চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ড্রতে ‘বাংলাদেশি’ নারীর কীর্তি - Women Words

চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ড্রতে ‘বাংলাদেশি’ নারীর কীর্তি

বৃহস্পতিবার রাতে টিভি সেটের সামনে বসে উয়েফার বর্ষসেরা পুরস্কার বিতরণী ও উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ড্র অনুষ্ঠানটা নিশ্চয় দেখেছেন? অনুষ্ঠান দেখে থাকলে উপস্থাপিকার প্রতি চোখ আটকে যাওয়ার কথা! কালো ড্রেস, মাথা ভর্তি কালো চুল, মিষ্টি চেহারার সুন্দরী উপস্থাপকিাকে দেখে কী দেশি দেশি মনে হয়েছে?

মনে হোক বা না হোক, মোনাকোর পুরস্কার বিতরণ ও ড্র অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য আর আকর্ষণ বৃদ্ধি করা সুন্দরী উপস্থাপিকা একজন ‘বাংলাদেশি’ই।

‘বাংলাদেশি’ মানে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। তার জন্ম ১৯৭৭ সালে, ইংল্যান্ড প্রবাসী বাংলাদেশি মুসলিম পরিবারে। বাবা-মা দু’জনই বাংলাদেশি। তো বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই নারীই উয়েফার পুরস্কার বিতরণ ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ড্র অনুষ্ঠানে গড়ে ফেললেন অনন্য এক কীর্তি। করে ফেললেন ‘হ্যাটট্রিক’।

এ নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ড্র অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করার কৃতিত্ব দেখালেন তিনি। এক ম্যাচে কোনো ফুটবলার ৩ গোল করা বা টানা ৩ বলে ৩ উইকেট নেয়া নয়, যেকোনো কিছু টানা তিনবার করা মানেই হ্যাটট্রিক। কোনো দল টানা তিনবার কোনো টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতলেও যেমন বলা হয় হ্যাটট্রিক শিরোপা। সেই হিসেবে একটা অনুষ্ঠানের টানা তিনবার উপস্থাপনা করা তো হ্যাটট্রিকই!

রেশমিন চৌধুরী নিজেই নিজের কীর্তিকে ‘হ্যাটট্রিক’ নাম দিয়েছেন। পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে যাওয়ার আগে আগে টুইট করেন, ‘আজ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ড্র। আমি গর্বিত যে, আমি হ্যাটট্রিকের দোরগোড়ায়।’

অনুষ্ঠানও শেষেও উয়েফাকে ধন্যবাদ জানিয়ে টুইট করেন, ‘চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মতো মর্যাদাপূর্ণ অনুষ্ঠানে আমাকে ফিরিয়ে আনা এবং উপস্থাপনার দায়িত্ব দেয়ায় উয়েফাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।’

ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে পুরো ইউরোপেই রেশমিন চৌধুরী ব্যাপক পরিচিত এবং জনপ্রিয়। সৌন্দর্য, মোহনীয় বাচনভঙ্গি এবং বিভিন্ন ভাষায় দক্ষতার কারণে ক্রীড়াবিষয়ক অনেক অনুষ্ঠানেই উপস্থাপনার ডাক পড়ে তার। ইংরেজি, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ- এই তিন ভাষাতেই সমান দক্ষ রেশমিন। বাংলাদেশি হিসেবে বাধাহীনভাবে বলতে পারেন বাংলাও।

উপস্থাপনায় বিশেষ দক্ষতার সুবাদেই ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো উয়েফার বর্ষসেরা পুরস্কার বিতরণ ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ড্র অনুষ্ঠানে ডাক পড়ে তার। প্রথমবারেই বাজিমাত করেন রেশমিন চৌধুরী। সেই সুবাদে ২০১৮ সালের পর এবারও উপস্থাপনার জন্য তারই ডাক পড়ে।

অবশ্য তিনি একাই নন, কাল তার সহ-উপস্থাপক ছিলেন পর্তুগালের জনপ্রিয় উপস্থাপক পেদ্রো পিন্টোও। তবে উপস্থাপনায় মূল আলোটা কেড়েছেন ‘বাংলাদেশি’ রেশমিনই।

পুরস্কার বিতরণ শুরুর আগেই যেমন মঞ্চের সামনের সারিতে বসা তিন পুরস্কারপ্রার্থী ভিরগিল ফন ডিক, লিওনেল মেসি এবং ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর সঙ্গে বসে আড্ডায় মেতে উঠেন রেশমিন। নেন সাক্ষাৎকারও। সাক্ষাৎকারের নামে মেসি-রোনালদোরদের মজার মজার কিছু প্রশ্নও করেন তিনি। যেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে না হেসে পারেননি মেসি-রোনালদো-ভিরগিলরা।

মেসি-রোনালদোর সঙ্গে এমন হাসি-ঠাট্টার আড্ডায় আগেও বসেছেন রেশমিন। ২০১৭ সালে যখন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ড্রয়ের প্রথম উপস্থাপনা করেন রেশমিন, সেবার উয়েফার বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কারটা জিতেছিলেন রোনালদো। প্রথম রানারআপ হয়েছিলেন মেসি।

তবে রোনালদোর সঙ্গে রেশমিনের পরিচয় তারও অনেক আগে থেকে। ২০০৯ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছেড়ে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেন রোনালদো। ঠিক তার পরের বছরই রিয়াল মাদ্রিদ টিভিতে যোগ দেন রেশমিন। রিয়াল মাদ্রিদ টিভিতে কাজ করার সুবাদে রোনালদোর সঙ্গে অনেকবারই কথা, আড্ডা হয়েছে তার।

রিয়ালের স্টেডিয়াম এস্তাদিও সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে দাঁড়িয়ে একে অন্যের কাঁধে হাত রেখে ছবিও তুলেছেন তারা। যে ছবি এখনো শোভা পাচ্ছে রেশমিনের টুইটারে।

শুধু মেসি-রোনালদোই নন, ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক ডেভিড বেকহাম, ফরাসি মহানায়ক জিনেদিন জিদানসহ বিশ্ব বরেণ্য অনেক কিংবদন্তি ফুটবলারের সঙ্গেই অন্তরঙ্গতা আছে রেশমিনের। বেকহাম-জিদানসহ অনেকের সাক্ষাৎকারও নিয়েছেন তিনি। বলা যায়, ক্রীড়া সাংবাদিকতার দক্ষতা আর মোহনীয় উপস্থাপনার মধ্যদিয়ে ৪১ বছর বয়সী এই ‘বাংলাদেশি’ নারী একজন কিংবদন্তিই হয়ে উঠেছেন।

যুক্তরাজ্যের বার্থ বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে স্নাতক করেন রেশমিন। এরপর ২০০৩ সালে হার্লো কলেজ থেকে সাংবাদিকতার ওপর স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা করেন। ছাত্রী জীবনেই বিশ্বখ্যাত রয়টার্স টিভির নিউজ হেল্প ডেস্ক অপারেটর হিসেবে কর্মজীবনের শুরু।

এরপর কখনোই তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৬ বছরের পেশাদার ক্যারিয়ারে কাজ করেছেন রয়টার্স টিভি, বিবিসি, বিটি স্পোর্টস, ব্লুমবার্গ, আইটিএন, রিয়াল মাদ্রিদ টিভির মতো বিশ্বখ্যাত সব প্রতিষ্ঠানে।

বিবিসি ও বিটি স্পোর্টসের হয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ কভার করা রেশমিন অলিম্পিকের মতো টুর্নামেন্টও কভার করেছেন। ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকার হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন ক্রীড়াঙ্গনের শীর্ষ ৫০ নারী বাছাইয়ের বিচারক হিসেবেও।

ব্যক্তিগত জীবনে রেশমিন দুই সন্তানের জননী। স্বামীর নাম আসিফ। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত হলেও তার বাবা-মা ঠিক কোন জেলার বাসিন্দা, সেটা জানানো যায়নি। নিজের প্রোফাইলে রেশমিন শুধু নিজেকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত পরিচয়টাই দিয়ে রেখেছেন।

যে জেলাই হোক, তিনি ‘বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত, এটাই বড় কথা। একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মেয়ের উয়েফার বর্ষসেরা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে উপস্থাপনার দায়িত্ব পালন করা, মেসি-রোনালদোদের মতো বিশ্বসেরা ফুটবলারদের হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া, আড্ডা, সাক্ষাৎকার নেয়া, বাংলাদেশি হিসেবে এটা আমাদের জন্য গর্বেরই।

সেই গর্ববোধ থেকেই সাত-সমুদ্র তের নদীর ওপাড়ের বাংলাদেশি-ব্রিটিশ সাংবাদিক-উপস্থাপিকা রেশমিনকে বাহবা জানাই। জয়তু রেশমিন চৌধুরী।