পাঠ্য পুস্তকে চাই যৌন শিক্ষা - Women Words

পাঠ্য পুস্তকে চাই যৌন শিক্ষা

ফজিলাতুন নেছা শাপলা

দেশে রোজ বিচ্ছিন্নভাবে ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও,সাম্প্রতিক সময়ে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশে বড় ধরণের তোলপাড় হয়ে গেল। সচেতন ও সুশীল সমাজের প্রত্যেকে এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন বিভিন্ন ভাবে। সামাজিক ও গণমাধ্যম গুলোতে ধর্ষকদের শাস্তি চেয়ে সবাই মাঠ গরম করে রেখেছে।টেলিভিশন গুলোতে ধর্ষণের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত হয়েছে একাধিক টক শো।কেন ধর্ষণ এত বেড়ে গেল অথবা নারীরা কারণে অকারণে কেন ধর্ষিতা হবেন, সেটি নিয়ে দিনরাত চলছে অনেক ধরণের গবেষণা।

কিন্তু সেই গবেষণার আড়ালে রয়ে যাচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেটি হল-আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় অর্থাৎ সরকারী স্কুল-কলেজগুলোতে যৌন বিষয়ক জ্ঞান বা sexuality education কে অন্তর্ভূক্ত করা। যৌনতা মানেই যে রগরগে কোন  ব্যাপার নয়, যৌনতা আসলে কোন অশ্লীল বা বীভৎস ব্যাপার নয়, সেটি শেখানো জরুরি। এটি যে ছেলে-মেয়েদের স্বাভাবিক বিকাশের একটি ধাপ সেটি কোনভাবেই আমরা প্রচার করতে আগ্রহী নই। ক্ষুৎপিপাসার মতই এটিও যে মানুষের সহজাতপ্রবৃত্তি সেটি স্বীকার করতেও আমাদের বিস্তর লজ্জা এবং সংকোচ। যৌন বিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের যৌনবোধ বিষয়টি যতটা না শারীরিক তার চেয়ে যেহেতু এটি বোধের বিষয় তাই অনেক বেশি মানসিক। অতএব, ছোটবেলা থেকে সঠিক যৌন জ্ঞান না থাকায় মনোবিকৃতির ফলে ধর্ষনের মত ঘটনাগুলো ঘটছে। যৌন বিষয়ক আলোচনা এখনও আমাদের দেশে ট্যাবু। বিশেষ করে বাবা-মা এবং শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাদের অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েদের সাথে কোনভাবেই যৌনবিষয়ে আলোচনা করেন না। এই রাখ-ঢাকের ফলে যা হচ্ছে, তা হল – ‘বনের বাঘের চেয়ে মনের বাঘ ভয়ংকর’ হয়ে উঠছে বেশি। অথচ খুব সহজেই আমরা সঠিক জ্ঞান প্রয়োগ ও চর্চার মাধ্যমে এই স্বাভাবিক প্রবৃত্তির উপযুক্ত উপস্থাপন করতে শেখাতে পারি। অবশ্য সে বিষয়ে এখনো আমাদের কোন পরিকল্পনা নেই।

আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েরা আসলে যৌনজ্ঞান লাভ করছে কিভাবে? প্রথমে বন্ধুদের সাহায্যে, তারপর আত্মীয়-পরিজন, বড়দের কানাকানি-লজ্জা, কিছুটা অস্পষ্টতা ও খানিকটা ইঙ্গিতের সাহায্যে। আর শেখে বই পড়ে অথবা বিভিন্ন চলচ্চিত্র বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে। খুব দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমাদের দেশের বেশির ভাগ সাহিত্য, যৌন বিষয়ক বই ও সিনেমাগুলো্তে এখন পর্যন্ত সব-সময়ই যৌন বিষয়গুলিকে খুব কামোদ্দীপকভাবে ও অশ্লীলভাবে উপস্থাপন করা হয়ে আসছে। আর ভুল ভাবে উপস্থাপিত যৌনতাকে সম্বল করে তরুণরা সেই বিকৃত যৌন বাসনার উপর রং ছড়িয়ে, কল্পনা মিশিয়ে; সেটিকে করে তুলছে, জীবন্ত। আর এভাবেই যখন তখন যেখানে সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, নারীর সাথে করছে অসভ্য ও অমার্জিত ব্যবহার। যৌনতাকে অশ্লীল ও বীভৎস করে তোলার ইন্ধন যোগাচ্ছে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কার এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। ত্রুটিযুক্ত এ রাষ্ট্র ব্যবস্থায় বাবা-মা, শিক্ষক, পুলিশ, বিচারক কেউ কখনই সঠিক যৌনশিক্ষা বা সঠিক যৌন জ্ঞান নিয়ে কথা বলছেন না বরং যৌন সম্পর্কটাকে রহস্যময় ও গোপণ করে রেখে এমনকি এ দেশের আইনকানুন ও সব কিছুর মধ্য দিয়ে প্ররোচিত করা হয়ে থাকে যে যৌনতা ভীষন বীভৎস এবং অশ্লীল ব্যাপার।

আমাদের সমাজে কেউ স্বীকার করতেই চায়না যে অহেতুক লজ্জা, অস্বস্তি এবং গাদা গাদা নীতিজ্ঞান, ধর্মের ভয় দেখিয়ে কিন্তু এ দেশে যৌন বোধকে থামিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি আর হবেও না। বরং যৌন বিজ্ঞানীরা বলছেন, যৌন বিষয়ে গোপনীয়তার চেয়ে স্পষ্টতা আমাদের ঢের বেশি কল্যান সাধন করবে। তাই বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশে স্কুল এবং কলেজে যৌনশিক্ষা অবশ্যপাঠ্য হিসেবে পড়ানো হচ্ছে। অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েদের জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

অল্প বয়সে যৌনবিজ্ঞান বা যৌনতা বিষয়ক শিক্ষাকে মূলতঃ সারাজীবনের জন্য প্রয়োজনীয় শিখন প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ছেলে-মেয়েরা শিখবে, যৌনতা বিষয়ে তাদের মনোভাব, বিশ্বাস, মূল্যবোধ কেমন হওয়া উচিৎ। এ ছাড়া কারো সাথে সম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা তৈরি এবং সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারা কিভাবে নিজেদের সংবেদনশীল ও পরিমার্জিত করে গড়ে তুলবে, কি ভাবে সঙ্গী নির্বাচন করবে, ইত্যাদিও এই sexuality education এর মাধ্যমে শেখানো সম্ভব। খোদ আমেরিকাতে শুধু স্কুল কলেজে নয়, কিছুদিন আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্য পাঠ্য হিসেবে পড়ানো হত-বিয়ে কি?বিয়ে কেন জরুরি?কিভাবে সুন্দর দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করা যায়, ইত্যাদি।

আমাদের দেশে এসব কিছুই নেই, এমনকি ছেলে-মেয়ের স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরিতে আমাদের দেশে যৌন শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষারও কোন ব্যাবস্থা নেই। বয়ঃসন্ধির পর কৈশরে যখন ছেলে-মেয়েদের একে অপরের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে এবং একে অপরের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে চায়, ঠিক তখনই আমরা একটি ছেলে-মেয়েকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলি এবং তুলে দেই নানা বিধি নিষেধের আড়াল। কিশোর কোন ছেলে কোন সমবয়স্ক মেয়ের সাথে কথা বললে, তার জন্য বরাদ্দ থাকে কঠিন শাস্তি। নিষিদ্ধ গোপন বিষয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়াতেই যেন আমাদের নীতি নৈতিকতা সব ঢেলে দেই, অল্প বয়সের ছেলে-মেয়েদের উভয়ের প্রতি আকর্ষণকে প্রতিহত করতে। আমাদের দেশে পরিবারগুলো শুধু নয়,  স্কুল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে খুব ছোটবেলা থেকেই বিশেষভাবেই বুনে দেওয়া হয়,লিঙ্গ বৈষম্যের বীজ । নৈতিকভাবে আমাদের ছেলে-মেয়েদের কখনই জানানো হয়না যে শারীরিক এই পরিবর্তন গুলো অর্থাৎ একে অপরের প্রতি আকর্ষণ বাড়া অথবা শরীরে যৌন বোধের সঞ্চার হওয়া বড় হয়ে ওঠার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এতে করে ছেলে-মেয়ে আলাদা হবার মত কিছু ঘটেনি। আমরা বলিনা যে ছোট বেলায় তোমরা যেভাবে একসাথে খেলাধুলা বা লেখাপড়া করে বড় হয়েছ, এখনও সেরকমই আছ। ছেলেরা যেমন তোমরা একসাথে ফুটবল, হ্যাণ্ডবল, ভলিবল খেলতে পার, মেয়েদেরও খেলতে কোন অসুবিধা নেই। একটি ছেলে যদি সাইকেল চালাতে পারে, তবে তোমার বোন, বা মেয়ে বন্ধুটিও পারবে। তার বদলে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে শেখানো হয়- ছেলেরা যা পারে, মেয়েরা তা পারেনা। এ ব্যাপারে রাস্কিন (Ruskin)একটি দারুণ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, “সমবয়ষ্ক একটি ছেলে ও একটি মেয়ে যতদিন এক সঙ্গে খেলাধুলা করে, ততদিন তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য দৃষ্ট হয়না। হঠাৎ একদিন একজনকে ধরে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রের উজ্জ্বল আলোকময় রাজপথে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং অপরজনকে খেলাধুলার নামান্তর রান্নাঘরের অন্ধকার কক্ষে আবদ্ধ করা হয়। এঅবস্থায় তাদের জ্ঞানবুদ্ধির যে পার্থক্য দৃষ্ট হয়, তাকে ন্যায়ত জন্মগত বা প্রকৃতিগত বলা যায় না”। অথচ এ সময় থেকেই সামাজিকভাবে অথবা নীতিগতভাবে ছেলেদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যে পুরুষ শ্রেষ্ঠ। আসলে সমাজে এসব প্রচলিত ধারণার জন্যই অল্প বয়স থেকেই অপেক্ষাকৃত ছেলেরা হয়ে ওঠে স্বেচ্ছাচারী বিকৃত মনোবাসনার অধিকারী।

শিক্ষা ব্যাবস্থায় সেক্সুয়ালিটি ও মোরাল এডুকেশনের মাধ্যমে ছেলে-মেয়েদের শেখানো সম্ভব কি করে একজন সঙ্গী নির্বাচন করতে হয়, কোথায় কেমন যৌন আচরণ করা উচিৎ, নিজের যৌন আচরণের ওপর নিয়ন্ত্রন রাখা ইত্যাদি। ওদের বোঝানো সম্ভব যে শারীরিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে নারী-পুরুষের ভিন্নতা থাকলেও মনুষ্যত্বের দিক থেকে নারী-পুরুষ উভয়েই শ্রেষ্ঠ। এখানে জোর জবরদোস্তির কোন অবকাশ নেই। শেখানো যেতে পারে নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন আচরণটি করা আসলে আমাদের সমাজে প্রত্যাশিত। এর পাশাপাশি নারীদেরকে সম্মান করতে শেখানোটাও জরুরি। একটি বাড়িতে ছেলে সন্তান এবং মেয়ে সন্তানের গুরুত্ব সমান হওয়া উচিৎ।

যে পরিবারে পুরুষ তার স্ত্রীকে সম্মান করেন না, সেই পরিবারের ছেলেটি বাবাকে দেখে শিখছে-বাড়িতে তার মা’কে সম্মান না করলেও চলে, কারণ শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। পরিবার এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকেই ছেলে শিশুটি/কিশোর ছেলেটি/তরুণ অথবা প্রাপ্ত বয়ষ্ক পুরুষটি নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবছে বলেই, ঘরে ও ঘরের বাইরে কোন নারীকে সম্মান করতে শিখছেনা। অথচ গবেষণায় অনেক বিজ্ঞানীরাই একমত হয়েছেন যে, পুরুষের চেয়ে কম বয়সে নারীর জ্ঞান বিকশিত হয়।দয়া, মায়া, স্নেহ, প্রেম, সেবা, স্মৃতিশক্তি ও ভাবপ্রবণতায় নারী পুরুষের চেয়ে অধিকতর শ্রেষ্ঠ এবং মনুষ্যত্বের দিক থেকে এই গুণগুলো পুরুষের শারীরিক শক্তি, বুদ্ধি মেধা, চিন্তাশীলতা থেকে শ্রেষ্ঠতর। মানুষ হিসেবে নারী কোথাও শ্রেষ্ঠ আবার কোথাও কোথাও পুরুষ শ্রেষ্ঠ।কাজেই নারীর উপর পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের কোন সুযোগ নেই। জগতের কল্যাণের জন্য নারী-পুরুষ উভয়কেই সমান প্রয়োজন।

সঠিক যৌনশিক্ষা ও নৈতিকতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বদলে দিতে পারে বিকৃত মানসিকতা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে Relationships and sex education কে স্কুল কলেজ গুলোতে অবশ্য পাঠ্য করা হচ্ছে কারণ সেখানে বলা হচ্ছে, all young people should be entitled to high quality Relationships and Sex Education (RSE) in order to help children and young people learn about choice, control and consent so as to help them form strong and stable couple, family, social and professional relationships throughout their later lives.

আমি মনে করি, ধর্ষকামী সমাজের চালচিত্র বদলানোর জন্য সঠিক যৌনশিক্ষা একটি উপযুক্ত হাতিয়ার।

লেখক: কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট , শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

তথ্যসূত্রঃ যৌনবিজ্ঞান- ১  আবুল হাসানাৎ