যে জলে আগুন জ্বলে - Women Words

যে জলে আগুন জ্বলে

ফজিলাতুন নেছা শাপলা

আমার পা জোড়া যেন শীতল হয়ে গেল। কি দারূন অনুভূতি।পায়ের কাছে তীব্র কলকল শব্দ করে জমে যাচ্ছে পাহাড়ি ঠাণ্ডা জল। জলের শরীরে আয়না। আমার দৃষ্টি জলের গভীরে। ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে পাথরের দোল খাওয়া দেখি। বড় বড় চোখের বুড়ো পাথর গুলোর গায়ে রোদ জলের ছায়া আর ছোট ছোট নুড়িগুলোর অবুঝ ভাসাভাসি।
মহানন্দার ওপারে আকাশ মাটি ছুঁয়ে সোনা রোদে হাসছে।
আমি ভেসে যাবার ভয়ে উঠে আসি।
রোদে তেতে থাকা, গরম মাটিতে পা পুড়ে যায়, আমি বাস্তবে ফিরে আসি। চোখ বুজলেই মহানন্দার জলে আমার চোখ ভরে যায়। সেদিন তোমার কি ভয়, পারে বসে চিৎকার
– ‘আর যেওনা। আর যেওনা। ভেসে যাবে যে…’
তুমি সাঁতার জানতে না। পানিকে তোমার তাই ভীষন ভয়। তাই নামোনি আমার সঙ্গে।
আমার ভীষন মন খারাপ হচ্ছিল, তোমার সাথে জলে নামতে পারিনি বলে কিন্তু মহানন্দা দেখে সব ভেসে গেল। নদী আমাকে ভীষন টানে। কি ভীষন আকূল করে টেনে নিয়ে যায়-অদ্ভূত তাইনা!
আমি পারে উঠে এসে, খরখরে রোদে- তোমায় বল্লাম, “একটা কবিতা শোনাবে? আমার পায়ে তখন জড়িয়ে আছে, নরম বালি।
তুমি আমার নগ্ন পায়ের পাতায় আঙ্গুল ছুঁয়ে বললে-
– যে কোন একটা ফুলের নাম বল
– দুঃখ ।
– যে কোন একটা নদীর নাম বল
– বেদনা ।
– যে কোন একটা গাছের নাম বল
– দীর্ঘশ্বাস ।
– যে কোন একটা নক্ষত্রের নাম বল
– অশ্রু ।
– এবার আমি তোমার ভবিষ্যত বলে দিতে পারি ।
– বলো ।
– খুব সুখী হবে জীবনে ।
আমি জোর করে তোমাকে থামিয়ে দেই, এসব কি? এত দুঃখের কবিতা পড়ছ কেন?
তুমি হাসলে- লাজুক গলায় বললে, না এমনি। প্রকৃতির খুব সুন্দর কিছু দেখলে-এই সুন্দর তোমাকে দেখলে, মাঝে মাঝে আমার কেমন মন খারাপ হয়ে যায়।
মনে হয়, যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলি…। মনে হয়, এই অসাধারণ জীবনটা যদি না থাকে!!
বলি, আমরা তখন খুব সাধারণ হয়ে যাব। এক জীবনে অসাধারণ হতে হবে, এমন তো কোন কথা নেই- তাই না!
দেখে নিও, খুব সাধারণ অভ্যাসে, প্রতিদিনের ছোট ছোট সাধারণ কাজে আমরা নিজেদের খুঁজে নেব।
বরাবর তুমি কম কথা বলতে। যা হয়, আমি বলি, তুমি শোন।
আমি বলি, কবিতা আসলে তোমার সাথে ঠিক যায় না। তুমি বরং অন্য কিছু বলো।
তুমি বললে, যদি কিছু না বলি, তুমি মাইন্ড করবে?
আমি হাসলাম।
তুমি আমার হাত ধরে চুপ করে রইলে।
বিকেলের রোদ মরে মরে মেঘের গায়ে মিলিয়ে গেল। সূর্যটা তার লাল চোখ নিয়ে একটু একটু করে মহানন্দায় ঝাঁপ দিচ্ছিল…ঠিক তখন তুমি আমাকে বললে, তোমাকে আমি একটা জিনিষ দেব। নেবে?
দাও-
দুহাত পাত।
তুমি আমার হাতের ভেতর কিছু নুড়ি দিলে। বললে, আমি তো গুছিয়ে কিছু বলতে পারিনা। এই নুড়িগুলো, আমার অনুভূতিগুলো তোমার কাছে জমা রাখলাম।
আমি বললাম, তোমার অনুভূতিগুলো কেমন? তুমি বললে বুঝে নিও।
এ জীবনে আর কিছুই বোঝা হল না আমার। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই অভ্যাসে অনভ্যাসে আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল অনেকগুলো বছর।
পাল্টে গেল অভ্যাস, জীবনের চালচিত্র, ভালোবাসাবাসি।
তুমিও দূরে কোথাও। খুব সাদাসিধে, ঘোর সংসারী। আমিও।
ঠিক অসাধারণ ভালোবাসাটা আর জমলো না। সেই দারুণ ভালোবাসারা ভেসে গেল মহানন্দার জলে।
আর সাধারণ আটপৌঢ়ে ভালোবাসা হয়ে গেল, নিত্যদিনের অভ্যাস। বাজারের চাল চিনি নুনের দামের মত রোজ রোজ তার ওঠানামা। জীবন হয়ে গেল মজে যাওয়া নদীর মত। অগভীর তার জল। তার ঘোলা জলে, বুকের গভীরটা ঠিক দেখা যায়না।

কিছুদিন হল, বাড়ি বদলেছি। নতুন বাড়ির ইন্টেরিয়রটা আমার নিজের হাতে করা। ঘর সাজাতে সাজাতে, পুরোনো একটা ফার্ণিচারের ড্রয়ার ধরে টান দিতেই, একটা লাল কাপড়ের পুটলি বেরিয়ে এল।
খুলে দেখি কতগুলো নুড়ি, একটা রঙ্গীন কাগজ দিয়ে মোড়া। কাপড়টা টুপুরের হাতে দিলাম। মনের ভেতর কোন বোধের জন্ম নিল না। শুধু মনে হল- এতদিন ধরে এই জঞ্জাল জমিয়ে রাখার কোন মানে হ্য় না। টুপুরকে খেলতে দিয়ে দিলাম। টুপুর সেটা পেয়ে মহা খুশী।
সাথে সাথে নিজের সম্পত্তি ভেবে ব্যাগে চালান দিয়ে দিল।
এরপর প্রায় দেখতাম, নুড়িগুলো নিয়ে ও খেলছে। একদিন আমাকে বললো মামনি, ওখানে ১০টা ছোট্ট ছোট্ট সুন্দর সাদা পাথর আছে, আর কালো একটা। কেন মামনি?
আমি এটা ওটা কাজের ফাঁকে বললাম- তুই কি আবার গুনেছিস নাকি? বলে সরে যাই।
আমার কিছু মনে পড়ে না। আমি রান্না করি, ঘর গোছাই, বাজার করি, বাজারের লিস্টিতে একটা জিনিসও বাদ পড়ে না। অসুখ হলে নিয়ম করে অষুধ খাই। প্রতিদিনের কোন কাজে আমার ভুল হয় না।
কেবল নুড়িগুলো দেখে ঠিক মনে করতে পারিনা, ও গুলো কোথা থেকে এল।
জানার, আমার কোন আগ্রহ হয়না।

একদিন হঠাৎ, সেদিন আমি ব্যস্ত ছিলাম। বাড়িতে সন্ধ্যায় বেশ কিছু অতিথি আসবেন। হাজারটা কাজ নিয়ে আমার ছোটাছুটি। চুলায় রান্না।
হঠাৎই টুপুর হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। মামনি তোমার জন্য একটা প্রেজেন্ট আছে।
কি বাবা?
দেখি, সেই লাল কাপড়ের পুটলিটা খুলে- টুপুর আমাকে হাতে গুনে দেয়, ১০ টা সাদা পাথর আর একটা কালো। একটাও হারায়নি ছেলেটা।
আমার মাথাটা ব্যথা করে ওঠে।
আজ জানুয়ারির ১০ তারিখ। আমার জন্মদিন।
আমি দৌঁড়ে যাই, আমার অনেক দামী ফ্যাশনেবল বুক সেল্ফটা তন্য তন্য করে খুঁজি… না কোথাও নেই। কত শীত বসন্ত কেটেছে এতগুলো বছরে। ফিকে হয়ে গেছে জীবনের কত স্মৃতি!
তবুও কি যেন ঘূণ পোকার মত, মগজে কামড়ায়। ফিকে ফিকে হয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলোর মধ্যে থেকে একটা শ্যামলা চেহারার বড় বড় চোখের মায়াময় মুখ পরিস্কার ভেসে ওঠে।
যাকে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম, একদিন মহানন্দার কালো জলে।

টুপুর হঠাৎ দৌঁড়ে আসে আবার। মামনি এটা কি? আমি দেখি, সেই লাল পুটুলিতে একটা পুরোনো রঙ্গীন কাগজ। টুপুর এটাও রেখেছে!!!!!!
আমি ভুত দেখার মত একবার টুপুরকে দেখি, একবার কাগজটা।
আমার চোখে তখন মহানন্দা
সেই নদীতে একটা মুখ…
দোল খেতে খেতে বলে যায়…
ছেলেটা বাকী কবিতাটা শেষ করে
————–

শ্বেত পাথরে পা ।
সোনার পালঙ্কে গা ।
এগোতে সাতমহল
পিছোতে সাতমহল ।
ঝর্ণার জলে স্নান
ফোয়ারার জলে কুলকুচি ।
তুমি বলবে, সাজবো ।
বাগানে মালিণীরা গাঁথবে মালা
ঘরে দাসিরা বাটবে চন্দন ।
তুমি বলবে, ঘুমবো ।
অমনি গাছে গাছে পাখোয়াজ তানপুরা,
অমনি জোৎস্নার ভিতরে এক লক্ষ নর্তকী ।
সুখের নাগর দোলায় এইভাবে অনেকদিন ।
তারপর
বুকের ডান পাঁজরে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে
রক্তের রাঙ্গা মাটির পথে সুড়ঙ্গ কেটে কেটে
একটা সাপ
পায়ে বালুচরীর নকশা
নদীর বুকে ঝুঁকে-পড়া লাল গোধূলি তার চোখ
বিয়ে বাড়ির ব্যাকুল নহবত তার হাসি,
দাঁতে মুক্তোর দানার মত বিষ,
পাকে পাকে জড়িয়ে ধরবে তোমাকে
যেন বটের শিকড়
মাটিকে ভেদ করে যার আলিঙ্গন ।
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত হাসির রং হলুদ
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত গয়নায় শ্যাওলা
ধীরে ধীরে তোমার মখমল বিছানা
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে সাদা ।
– সেই সাপটা বুঝি তুমি ?
– না ।
– তবে ?
– স্মৃতি ।
বাসর ঘরে ঢুকার সময় যাকে ফেলে এসেছিলে
পোড়া ধুপের পাশে ।
আমার রান্না ঘর থেকে ধুপের গন্ধ নয়, খাবার পোড়ার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে।
আমি ধোঁয়া ধুলোয় চোখে জমে থাকা মহানন্দার জল সরাতে সরাতে রান্না ঘরে ছুটি।