রক্তের রং লাল ই হয়… - Women Words

রক্তের রং লাল ই হয়…

প্রকৃতি বসু

দিনটা বেশ মনে আছে। মেঘলা আকাশ গুমরোচ্ছিল। কলেজছাত্রী আমি দাঁড়িয়ে অটোর অপেক্ষায়। সাইকেলে সাঁ করে এসে আমার গায়ে প্রায় ছুড়ে দিয়েই পালিয়েছিল সে। একটা টকটকে লাল গোলাপ।

বুকে লেগে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। তুলে নিয়েছিলাম, কিন্তু গ্রহণ করিনি। লাল রঙের একটা ফুল আমার হাতে। অদ্ভুত! হাতে একটা ফুল। কত আদরের। অথচ, তাকে বুকে আগলে নিতে পারছি না। কুড়িয়ে নিয়েছিলাম কারণ, লাল ফুলটার কোনও দোষ ছিল না।

দোষ কি আমারও ছিল? এই যে গত পরশু বিকেল থেকে কোমরের কাছে ব্যথা। আজ সকালে ঘুম ভাঙতেই দেরাজ খুলেছি। জামাকাপড়ের ভিড় হাতড়ে লুকিয়ে রাখা নীল-গোলাপি প্যাকেট থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন বের করেছি। তার পরে ওয়াশরুমে গিয়ে শরীর চুঁইয়ে পড়া রক্তস্রোতের মুখে ঠেসে ধরেছি তাকে। রং? শব্দ খরচ অর্থহীন। লাল!

রক্তের রং তো লাল-ই হয়! ব্লাড ইজ রেড। সেই কোন ছোটবেলায় মাত্র এক বা দু’নম্বরের জন্য তিনটি শব্দ পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়েছিলাম, মনেও নেই। খেলতে গিয়ে হাঁটু কেটেছে, লাল রক্ত বেরিয়েছে। রান্নায় হাত পাকাতে গিয়ে বঁটিতে আঙুল কেটেছে, লাল রক্ত বেরিয়েছে। বাবাকে বলেছি। যত্ন করে মেয়ের রক্ত বাবা মুছে দিয়েছে। ওষুধ লাগিয়েছে।

অথচ যে দিন প্রথম শরীরের অপ্রত্যাশিত স্থান থেকে রক্তপাত হল, সে দিন বাবাকে বলতে বারণ করেছিল মা। বলেছিল, ‘কাউকে কিছু বলবি না। এটা হয়। আর শোন, ঠাকুরঘরে যাবি না একদম।’ ছোট্ট আমি কেঁদে বলেছিলাম, ‘মা, রক্ত! বাবাকে বলব না? ডেটল দেবে না বাবা?’ মায়ের সেই চোখ পাকানো দৃষ্টি আজও চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে। ভীষণ জীবন্ত।

বয়স আর শরীর একসঙ্গে বাড়তে থাকল। পোশাকের তালিকায় কখন যে লজ্জা ঢুকে পড়ল আর গোটা শরীরে সেঁটে বসল, বুঝতে পারিনি। ক্রমশ স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি– একের পর এক গণ্ডি ডিঙোলাম। বই, বন্ধু, প্রেমিক– আসা-যাওয়ার পালা লেগেই থাকল। থেকে গেল শুধু দু’জন। পিরিয়ডস আর লজ্জা। একে অন্যের পরিপূরক হয়ে। কাউকে বলতে পারলাম না, রক্তের রং লাল-ই হয়।

মা-কে বলতে শুনেছি, ‘ও সত্যনারায়ণে যাবে না গো, শরীর খারাপ হয়েছে।’ জেদ করেছি, ‘মা, আমি ভালো আছি তো!’ উত্তর পেয়েছি, ‘চোপ!’ চুপ করে গিয়েছি বিলকুল। পরে ক্রমশ জানলাম, আমিই ঠিক। সুস্থ আছি, ভালো আছি বলেই না পিরিয়ডস হচ্ছে নিয়মিত! তা হলে শরীর খারাপ হবে কেন? মা-ও তো জানত, আমি সুস্থ আছি। তা-ও কেন শরীর খারাপের এই আবডাল?

খারাপ শরীরে ঠাকুর ছোঁয়া দূর স্থান, পুজোর চৌহদ্দিতেই প্রবেশ মানা। মন্ত্র শুনি, ‘অপবিত্র, পবিত্রবা…’ সে মন্ত্র শেষে শুনতে পাই, ‘অভ্যন্তরে শুচি’। এ নাকি দেহ শুচি মন্ত্র। দেহ, শরীর, বায়োলজি, ফিজিওলজি, বিজ্ঞান, যুক্তি, ব্যাকটিরিয়া, রক্ত, লজ্জা– সব একপাতে। কে অপবিত্র? আমি? মা? ঠাকুমা? দিদা? দিদি? বন্ধু? দেহ শুচি মন্ত্র তবু আউড়ে যেতে হয়।

অথচ এই কানেই ঢুকেছে একেবারে অন্য ‘মন্ত্র’। ভালো লেগেছিল যখন কোনও পুরুষকেই বলতে শুনেছিলাম, ‘যত্তসব বাজে রীতি। প্রোটেকশন থাকলে আবার অশুচি কী! পুরোটাই হাইজিন আর সায়ান্স।’ সেই পুরুষ তখন আধুনিক যুগের অগ্রদূত। তবে কর্ণ এবং চক্ষুর বিবাদ যে তখনই লেগে গিয়েছিল, ঠাহর হয়নি। টিভির পর্দায় জেমস বন্ড-রূপী ড্যানিয়েল ক্রেগ কী প্রচণ্ড ঘুসোঘুসি করে চলেছে! রক্তের ফোয়ারা। এমনই এক বীরপুঙ্গবের চোখ আঠা দিয়ে এলইডি পর্দায় সাঁটা। বিজ্ঞাপন বিরতিতে তেলোয় রাখা চানাচুরের অবশিষ্ট মুখে চালান করে বাথরুমে। ফ্লাশের শব্দ এল কয়েক সেকেন্ড পরেই। ফিরে টিভির পর্দায় চোখ রেখেই সরিয়ে নিলেন। কেন, জিজ্ঞাসা করতে উত্তর এল, ‘এরা একেবারে যা-তা! কীসের বিজ্ঞাপন না হচ্ছে আজকাল!’

স্যানিটারি ন্যাপকিন। নীল তরল পদার্থ হিসেবে যেটা দেখাচ্ছে, সেটাই নাকি পিরিয়ডস। রক্তের রং নীল! ব্লু ব্লাড। ধমনীতে দৌড়চ্ছে। চুঁইয়ে পড়ছে। সব ব্লু ব্লাড। জেমস বন্ডেরও ব্লু ব্লাড। আধুনিক যুগের অগ্রদূত তখন যারপরনাই বিরক্ত। সব বলে দিচ্ছে এরা! কোন মাপের স্যানিটরি প্যাড পড়া দরকার, কোন প্যাডের অ্যাবজর্ব করার ক্ষমতা বেশি, কোন প্যাড পরে জিমন্যাস্টিকসেও পদক জেতা নিশ্চিত– সব। অথচ, প্যাডের গুণবিচারি হল নীল তরল। আহাম্মক আমি চিনতে পারিনি আমার পিরিয়ডের রং। নীতিবাগীশরা ঠিক করেছেন, পিরিয়ডের রং লাল দেখালে সেটা যৌনতা। সানি লিওনি বালুকাবেলায় বিভাজিকা উন্মুক্ত করে গড়াগড়ি খেলে সেটা স্বাস্থ্য। আফটার অল, এইডস বলে কথা! পিরিয়ডস-এর চেয়েও সাংঘাতিক ব্যাপার। কন্ডোম– যৌনতার মজাটা আছে, সাজাটা নেই।

তা হলে? রক্ত মানে টিআরপি নয়? বিলক্ষণ টিআরপি। খবরে, সিনেমায়, সিরিয়ালে সর্বত্র রক্তটা খায় ভালো। শুধু পিরিয়ডসের রক্তটাই যা বাজারে খায় না। সে রক্তদর্শন অশুচি। অথচ, এই পিরিয়ডের হিসেব কষেই না সন্তানধারণের পরিকল্পনা? ডেট মিস করার পরেই না চোখ জ্বলজ্বল করে জানতে চাওয়া হয়, ‘আর ইউ শিওর!’ শুচি তখন জানলা দিয়ে ভো-কাট্টা। নীল তরলেও আপত্তি দেখি না। তরলের রং লাল দেখালেই বা কী! সব শুচি।

কপাটে খিল দিয়েছিল মা। তার পরে আগল ভাঙতে পারিনি। ব্যর্থতা আমার। আমি পারিনি বলেই নীলে আপত্তি জানিয়ে চিঠি লিখিনি কোনও কর্তৃপক্ষকে। বলিনি, বন্ধ হোক ভণ্ডামি। পিরিয়ডসের রং লাল। সেটাই বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের ধর্ষণ করে কন্ডোমের বিজ্ঞাপনে যদি যৌনরোগ প্রতিরোধ ছাড়িয়ে সেক্সের সুখ তুলে ধরা যায়, তা হলেও পিরিয়ডসের রং নীলই থাকবে। ইহাই ভারত, ইহাই শুচি।

আমার পিরিয়ড হয়। আমি সুস্থ, তাই আমার পিরিয়ড হয়। এমনই একটি পিরিয়ডের ডেট মিস করার পরে আমার গর্ভে কারও আগমন-বার্তা পেয়েছিলাম। সে এখন ঠিক আমার সামনে স্টিকার সাঁটছে ফ্রিজে।

আর হ্যাঁ, আমার মেয়ে হয়েছে…

সূত্র: এই সময়