সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক ও তার কুকুরেরা (২) - Women Words

সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক ও তার কুকুরেরা (২)

নুসরাত নীলা

কুকুরের মতো প্রভুভক্ত প্রাণী আর হয় না বলেই না কি, কে জানে-কুকুরের চোখের কোণে যে কান্নার দাগ জমে তা যে কত মর্মন্তুদ হয় তা বোঝার হৃদয় যার নেই সে হৃদয়হীন, সীমার। কথামতো সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকের বাড়িতে পৌঁছে অনেক দামি কিছু পোশাক পেল কুকুর। নতুন কুকুরের আগমন উপলক্ষে সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক তাঁর বাড়ি নানারকম আলোতে সাজিয়েছিলেন। বিক্রি হয়ে যাবার ক্লান্তিতে সেদিন কুকুরটার শরীর ঝিমিয়ে আসছিল, সে সঙ্গে আরো ক্লান্তি ছিল দীর্ঘপথ ভেঙে প্রাচীন শেকল ছেড়ে নতুন শেকলে আসার! তবু কুকুর ঘুমাল না, ঘুম যতই তাকে টেনে ধরতে চাইল সে ততই যেন ব্যগ্র হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল মনিবের। কুকুরকে একদল চাকর-চাকরানি একথাল মাংস ডিনারে দিতে এলে তাদেরই কেউ একজন বলছিল, সখ করে আবার কুকুর কিনলেও মালিক আর কোনো কুকুরের সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমাবেন না। মালিকের পূর্বের কুকুরের অসুখের খবর জানা ছিল না, জানা ছিল না কী পণ করেছিলেন মনিব-তেজি, অহংকারে পূর্ণ এই সুন্দরী কুকুর এসমস্ত কথায় তখনও নাক উঁচু করে ভেবেছিল, তা হতেই পারে না। এই যে এই বিশ্বাস এই বিশ্বাসের ক্লান্তিতেই যেন সে আরো ঝিমিয়ে আসছিল। ‘সত্যি কি আজ রাতে আর মনিবের সঙ্গে দেখা হবে না-এই যে এত দামি পোশাকে এত দাম দিয়ে কেনা কুকুরকে কেমন দেখাচ্ছে তা জানার ইচ্ছাও কি হবে না মনিবের?’ রাত গভীর থেকে গভীরে গেলে তার বিশ্বাস জন্মাল-মনিব সত্যি আসছেন না! একজন সম্ভ্রান্ত ধনী ভদ্রলোক, সমাজে যার এত সম্মান, এত যার অর্থকড়ি-কুকুর যতই ভালোবাসুন-কুকুরের সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমানোর রুচি নিশ্চয়ই তাঁর নেই। গভীর রাতে নতুন কুকুরের ঘরে আলো দেখে সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক কী এক কৌতুহলে সেখানে উঁকি দিতে গেলে ঘরজুড়ে সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকের শরীর থেকে দামি কোনো সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়তেই নতুন কুকুরটা যেন চমকে কোন্ সুদূর থেকে জেগে উঠল। তার চোখে ক্লান্তি নেই যেন তখন। কুকুরের স্বভাবে মনিবের কাছে প্রায় ছুটে এল সে স্বভাবসুলভ কুইকুই অনেকটা বাচ্চা কুকুরের মতো কুইকুই আওয়াজে সে মনিবকে অধিকার করতে চাইল! সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকের প্রথমে যেটা মাথায় এল-তিনি বারবার কুকুরটার নাকের দিকে তাকালেন। বোঝার চেষ্টা চালালেন যদি প্রাচীন অসুখ হিসেবে এই কুকুরেরও সর্দির অসুখ হয়ে থাকে কোনো প্রসাধনই তা লুকাতে পারবে না; একটা প্রাচীন সর্দির ধারা কুকুরের নাক বরাবর রয়েই যাবে! তিনি অনেকক্ষণ ধরে সেই দাগই খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলেন। এই ভয় মনের মধ্যে খেলছিল, এবারও তিনি দেশি কুকুর কিনেছেন! সেদিন কোন্ আবেগে এই বিষয়টা তাঁর মাথা থেকে চলে গেছিল, হায়! বৃদ্ধ মায়ের কানে যদি কথাটা যায় আর পূর্বের মতো যদি এরও নাক দিয়ে শ্লেষ্মা ঝরে কোনো দামি জিনিস নোংরা করে-এই বৃদ্ধ বয়সে কুকুর পালার সখ নিয়ে মা এই ব’লে কথা শোনাতে ছাড়বে না-অজাত কুকুরের জন্য  লাখ টাকার পোশাক-মাংস কিনেছে অথচ বৃদ্ধ মা কতদিন বলেছে, তাঁর সবসময়ের সঙ্গী লাঠিটা বদলিয়ে নতুন আরেকটা লাঠি কিনতে-তিনি তা শোনেনতো নি এমনকী না কিনতে পারার কোনো সঠিক কারণ ব্যাখ্যা করে মায়ের কাছে ক্ষমা চান নি। কথাটা মিথ্যা। ভদ্রলোক ক’দিন আগেই মাকে নতুন লাঠি কিনে দিয়েছেন। বৃদ্ধ বয়সে মায়ের অপমানে আর পড়তে চান না-বারবার তাই খুঁজে দেখতে চাইলেন, নাকের কোথাও কোনো প্রাচীন দাগ মেলে কি না! না, একদম পরিস্কার নাক এমনকী নাকের চারপাশ পর্যন্ত। হাফ ছাড়লেন ভদ্রলোক-দীর্ঘ একটা শ্বাস নিতে গিয়েই হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন তাঁর কেনা নতুন পোশাকে কুকুরকে অপূর্ব লাগছে, মুহূর্তেই কুকুরের চোখ-মুখ থেকে ঝরে পড়া ভক্তিতায় মুগ্ধ না হয়ে পারলেন না। ইচ্ছে করছিল কুকুরকে খুব ক’রে জড়িয়ে ধরতে। পূর্বের মালিক এত কম দামে একে ছেড়ে দিবে ভাবতে পারেন নি। না দিয়েই বা কী উপায় যখন কুকুর বিক্রিই তার পেশা! আসলে কে সহজে কুকুর বিক্রেতা হতে চায় বলুনÑএকজন মানুষ কুকুর বিক্রি করছে, কুকুর বিক্রি মানুষের পেশা-এ শুনতেও যেন কেমন লাগে!

কুকুরের চোখ তখন প্রায় ভিজে গেছে। কুকুর হয়ে জন্মানোর অপরাধ সে খুব ভালোই জানে-এ নিয়ে তার কোনো আক্ষেপও ছিল না; নগরের পথে পথে যদি সে একাই ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেত খুব বেশি হট্টগোল বাধাত না। প্রভুভক্ততার তীব্র গুন নিয়ে সেও তার দু’হাত সামনে-বেশ কিছুটা দূরে প্রসারিত করে দিতে পারত। নগরের সৌন্দর্য রক্ষায় মানুষের পাশাপাশি কুকুরও পারে তার সমস্ত গুন নিয়েই সামনে দাঁড়াতে। পৃথিবী নামক গ্রহে তার মতো ভক্ত অনুরাগী তীক্ষ পাহারাদার আর কে আছে! নতুন পোশাকের একটু, হঠাৎ খসখস শব্দে ওই সময়ের পিনপতন নীরবতায় ছেদ পড়ল। এরপর ভদ্রলোক দীর্ঘ একটা হাই তুললেন। কুকুরের চোখের পানি আর ধরে রাখা সম্ভব না। বিক্রি হবার সময় নতুন মালিককে যে চোখে  দেখেছে-তার দৃষ্টির একটুও বদল হয় নি; নরম, হালকা সোনালি গায়ের লোম অভিমানে-কান্নায় তখন ফুলে ফুলে উঠছিল, ঠোঁটজোড়া ভেঙে ভেঙে যাচ্ছিল! একটু আওয়াজ তুলল সে- কুই। একবার যদি নতুন মালিক তার ফুলে ফুলে ওঠা লোমগুলোর গভীরে হাত বুলিয়ে দিত! নতুন মালিক আরেকটা হাই তুললেন তারপর ঘরের বড় আলো নিভিয়ে ছোট আলো জ্বেলে দিলেন। বললেন, ঘুমাও প্রভুভক্ত কুকুর। তারপর কেমন এক ছোট ছোট পা ফেলে এই দীর্ঘ ঘরটা পেরিয়ে গেলেন। প্রভুর পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতেই কুকুর তার দামি পোশাক খুলে ছুঁড়ে দিয়ে কান্নাভেজা গলায় বলল,“ও বৃদ্ধ প্রভু আমার-এ পোশাক চাই না, চাই না; আমাকে তুমি শিকল পরাও, আমাকে তুমি খাঁচায় বাঁধো-আজ, এই আজকের দিনে কি তুমি একবারও ভাবলে না তোমার পায়ের কাছে আমায় এক মুহূর্ত বসতে দেবার কথা? এ ব্যর্থতা আমি কী দিয়ে মেটাব? আমার ভক্তিরগুন তুমি কেন ছুঁয়ে দেখলে না!” হাউজিং এর এই সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকের সম্ভবত শেষ কুকুরের-সেই বিলাপ আমরা উপস্থিত থেকে শুনি নি তবে শুনেছিলাম ভদ্রলোকের মা পরদিন বিশ্বস্ত চাকর পাঠিয়ে খোঁজ নিয়েছিলেন-তাঁর ছেলে কুকুরের পেছনে কত টাকা-পয়সা খরচ করছে, প্রতিদিন কী পরিমাণ মাংস কুকুর ধংস করছে; কত দামি পোশাকই বা তার গায়ে চড়েছে! মনিবের মায়ের এইসমস্ত কূটকৌশলে মনে খুব ব্যথা পায় কুকুর, অপমানিত হয়। প্রথমরাতেই সে দামি পোশাক খুলে ফেলেছিল এরপর পুরোনো পোশাকেই চলাফেরা করছিল। মাংসের হিসাব রাখা হচ্ছে জানতে পেয়ে খাওয়া কমিয়ে দিয়েছিল; মানুষের তরফ থেকে আসা এইসমস্ত অবমাননা তার সহ্য হয় নি। তবু ভদ্রলোকের যত্নের অভাব ঘটল না। শুধু তিনি তার প্রতিজ্ঞা রাখলেন-নিজের ঘরে কুকুরকে জায়গা দিলেন না। কুকুরের জন্য মাংস, নতুন নতুন পোশাক, খেলনা এই যেমন- লাল,নীল বল কেনার বিরাম ছিল না। সমস্ত কিছু কুকুর হাত পেতে নিলেও-ওই অবমাননা, ওই ক্ষত সে এই দিয়ে ঢাকতে চাইল-নিজের জন্য বরাদ্দ মাংস, পোশাক বাড়ির কাজের লোক, দারোয়ানদের দিয়ে! এই দানের হাতের জন্য কাজের লোকেরা তাকে ভালোবাসা শুরু করেছিল কি না কে জানে! মাঝে মাঝে ভদ্রলোকের মায়ের হুংকার ভেসে আসতÑ“আস্পর্ধা দেখ, আস্পর্ধাÑআমার ছেলের অন্ন ধ¦ংস করে সে দাতা হয়েছে!” এইসমস্ত কথায় কুকুরের বেদনা গাঢ় থেকে গাঢ় হতে লাগল। এর সঙ্গে আছে ওই ব্যথাÑপ্রভু প্রথমরাতে তাকে একা ফেলে চলে গেছে দীর্ঘঘরটা ছেড়ে ছোট ছোট পা ফেলে; তার ফুলে ফুলে ওঠা সোনালি লোম সে অপমানে কেমন দমে গেছিল সেদিন! সেই সোনালি লোম এরপর আর তার রূপ খুলল না। সে ব্যথা, সে উপেক্ষা কিছুতেই ভুলতে পারছিল না কুকুর। দমে দমে মনে পড়ে যাচ্ছিল তার প্রভুভক্ততার মূল্যহীনতা! এতদিন সে বাড়ির সব থেকে বড় বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাহারার কাজ সারত। কাজ খুবই অল্প; হাউজিং এ রাত হলে নাইট গার্ডই পাহারা দিত। এছাড়া এখানকার সব বাড়িতেই দারোয়ান থাকে আর মালিকের মায়ের মতো মা যদি ঘরে ঘরে থাকে তাহলে মনে হয় অদূরে কুকুরের আর দরকার পড়বে না পাহারার কাজে। “অমন সৌখিনতার মুখে ঝাঁটা মারো”Ñবলেছিল ভদ্রলোকের মা একদিন!

সেদিন বিকেলে বড় দরজাটার দিকে চোখ দিয়ে বিমর্ষ মুখে টানা বারান্দায় বসে ছিল কুকুর। বাইরে ভুতুরে বাতাস বয়ে যাচ্ছিল। ওই বাতাসে কুকুরের মনে হচ্ছিল-প্রভু ছোট ছোট পা ফেলে চলে যাচ্ছে! দারোয়ান ভুল করে দরজা খুলে রেখে কোথাও গেছে কি? প্রভু কিছুক্ষণ আগেই ওই দরজা দিয়ে প্রাডো হাঁকিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেছেন। প্রভু উড়ে যাবেন সুইজারল্যান্ড। দারোয়ান নিশ্চই ওই সময় কারো সঙ্গে গল্প করতে গেছে দরজা খুলে রেখে।” কুকুর কিছুক্ষণ ঘেউঘেউ করে ডাকল। কারো সাড়া নেই। “বাড়ির চাকরগুলো গেল কোথায়? প্রভু চলে গেছে বলে তারা এবেলা কি ফুর্তিতে ঘুমিয়ে গেল?” কুকুর আস্তে আস্তে দরজা ছেড়ে হাউজিং এর রাস্তায় উঠে এল। চারপাশে ঘোলাটে দৃষ্টি নিয়ে দেখল- কেউ নেই, সুনসান রাস্তাটা। চাপ চাপ ব্যথা নিয়ে কুকুর হাউজিং এর রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল। যত পথ সে গেল মনে হলো,‘ সে বিশ্বাস ভংগ করছে! মালিক তাকে ঘরে রেখে গেছেন!’ কিন্তু না, অবাধ্য এক বেদনা, এই ঝিমিয়ে থাকা সোনালি লোম যা প্রভুর একটু ছোঁয়ায় জেগে যেত-তা যেন বলছিল-ওই পথে, ওই পথে যাও, আরো যাও! প্রভুর সামান্য এক ভুল যেন সবকিছু কেমন  দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছিল! কোথায় এখন প্রভু? এয়ারপোর্টে কি পৌঁছে গেছেন? নির্দিষ্ট বিমানে কি উড়ে গেছেন, না যান নি? যদি কেউ খবর দেয় তাঁকে ‘ কুকুর ঘরে নেই’ তিনি কি যাত্রা স্থগিত করে বাড়ি ফিরবেন?’ কী হতে পারে, না পারে তা নিয়ে অনেককিছুই ভাবল কুকুর। পরে নিজেই বলল, ‘আমিতো সামান্য কুকুর! ভক্তিরগুন নিয়ে ওই সামনে আরো কুকুর আছে-কিন্তু আমার বুকে যে ব্যথা!’ হাউজিং এর কোনো বাড়ির দরজা তখন খোলা ছিল। অনেকটা জ্ঞানশূন্য আর বেদনার নীল চোখ-মুখ নিয়ে কুকুর সেখানে যেন প্রায় উড়ে গেল! সে বাড়ির মালিকের কোনো কুকুর ছিল না। মালিকটার চেহারা কেমন লাল আর রাগিরাগি। এই মধ্য দুপুরে সূর্যের সমস্ত তেজ যেন ওই চোখে ঢুকে গেছে-বাড়ির লনে দাঁড়িয়ে তিনি গোলাপ গাছে পানি দিচ্ছিলেন। দুপুরবেলা গাছে পানি দেবার কী কারণ এ নিয়ে প্রশ্ন হতে পারে-কুকুরের কোনো প্রশ্ন ছিল না। ফুল ভালোবাসা এই বাড়ির মালিকের বুকের ওপর প্রায় উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়ল সে। এমন অদ্ভুত আর আকস্মিক আগমনে ভদ্রলোকের গাল আর ঠোঁট কেটে রক্তাক্ত হয়ে গেল কুকুরটার শক্ত হয়ে ঝিমিয়ে থাকা লোমের আঘাতে! এরপর হাউজিং এর সবাই জেনে গেল সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকের কুকুর আরেক ভদ্রলোকের লনে দরজা খোলা পেয়ে ঢুকে পড়েছে; তাকে আর কোনোভাবেই সেখান থেকে বের করা যাচ্ছে না। সে ভদ্রলোক ধনী কেউ ছিলেন না। তিনি ফুল ভালোবাসতেন, কুকুর নয়-তাঁর লন জুড়ে সে কথারই প্রমাণ মেলে। সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকের দারোয়ান, চাকর-চাকরানি এমনকী হাউজিং এর সবচেয়ে নিকট থানা থেকে পুলিশ এসেও কুকুরকে ওই বাড়ি থেকে বের করতে পারল না। ‘কী প্রমাণ আছে এই কুকুরের মালিক ওই সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক?’ প্রমাণ আছে, আছে ভদ্রলোকের কাছেই-কুকুরকে কেনার দালিলিক প্রমাণ নিজের আলমারিতে যত্ন রেখেছেন কিন্তু ততক্ষণে ওই ফুল ভালোবাসা ভদ্রলোকের গায়ে আছড়ে পড়ে প্রভুভক্ত কুকুর আঁচড়ে-কামড়ে দেয়ার আগেই তিনি সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে উড়ে গেছেন। সমস্ত জানতে পেলে ভদ্রলোক প্রায় কেঁদেই ফেললেন। “হায়! তবে সেই অভিশাপই সত্যি হলো প্রভুভক্ত কুকুরের ভক্তি তাঁর কপালে নেই, নয়ত কেন তাঁর কুকুর সামান্য ফুল ভালোবাসা ভদ্রলোকের লনে ঢুকে যাবে?” অপমানে নীল হতে হতে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন হাউজিং এ ফিরবেন না। তাঁর মা তাঁকে এই বলে গালি  দেবে-‘তুই এক কুত্তার বাচ্চা, খাওয়ালি মাংস; গেলোতো লাথি দিয়ে!’ বৃদ্ধা মা ঝাপসা দৃষ্টি নিয়ে হাতের ছড়িটা যেন ঘোরাতে লাগল; বনবন করে ঘুরতে শুরু করল সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকের মাথা। তবু সিদ্ধান্ত বদলে যাত্রা সংক্ষিপ্ত করে ভদ্রলোক হাউজিং এ ফিরলেন। ওই দিকে বাতাসে ভেসে আসতে লাগল মায়ের গালিগালাজ। বাড়িতে ঢুকে ভদ্রলোকের কুঞ্চিত হয়ে আসা চামড়ায় কুকুরের এই চলে যাওয়া ছুরি হয়ে বিঁধতে লাগল। তিনি যতটা পারলেন টানটান করে মেলে ধরতে চাইলেন চামড়া! মনে মনে বলতে থাকলেন, কোথায় ভুল হলো অভিমানি কুকুর আমার! তুলে রাখা কাগজ দেখিয়ে তিনি কুকুরকে ফিরিয়ে নিলেন। আগেই বলেছি, সে ভদ্রলোক ফুল ভালোবাসতেন, কুকুর না। অন্যের কুকুর নিজের কাছে রাখার কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিল না ভদ্রলোকের।

তখন কড়কড়ে দুপুর। লিভিংরুমে বড় ডিভানটায় শুয়েছিল কুকুর। সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক তাঁর সামনে বসা লোকদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে একবার কুকুরের দিকে তাকালেন। কুকুর প্রায় চোখ বুঁজে শুয়ে ছিল। কুকুরের শরীরের সোনালি লোমগুলো তখন বাতাসে দুলছিল। সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক অনেক করে চাইলেন উঠে গিয়ে কুকুরের ওই ফুলে ওঠা লোমে কিছুক্ষণ আঙ্গুল বুলিয়ে দিতে, বলতে ইচ্ছে হলো, শান্ত হও প্রভুভক্ত কুকুর আমার। কী এক সন্দেহ আর দ্বিধায় তিনি নড়তে পর্যন্ত পারলেন না। চোখ বন্ধ করে হুকুম দিলেন সামনে বসা লোকদের কাজে লেগে যেতে। হাউজিং এ আরেকটা বাড়ি বানাবেন আর সেখানেই থাকবে কুকুর। বললেন, নতুন বাড়িতে দারোয়ানের সংখ্যা আরো বাড়ানো হবে, চাকরবাকর থাকবে জনা দশেক! এই বাড়ি বিক্রি ক’রে দিবেন কারণ এর বাতাসে তাঁর অপমান ঝুলে আছে! এই বাড়ির সমস্ত লোকদের ছাঁটাই ক’রে দিলেন। ছাঁটাই হয়ে যাওয়া চাকররা যখন চোখের পানি মুছতে মুছতে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন কুকুর তার ডিউটির বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাদের কান্নার শামিল হয়েছিল আর ভেতরে ভেতরে কী এক অপরিনামদর্শী জেদ ফুলে ফুলে উঠছিল!

বড় বড় চেরাই কাঠ, ইট, সিমেন্ট-বালু, রডে ভরে উঠল হাউজিং এর এক ফাঁকা জায়গা। আমরা প্রাতঃভ্রমণে কী বৈকালিক বিহার কী সান্ধ্যভ্রমণে বের হলে দেখতে পেলাম বৃদ্ধ ভদ্রলোকের হুকুম কীভাবে তামিল হচ্ছে! তৈরি হতে থাকা সে বাড়ির দারোয়ানের মুখে জানলাম, এ বাড়িতে বেশিরভাগ জায়গায় কাঠ ব্যাবহৃত হবে-কয়েক লক্ষ টাকার কাঠ আমরা ইট-সিমেন্টর ঢালাইয়ের পর ওই তৈরি হতে থাকা হাড্ডিসার বাড়ির ছাদে রোদে শুকাতে দেখলাম। আর রাতদিন সেখানে আবাস নেয়া মিস্ত্রিগুলো শব্দ তুলে গেল-কখনো কাঠ কাটার শব্দ, কখনো টাইলস কাটার শব্দ শুনতে পেলাম আমরা। আমাদের বাড়ির বারান্দায়, কী ছাদে কখনো অলস চোখে কখনো উৎফুল্ল কৌতুহলি মন নিয়ে অনেকটা খাঁচার ছাঁচে ঘাড় সোজা করে দাঁড়াতে চাওয়া বাড়িটাকে দেখতে থাকলাম। এই বাড়ির সঙ্গে দিনরাত পরিশ্রম দেয়া লোকগুলো আর কখনো কখনো সে বাড়ির ছাদে কিছু উঠতি যুবক-যুবতিদের কী আলাপে মগ্ন দেখলাম। তারা কে বা কারা আমরা নিশ্চিত জানি না তবে ধারণা করলাম তারা হয়ত উঠতি কোনো ডিজাইনারÑবাড়িটাকে আরো সুন্দর করার চেষ্টা তারা চালিয়ে যাচ্ছিল। তারা কি জানত, বাড়িটা ঠিক কার জন্য তারা সাজাচ্ছিল? একদিন, অনেকপরে, ঠিক বছরের শেষে শেষে পাতা ঝরতে শুরু করলে-দূরদেশ থেকে এর গাছগাছালিতে যখন অতিথি পাখি উড়ে আসল একটা কী দুইটা তখন একদিন আমরা অই বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি-এতদিন যে মিষ্টি মিষ্টি আলো বাড়িটা তৈরি থেকে শেষ পর্যন্ত রাজকীয় করে রেখেছিল তা একে একে নিভে গেছে! বুঝলাম না আমরা এর পেছনে কী কারণ আছে। সকালে, খুব সকালে আমাদের ঘরের বাসি-পচা ময়লা ডাস্টবিনে ফেলতে বেরিয়ে শুনলাম ওই বাড়ির ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে এল! তাতে কিছু কুকুর কুকুর গন্ধ ছিল কি? যার জন্য এতদিন ধরে, এত অর্থ খরচ করে, এত শ্রমিকের শ্রমে প্রাসাদ গড়া হলো-দুটো দারোয়ান, দশখান চাকরবাকর-যার জন্য এত কিছু তার আগমনে সে প্রাসাদের আলো কেন নিভে গেল আমরা জানি না! মাঝে মাঝে একটা টিমটিমে আলো বাড়িটাকে আলো দিত। সে আলো কখনোই নিভত না কী দিনে, কী রাতে! আমরা শুনেছি বাড়িটাতে গোপন ক্যামেরা লাগানো আছে। ভেতরে কুকুর সেই স্বল্প আলোয় কখনো শুয়ে কখনো বসে সময় কাটায়। তাকে আর কিছু পাহারা দিতে হয় না কেননা তার পাহারাতেই নিযুক্ত এখন অনেকে! সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক যখন মাঝে মাঝে এ বাড়িতে বেড়াতে আসেন কুকুর তখনো তার একটি নির্দিষ্ট ডিভানেই চুপ করে বসে থাকে-মনিবকে তুচ্ছ অভ্যর্থনা জানাতেও যেন তার হাত-পা নড়ে না। চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে সে আর সেই বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে ওঠে-সে দেখে, মনিব বড় হল ঘরটা পেরিয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট পা ফেলে! মনিব যাচ্ছে, মনিব চলে যাচ্ছে আর কুকুর ছুড়ে দিচ্ছে দামি পোশাক হল ঘরে, ছুড়ে দিচ্ছে তার মাংসের থালা!