লিখছি না তা’ নয়, তবে অনেকের কথায় আর প্রকাশ করিনি। পরবর্তীতে সংঘটিত নানা ঘটনা নিয়েও ব্যক্তিগত ডেস্কে বসে লিখেছি- তবে, প্রকাশ করা হয়নি। এখন ভাবছি এটা শেষ করা প্রয়োজন। তবে, সংবাদ ভাষ্যের হুবহু নিহত চরিত্রদের নাম না নিয়ে- ফিকশনালাইজ করে যেমন লিখেছি- তেমনটাই লিখতে হবে।

কথা সাহিত্যে আপনি ব্যতিক্রম  বিশেষত কাহিনী নির্বাচনে ও প্রাকরণিক ঢঙে… আপনার গল্পের শুরুতে অনেক সময় কবিতা বা বিদেশী সাহিত্য থেকে উদ্ধৃতি থাকে? এইখানে আপনি কি কারো ধারা প্রভাবিত?

(হাসি) কৈশোরে অত্যধিক বঙ্কিম পড়ার ফল। বঙ্কিমের উপন্যাসের শুরুতে দেখবেন ইংরেজি সাহিত্য থেকে নানা উদ্ধৃতি। ইংরেজি কবিতায় যাঁকে গুরু মানি সেই এলিয়টের লেখাতেও অমনটি দেখা যায়। লাতিন কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে হয়তো শুরু হচ্ছে। আজকের বিশ্বের বড় লেখকদের ভেতর অমিতাভ ঘোষের কাজের ধরণটি আমার ভাল লাগে। একটি নির্দিষ্ট বিষয় বেছে নিয়ে সেটা নিয়ে পড়া, ঘোরাঘুরি- দীর্ঘ সময় ও অভিনিবেশ ধরে কাজ করা। মহাশ্বেতা দেবী বা এমনকি আমাদের দেশে সেলিনা হোসেন বা রিজিয়া রহমানরাও আন্তরিক ভাবে এই পদ্ধতিতে কাজ করার প্রয়াস পেয়েছেন।

আপনার ধারায় কিন্তু অনেকেই প্রভাবিত হচ্ছে… খেয়াল করেছেন? 

(হা হা হা)…এতটা কি এখনি বলা যায়? তবে, একটা কথা আছে যে সাহিত্যে বা যে কোন ক্ষেত্রেই কেউ যদি নতুন কিছু লেখে বা বলে, তার খুব নিন্দা হয় এবং পরে তার মতো অনেকেই করে। মেয়ে হিসেবে প্রতি পদে শেকলের ভেতর দিয়ে আমার যতটুকু হাঁটতে পারার কথা ছিল, তার ১/১০০০ ভাগও হাঁটি নি- তবু সেইটুকু হাঁটা পথই অন্যদের বহু পরে হাঁটতে দেখি। ১৯৯৭-এ গারোদের নিয়ে আমার  দীর্ঘ গল্প ‘ব্রিংনি বিবালে’র পর কতজন যে ঐ বিষয় নিয়ে- মান্দি সংস্কৃতি কিম্বা বিউটি পার্লার নিয়ে লিখলো! ২০০৬-এ রাখাইনদের নিয়ে আমার অসমাপ্ত উপন্যাস ‘ধান্যবতী কথা’র পর এখনো দেখি কেউ কেউ হয়তো রাখাইন এলাকায় যাচ্ছেন- ৬০টি রাখাইন পরিবারের সাথে মিশেছিলাম তখন—তবে, অত সহজ নয় ভিন্ন জনগোষ্ঠিকে নিয়ে লেখা। আমার যেমন নারী হিসেবে অনেক শেকল, মধ্যবিত্ত পুরুষ লেখকেরও অনেক শেকল। দিনের শেষে সবাই আমরা রাজধানীতে থাকি। তিন মাসে ছয় মাসে দু’দিন গিয়ে- কিম্বা পনেরো দিন, এক মাস থেকে বা কাজ করে এসেই কি আর তেমন লেখা যায়? ২০০৫-এ ‘বানিয়ালুকায়’ ৬৬ পাতার বড় গল্প ‘আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা’ লিখেছিলাম সাঁওতাল এলাকা নিয়ে। তবু, বড় উপন্যাস হলো কই?

চা শ্রমিকদের নিয়ে আপনার কাজ আছে, । মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আপনার “আপৌরষের একাত্তর” তো সাড়া ফেলেছিল। এই ধরণের আর কোন বিশেষ কাজ করার পরিকল্পনা আছে আপনার…

তেমন কাজ কই আমার? চা শ্রমিকদের নিয়ে একটা গল্প আর একটা অণু গল্পই লিখেছি অদ্যাবধি।  উপন্যাস তো আজো বড় আকারের বা পূর্ণাঙ্গ কোন কিছু নিয়েই লিখলাম না। সব মিলিয়ে সত্তরটির মত গল্প, ৬০০ কবিতা বা কিছু অনুবাদ ছাড়া আমার কাজ কি? অল্প কয়েকটি প্রবন্ধ আর শিশু-কিশোরদের জন্য এক/দু’টো লেখাও হয়তো আছে আমার। আর কি? ২২ জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে লেখা ‘অপৌরুষেয় একাত্তর’ নিয়েও শুরুতে বিদ্রুপ সয়েছি। ‘অপৌরুষেয়’ অর্থ ঐশ্বরিক- দেশমাতৃকার জন্য পুরুষত্ব হারিয়ে যারা আসলে ডিভাইনিটি পেয়েছেন। তা’ কেউ কেউ টিটকিরি দিল আমি মুক্তিযোদ্ধাদের ‘অপুরুষ’ বলেছি। এত অশিক্ষিত আর প্রতিহিংসাপরায়ণ আমাদের সাহিত্যিক সমাজ যে বলার নয়। কাজ অনেকই করতে চেয়েছি। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক পরিবারগুলো নারী লেখকদের সবচেয়ে বড় শত্রু। কিম্বা আমারই দৃঢ় সঙ্কল্পের ঘাটতি আছে। আমিও হয়তো লেখার জন্য বাসায় চার থেকে বিশ বছরের বড় সাত ভাই-বোনের টানা নিষেধাজ্ঞা (ছাপার অক্ষরে আমার নাম তারা স্নেহ করে- লেখার জন্য হাওর বা পাহাড়ে যাওয়া তারা ঘৃণা করে)-কে অমান্য করে, সাহিত্যের জন্য দরকারে চিরতরে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হবার মত অতখানি স্থিরচিত্ততা ঘটাতে পারিনি। কাজেই আর কি?

বর্তমান বাংলা গল্প নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী। মানে কেমন এগুচ্ছে? ভবিষ্যতটা কী?

এক কথায় বললে কেউ কেউ বিষয়বস্ত নিয়ে পরিশ্রম করছেন আবার ভাষা বা সফিস্টিকেশন খুব আয়ত্ত্ব না। আবার কারো ভাষা বা সফিস্টিকেশন খুবই আয়ত্ত্ব তবে বিষয় গতানুগতিক। তবে, আমি সব মিলিয়ে আশাবাদী।

আপনার অনুবাদ আর কথা সাহিত্য দুইটাই সমানতালে চলছে। কোনটার পাল্লা ভারী হচ্ছে মনে করেন…

এবছর করব না করব না ভেবেও অন লাইন পত্রিকা ‘তীরন্দাজ’-এ বিশিষ্ট জার্মান সমাজতন্ত্রী নেত্রী ও তাত্ত্বিক রোজা লুক্সেমবার্গের একটি রচনা সঙ্কলণ অনুবাদের কাজ শুরু করেছি। দুই কিস্তি প্রকাশিত হয়েছে। আরো দুই কিস্তি জমা দেয়া আছে। ঈদ সংখ্যার ব্যস্ততায় ও দু’টো এখনো প্রকাশ হয়নি। তবে, বেশি অনুবাদ মৌলিক লেখার কিছু ক্ষতি তো করেই। আসলে রোজার কাছে আমার ব্যক্তিগত দেনা আছে। ১৯৯২-এ ‘নন হজক্যান্স লিম্ফোমা’ ক্যান্সারের তৃতীয় স্তর শনাক্ত হয়েছিল। আট মাস যুদ্ধের পর ১৯৯৩-এ বেঁচে ফিরলেও তার প্রতিক্রিয়া শুরু হয় আমার পায়ে- ১৯৯৪ সাল নাগাদ। ১৯৯৫-এ পায়ে দু’টো সার্জারির পরও ১৯৯৬ সাল নাগাদ বুঝে যাই আমার হাঁটা ঠিক আগের মত আর কোনদিন হবে না। এসময় রোজা লুক্সেমবার্গের উপর একটি জার্মান সিনেমা দেখে আমি উদ্দীপিত হই। শৈশবে একটি অসুখে রোজাও ‘লেইম ডাক’ হয়ে গেছিলেন। নিজেকে তিনি ‘লেইম ডাক’ বলতেন। তা’ সেই লেইম ডাক কত শত মাইল পথ মিছিল করলেন, জেলে গেলেন, লিখলেন, সাজগোজ করলেন, একদিন মরেও গেলেন নাজিদের গুলিতে! ছবিটি আমাকে সাংঘাতিক সাহস দিয়েছিল। রোজার অনুবাদ তাই আমার ব্যক্তিগত দেনা শোধ।

একজন নারী হিসেবে এই শহরে (ঢাকায়), এই দেশে কেমন আছেন এখন?

আমাদের একটা জীবন আমরা তা-ও কাটিয়ে গেলাম। চিন্তা করি পরের প্রজন্ম নিয়ে। শিশু ধর্ষণের উদ্বেগজনক বৃদ্ধি আশঙ্কাগ্রস্থ করে। শিশু পূজার কথা ভাবুন। মসজিদের মেঝেতে একাধিক ধর্ষিতা শিশুর কথা ভাবুন। এসব নিয়ে কোন কথা নেই-অদ্ভুত।

এই ধারাবাহিক ধর্ষণ আর সংখ্যালঘু নির্যাতন- এসবের পেছনে কারণটা কী? কারা দায়ী বলে মনে করেন?  আমরা কী এগুচ্ছি না পেছনের দিকে হাঁটছি… অনলাইনে আপনাকে সরব দেখা যায়। বিশেষত যে কোন ধর্ষণ কিংবা সংখ্যালঘু নির্যাতনের পর। এই যে আপনি এইরকম প্রতিবাদী হয়ে উঠেন এই স্পৃহাটা কোত্থেকে আসে?

যে কোন রাষ্ট্র বা সমাজের মানব উন্নয়নের সূচকটা বোঝা যায় সেখানকার নারী ও সংখ্যালঘুর সার্বিক হাল থেকে। আমি জানি না আমাদের দেশটা কতখানি ‘ধৃত-রাষ্ট্র’- কবে তিমির প্রহর কাটবে! ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারের পর স্বাভাবিক ভাবেই জামাত-বিএনপি পক্ষ হাজার হাজার মন্দির বিনাশের কাজে নেমে পড়ে। এখন এটা যদি ভারত বা চীন হতো আর হাজার হাজার মসজিদ ভাঙা হতো, আমি বোধ করি একইভাবে রি-এ্যাক্ট করতাম। যেটা দু:খজনক যে দেশের নানা প্রত্যন্ত এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাও সংখ্যালঘু সম্পত্তি লুট, মন্দির বা শ্মশান দখল সহ নানা দুষ্কর্মে লিপ্ত। এসবের কোন আশু প্রতিকারের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। প্রতিবাদ তো করতেই হয় যতক্ষণ আমরা মানুষ। আর অনলাইন একটা সুবিধা দেয় কি যে না হলাম আমি খুব বড় কেষ্ট-বিষ্টু- একটা ফেসবুক একাউন্ট থেকে ঝটিতি আমার কথাটা আমি বলতে পারি। এই যা।

ইত্তেফাকের একটা ফিচারে দেখলাম আপনাকে নারীবাদী লেখিকা বলা হয়েছে! আপনি কি তাই?

ইত্তেফাকের কোন ফিচারে বলা হয়েছে বা কবে আমি দেখি নি। দেশে বা গোটা পৃথিবীতেই- এই পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতায় আজো মেয়েদের সামগ্রিক যা হাল- তাতে যেকোন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই নারীবাদী হবেন। তার জন্য এমনকি লেখক হবারও দরকার নেই।

চাকরি করছেন, অনুবাদ করছেন  সাথে গবেষণাও আর মৌলিক লেখা তো চলছেই। এতোটা পরিশ্রম করেন…কিভাবে সম্ভবপর করে তুলেন?

না, গবেষণা আর করছি কোথায় এখন তেমন? চাকরি, অনুবাদ আর মৌলিক লেখা চলছে অবশ্য। তবু কতটুকুই বা কি করতে পারি? মাঝে মাঝে মনে হয় দিনটা ৪৮ ঘন্টা হলে ভাল হতো। পরিশ্রম করতে আমার ভালই লাগে। অনেক মানুষকে দেখি দিনে মোবাইলে কথা বলে এবং অন্যকে ফোন করে বিরক্ত করে, অফিসে কাজের সময়ে অন্যের কাজের কক্ষে গিয়ে আড্ডা জমিয়ে কিম্বা ফেসবুকে ইনবক্সে কত যে সময় নষ্ট করে ও করাতে চায়! আমি এসব বিষয়ে দিন দিন কঠোর হচ্ছি। জীবন একটাই। তাই বলে মানবীয় বন্ধুত্ব বা আদান-প্রদানকে ছোট করছি না। একটা সময় আজিজে রোজ সন্ধ্যায় আড্ডা দিতাম। এখন বুঝি কি ভয়ানক অপচয় ছিল! মাঝখানে কয়েক বছর ফেসবুকে খুব সময় দিয়েছি। সেটাও কাটাতে চাইছি। দিনে-রাতে মিলিয়ে দু/তিন ঘণ্টা থাকছি এখন। চেষ্টা করবো আরো কমাতে। মানুষের অসাধ্য কি?

পড়লেন আইন কিন্তু পেশা হিসেবে তো বেছে নিলেন না। মানবাধিকার, সাংবাদিকতায় আর সাহিত্যে লেগে গেলেন। এখন তো বাংলা একাডেমিতে আছেন। এইটাই কি পরিকল্পনা ছিল যখন স্কুলে কিংবা কলেজে পড়তেন?

আইন আসলে পড়তেই চাইনি। নৃ-তত্ত্ব পড়তে চেয়েছিলাম। বড় বোনের কথায় পড়লাম। ভাল লাগেনি একদম। তাই পেশা হিসেবে নিইনি। একাডেমিতে কাজ করব এটা দেড় বছর আগেও ভাবিনি। জীবনের গতি অনেক সময় আমরা আগে থেকে জানি না বা নির্দ্ধারণ করতে পারি না। আপাতত: আছি এখানে। দেখা যাক।

মানবাধিকার ও নারী অধিকার নিয়ে তো কাজ চলবে…

(হাসি)- কি বা করছি? কতটুকুই বা করতে পারছি? এই মহাবিশ্ব বা মহাপ্রকৃতি যতদিন কর্মক্ষম রাখে বা রাখবে, সাধ্যমতো কিছু করার চেষ্টা করে যাব।

উইমেন ওয়ার্ডসের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন সবসময়।