ট্রাম্প ভাইকে দু'টো গালি দেওয়ার আগে... - Women Words

ট্রাম্প ভাইকে দু’টো গালি দেওয়ার আগে…

অদিতি ফাল্গুনী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলে একবার এক আফ্রিকান মেয়ে এলো। বেচারী কালো মেয়েটিকে অসংখ্য বাদামী মেয়ে মিলে কটুক্তি, উপহাস এবং এত রকমের অপমান করলো যে পরে সে পড়া ছেড়ে দেশে চলে গেল। এই আমরাই কি আমাদের ভাইয়ের বিয়েতে ‘ফর্সা মেয়ে’ খুঁজি না? ছেলের জন্য ‘ফর্সা বউ’ খুঁজি না? বেশি দূর যেতে হবে না। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার সাদা মা’কে ওবামার যে বর্বর, আফ্রিকান বাবা (ভাষার জন্য দু:খিত) আফ্রিকায় তার প্রথম বউয়ের কথা গোপন করে ওবামার মা’কে দিব্যি ‘ব্যবহার’ করে (ভাষার জন্য দু:খিত), একটি ‘সন্তান’ দিয়ে সারা জীবনের মত ভেগে গেল…এখন যদি কিছু সাদা ছেলে ক্ষেপে যায় ত’ তারা রেসিস্ট? আর আমরা খুব ভাল?

আমাদের এক পরিচিত দাদা এক উজবেক বৌদ্ধ নারীকে বিয়ে করে আনলেন। ১৯৮৭ সালের কথা। পরিচিত এই দাদা যদি পাঁচ ফুট দুই, উজবেক নারীটি পাঁচ ফুট আট। তাঁর বাবা স্ট্রোক করে মারাই গেলেন এমন ‘বেঁটে, কালো’ ছেলেকে তাঁর মেয়ে বিয়ে করবে ভেবে! তাসখন্দে পড়তে যাওয়া এই দাদা একবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে নার্স এই উজবেক নারীর সাথে পরিচয়। ভদ্রমহিলা শুরুতে পাত্তাও দেন নি। ভদ্রলোক লেগে থেকে থেকে মন জয় করেছেন। উজবেক নারীটি এদেশে এলেন। প্রথম এক বছর ভদ্রলোক বেকার। স্বামীর বড় ভাইয়ের সংসারে ঘর মুছে, বাসন মেজে দাসীর মত থেকেছেন। আমি তখনো স্কুলে। আমরা শিউরে উঠতাম। মা বলতেন, ‘বিদেশী মেয়েটাকে ওরা কাজের মেয়ের মত খাটায়।’ সেই ভদ্রলোকই বেশ কিছু বছর পর আর এক ‘তরুণী বাঙালী’ মেয়েকে বিয়ে করেন আর প্রৌঢ়া উজবেক নারী চলে যান ভাইদের কাছে। এখন তাঁর ভাইগুলো আমাদের ঘৃণা করলে কি বলবেন? রেসিস্ট?

আর এক পরিচিত বড় আপার (নাম নাই করি) ছোট ভাই আমেরিকা গিয়ে গ্রিন কার্ডের জন্য এক সাদা মেয়ে বিয়ে করল। মেয়েটি বাংলাদেশে এসে নামাজও পড়েছে ‘শ্বশুরবাড়ির’ সবাইকে খুশী করতে। তারপর? গ্রিন কার্ড পাবার পর বঙ্কিমের ভাষায় ‘অধম খ্রিষ্টিয়ানী’টাকে ছুঁড়িয়া ফেলিয়া সেই বাঙ্গালী ছেলে আর এক জন্মসূত্রে মুসলিম নারীকে বিয়ে করেছে। এখন যদি সাদারা বলে, ‘গো ব্যাক’- তাহলে তারা রেসিস্ট?

‘আইন ও সালিশ কেন্দ্রে’ কাজ করার সময় বৃটেনে বড় হওয়া এক বাঙ্গালী মেয়ে রিপা বেগমের কেস স্টাডি এলো। নামটা বদলে দিলাম। মেয়েটির সাথে এক আঠারো বছরের সাদা ছেলের প্রেম। মেয়েটির বয়স ১৬। মেয়েটির সিলেটি বাবা ও ভাইরা সেই সাদা ছেলের এক কামরার ফ্ল্যাটে গিয়ে তাকে পিটিয়ে, হাড় ভেঙ্গে রিপাকে সিলেট নিয়ে আসে কোন অশিক্ষিত কাজিনের সাথে বিয়ে দেবার জন্য। রিপা বোধ করি গর্ভবতী হয়ে পড়েছিল। তাকে এ্যাবর্শন করানো হয়। সাদা ছেলেটির একটি প্রেমপত্রও ছিল। আঠারো বছরের ছেলে। টাকা- পয়সা নেই। ‘আই এ্যাম পুওর রিপা বাট আই লাভ ইউ।’ করুণ ও সরল চিঠি। মাস্টার্স পরীক্ষা শুরুর আগে বাবার কথায় চাকরি ছেড়ে দেবার কারণে সেই কেস স্টাডির পরিণতি আর জানা হয় নি। অথচ এই বৃটেনেই প্রতি বছর ১,০০,০০০ সাদা খ্রিষ্টান মেয়ে ‘মুসলিম’ হচ্ছে প্রেমের বিয়ের কারণে যাদের গড় বয়স ২৭। সব অভিবাসী পুরুষই শয়তান তা’ নয়। তবে প্রচুর পাকিস্থানী, লিবীয়, আরব বা আফ্রিকান মুসলিম পুরুষই বিয়ের কিছুদিন পর ধর্মান্তরিত সাদা স্ত্রী ও মিশ্র শিশুদের ফেলে ‘দেশ’ থেকে ‘বিশুদ্ধ মুসলিম’ নারী বিয়ে করে আনেন। হতাশ এই সাদা নারী ও তার ‘মুসলিম’ সন্তানদের শেষ আশ্রয় হয় বৃদ্ধ ও সাদা খ্রিষ্টান মাতামহ/মাতামহী। যেহেতু পশ্চিমে শিশু জন্মের সাথে সাথেই তার নাম নিবন্ধন করতে হয়; মুসলিম পিতা ও সাদা খ্রিষ্টান মায়ের সন্তানদের ‘মুসলিম’ নামই হাসপাতালে রাখা হয়। কিছুদিন পর পিতাটি ‘বুড়িয়ে আসা’ বৌকে ফেলে দেশ থেকে ‘টাটকা’ কোন জন্মসূত্রে স্বধর্মী নারী বিয়ে করে আনেন। বুঝতে হবে এত ‘ভাল’ হয়েও জেমস করবিন কেন ভোট পায় না, কেন ট্রাম্প,মোদি জিতছে ? মোদি ত’ ভাল অবশ্যই না। কিন্ত পৃথিবীর অসংখ্য দেশের সংবিধানে কেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নেই…যেসব দেশে নেই, তারাই অন্য দেশের সংবিধানে এটা আশা করে কেন সেটাও ত’ বুঝতে হবে। প্রতিক্রিয়া ও অন্ধকারের উত্তরে অন্ধকার আসবে না? অবশ্যই আসবে।

ধরা যাক তুমি ভারতীয় উচ্চবর্ণ। একই গাত্রবর্ণের কিছু মানুষকে ‘পদবির’ হের-ফেরে মানুষ মনে করো না বলে নিজেই বলো (তোমাদের রাইটরা লুকো-ছাপা না করে বলে…অবশ্য সব রাইট না…কিছু রাইট বা মধ্যপন্থী ‘আইডেন্টিটি কার্ড’ খেলা ঘৃণা করেন বলে তাদের অবস্থান বরং সবচেয়ে উদার মনে হয় আর লেফটরা মিহি লিবারেল তানে বলে, সারাক্ষণই মানুষকে ‘আইডেন্টিটি’ ছকে ফেলে নাকি গীত গাইছে যাতে ভোট কমা ছাড়া বাড়ার সম্ভাবনা নাই…গত কয়েক বছরে ফেসবুকে ওপার বাংলার সাথে ইন্টারেকশনের ফল এই জ্ঞান) তাহলে ট্রাম্প তোমাকে কোলে নেবে কেন? তার কাছে তুমিও কালো, তুমিও অস্পৃশ্য! তুমি আফগান সুন্নী হয়ে শিয়া হাজারার বিয়ের অনুষ্ঠানে বোমা মেরে ৬৩ জনকে খুন করো আর সাদা বৃটিশকে তোমার পা ধুইয়ে দিতে হবে? কেন? তার কিসের দায়? কিসের ঠেকা? বাংলাদেশে আমি চাকমা বা কাদিয়ানীকে মানুষ মনে করব না আর থেরেসা মে’র বুঝি আমাকে ‘পুত্রবধূ’ হিসেবে বরণ করতে হবে? গড- হোয়াই? আমি বর্বর, পশ্চিমে গিয়ে তাদের গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে, বহু বিবাহ ও শিশু বিবাহ বৈধ করতে চাইব, পারলে হয়ত আমেরিকাতে ‘সতীদাহ’ও করতাম (১৯৮৫ সালেও রূপ কানোয়ার সতী হয়েছে) আর সাদা পুলিশ আমাকে গলা ধাক্কাতে এলে ‘রেসিস্ট?’

লেখাটা আপাত:দৃষ্টে খানিকটা সরলীকরণ হয়েছে আমিও জানি। এশিয়া, আফ্রিকার নানা দেশে সাদা উপনিবেশ, কালো মানুষকে ক্রিতদাস করা, বিপুল সম্পদ লুন্ঠন বা আজকের নব্য উপনিবেশবাদেও আমাদের সম্পদ পরোক্ষাভাবে পশ্চিমের হাতে থাকার তুলনায় পশ্চিমে অভিবাসীদের ‘অন্যায়‘গুলো হয়ত অত গুরুতর আজো নয়। তাই বলে ঢাকার আজিজ মার্কেটে বসে যে গল্পকার বলেন,‘সাদা মেয়েগুলোকে আমাদের কালো ছেলেদের গিয়ে তাদের পেটে কালো বাচ্চা রেখে আসা উচিত’…এটা অনুবাদে সাদা ছেলেরা জানলে তাদের কি খুব ভাল লাগবে? মিউচ্যুয়াল প্রেম একটা বিষয় আর কোন সম্প্রদায়েরই অন্য সম্প্রদায়ের নারীকে প্রতিশোধকল্পেও ঢালাও গর্ভবতী করার ভাবনাও ত’ ভয়ানক। ন’মাসের যুদ্ধে পাক সৈন্যরা কয় লাখ বাঙ্গালী নারীকে ধর্ষণ করেছে আর সেই তুলনায় ২০০ বছরে বৃটিশ খুব বেশি ভারতীয় নারী ধর্ষণ করেছে কি? আবার সিলেটের চা বাগানে ২০০১ সালেও মলিন ধূতি পরা, অসংখ্য ফ্রিকলস আর নীল চোখের প্রৌঢ় এক চা শ্রমিককে দেখে চমকে উঠেছিলাম এটাও সত্য।পশ্চিমে অভিবাসীদের ‘সস্তা শ্রম’ যেমন সত্য, পশ্চিমে কোনমতে অভিবাসন নিয়ে বছরের পর বছর বেকারত্ব ভাতা গ্রহণ, ক্রাইম সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়া, পোশাকে মুক্ত পশ্চিমা নারীকে ‘তাহাররুস’ খেলায় মলেস্ট করা থেকে ‘সাদা’ মেয়ে মানেই সহজলভ্য মেয়ে মনে করা, নারীঘটিত নানা অন্যায় করা অভিবাসীদের নিজেদের ‘ইমেজে’র জন্যও ক্ষতিকর। জানেন, ট্রাম্পকে একতরফা গালি দিয়ে কিচ্ছু হবে না যতদিন না আমরা আমাদের ভেতরের ‘ট্রাম্পকেও’ উচ্ছেদ করতে পারব! মোদিকে উচ্ছেদ করতে হলে আশপাশের ‘মোদিদের’ও নির্মূল হতে হবে। নাহলে প্যানপ্যান করেন আর করতেই থাকেন আর ‘প্রগতিশীল ক্লাবে’ বসে দশ জন মানুষ মিলে চা-বিস্কুট খান।