পৃথিবীর সকল শিশুর জন্য গড়ে তুলি নিরাপদ আশ্রয় - Women Words

পৃথিবীর সকল শিশুর জন্য গড়ে তুলি নিরাপদ আশ্রয়

রীমা দাস

আমি একজন প্রতিষ্ঠিত নারী। ব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ে চাকুরীরত।বর ব্যবসায়ী। দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি প্রাপ্ত। প্রায় ১২ বছর পর আমাদের বিবাহিত জীবনে আলো হয়ে আসল আমার নয়নের মনি, আমাদের ছেলে। বাবার বাড়ি, শ্বশুর বাড়ির সবাই আলোকে পেয়ে দারুণ খুশি, সাথে আমরাও। আলো জন্মের আগের বছরগুলো আমাদের কাছে ১২ যুগের মত ছিলো।অন্ধকারাচ্ছন্ন পথের শেষে আমাদের জীবনে আলোর ঝরনাধারা, কাঙ্খিত আলো এলো।আলোর সরু রেখা যখন আমরা দেখতে পেলাম তখন থেকেই আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলাম আমাদের অনাগত সন্তানকে সুস্থ পরিবেশ, সুস্থ দেহ সুস্থ মন দেবার।

আমার ছেলের নাম আলো। বাবার মত দেখতে হয়েছে সে, মনকাড়া চেহারা।আমার ছেলে বলে বলছি না আলোকে দেখে কেউ আদর না করে পারেই না।বাসার সবার নয়নের মনি, আমার আলো সবার আদর ভালোবাসায় বড় হচ্ছে।আমার সবচেয়ে প্রিয়জন আমার মা শাশুড়ি মা কাছে আলোর ছেলেবেলা কেটেছে।এই দুজন প্রচন্ড ব্যক্তিত্ববান মানুষের কাছে আমার ছেলের হাতেখড়ি। আমার দুষ্টু পাখি যেরকম রূপবান,সেরকম মেধাবীও।মাত্র বছর বয়সেই সে রবি ঠাকুরেরবীরপুরুষ” “লুকোচুরিকবিতাগুলো মুখস্থ বলতে পারত।আমি মুগ্ধ চোখে আমার আত্মজকে দেখতাম। আমার শাশুড়ি রাগি রাগি কন্ঠে বলতেন–” বেশি বেশি তাকিও না, নজর লাগবে মায়ের নজর কি করে সন্তানের গায়ে লাগে তা আমার বোধগম্য নয়।আমি তর্ক করি না,মিটিমিটি হাসি মা কথা শুনে। পাড়ার সবাই,আমার অফিসের সবাই এমন কি ওর পরিচিতজনের কাছে আলো খুব জনপ্রিয় আদরিয়

হঠাৎ আমার আনন্দময় সংসারে দুর্যোগ দেখা দিল। শাশুড়ি মা মারা যাওয়া এবং আমার বদলি জনিত কারণে আমরা দিশেহারা অবস্থায় পরলাম। আমার মা কাছে ছেলে রেখে দূরের জায়গায় একা অফিস করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। আমার নয়নের মনি ছাড়া আমি থাকব সেটা আমি কল্পনাও করি না। অগ্যতা ছেলেকে নিয়ে আমার নতুন বদলী স্থানে যাওয়া। আমাদের মাছেলের সংসারে সপ্তাহে সপ্তাহে তার বাবার আগমনে ঘরে ভ্রমর গুঞ্জন করে। আমরা উন্মুখ হয়ে থাকি তার আগমনের প্রতীক্ষায়

আমার আলো স্কুলে যায়। আমি তাকে স্কুলে দিয়ে আসি।অফিসের কর্মচারীরা যে যখন ফ্রি থাকে তাকে নিয়ে আসে অফিসে।আর আমরা মাছেলে অফিস শেষে ধীর গতিতে বাসায় যাই, রান্না করি,খাই,ঘুমাই, মাঝে মাঝে ডিগবাজি হুটোপুটি খেলা খেলি। এই ছিল আমাদের দৈনন্দিন জীবন। দিন শেষে আমি খুব ক্লান্ত থাকতাম কিন্তু আমার আলোর ছু্ঁয়ায়, আমার মিস্টি পাখিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেই আমার সব ক্লান্তি দূরে চলে যেত। গ্রীষ্মের এক পড়ন্ত সন্ধ্যায় আলোর বাবা একজন মাঝ বয়সী বিধবা নারীকে নিয়ে বাসায় এলো। আমি ওই নারীকে দেখে আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। সে রাতে আমরা তিনজন খুব আনন্দ করলাম। কে জানত সেদিন আমার ঘরে শনি ঢুকেছিলো?

আমাদের কর্মব্যস্ত জীবনে কিছুটা স্থিরতা দেখা দিল। আলোর খাওয়া রেডি হওয়া সব দায়িত্ব নিলো তার বুয়া আন্টি, নতুন কাজের মহিলা। আমি আলোকে স্কুলে দিয়ে আসি। সে আর এখন অফিসে আসে না, সরাসরি বাসায় চলে যায়।আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত বুয়াকে পেয়ে। এই বিশ্বাসবোধে আমার ছোট্ট পাখি সোনার দিকে খেয়াল কমে আসে।আমি খেয়াল করিনি পাখি আমার শুকিয়ে যাচ্ছে, আমি খেয়াল করিনি আমার পাখির চোখে চঞ্চলতা হারিয়ে যাচ্ছে, আমি খেয়াল করিনি আমার ছোট্ট পাখির চোখে রাজ্যের ভয় বাসা বাঁধছে। আমার জীবনে আরাম প্রবেশের সাথে সাথে মাছেলের মাঝে যে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে সেটাও আমার নজরে আসেনি। যে আমি আলোর গায়ের গন্ধ ছাড়া ঘুমাতে পারতাম না সেই আমি কি অবলীলায় আমার ছোট্ট আলোর দায়িত্ব একজন অপরিচিত বুয়ার উপর ছেড়ে দিলামসেটা বুঝলামই না। নিজের মধ্যে ফিরে এলাম আমার অফিসের টি বয় সবুজের কথা শুনে। সবুজ আমার ছেলেকে খুব ভালোবাসে। আলো যখন স্কুল থেকে অফিসে আসত তখন তার বেশির ভাগ সময় কাটত সবুজের সাথে। সবুজ আলোর কথা মুগ্ধ হয়ে শুনত। আলো পেয়েছিল একজন একনিষ্ঠ শ্রোতা।তার ছোট ছোট জ্ঞান সে সবুজ আঙ্কেলকে উজাড় করে দিত। সেই সবুজ আমার মনের চোখ খুলে দিল। কিছুদিন আগে সবুজ আমার রুমে অনেকক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি প্রশ্ন করলে সে উত্তর দেয়নি।সেদিন সে প্রায় / বার অকারণে আমার রুমে এলো, দাঁড়িয়ে থাকলো চলে গেলো। আমার ইন্দ্রিয় আমাকে সজাগ করে দিল, আমি বুঝতে পারলাম সবুজ কিছু বলতে চাইছে। অফিস টাইম শেষে ডেকে নিলাম সবুজকে— ” কি বলতে চাও নির্ভয়ে বলো, আমি কিছু মনে করব না আমার চোখে বা কন্ঠে কি নির্ভরতা ছিলো, জানি না। সবুজ ছলছলে চোখে, কান্না ভেজা কন্ঠে বলল–” আলো আঙ্কেলের কিছু হয়েছে, তাকে সময় দেন ম্যাডাম আমি বাকরুদ্ধ, আমার মাথায় সম্পূর্ণ আকাশ ভেঙ্গে পড়বে যেন। আমার চোখের মনি দিশেহারা হয়ে দিকভ্রন্তের মত ঘুরছে, আমার হৃদস্পন্দন আটকে যাচ্ছে। আমি মনে করতে চেষ্টা করলাম লাস্ট কবে আমি আমার পাখিকে বুকে নিয়েছি,কবে আমার পাখি সোনার গায়ের গন্ধে বুঁদ হয়েছি। হায়! আমি মনে করতে পারছি না। দিশেহারা লাগছে। নিজের ভেতরের সমস্ত উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণ করে সবুজের কাছে জানতে চাইলাম — ” কিছু বলেছে তোমাকে?” সে উত্তর দিলো–” বাসা তার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না, আপনাকে ছাড়া তার থাকতে ভাল লাগে না।আমি সবুজের নির্ভেজাল ভালো কথায় শান্তি পেলাম না। বেশি বয়সের মা আমি, সেজন্য প্রায়ই ভয়ে থাকি যদি নিজের সত্ত্বাকে ভালো ভাবে মানুষ করতে না পারি। সবুজের কথায় বুকের ভেতর ভয়েরা ডানা মেললো।আমি আমার প্রাণভ্রোমরা, প্রাণ পাখিকে কতদিন আদর করি না!

দ্রুত সব কাজ গুছিয়ে ফিরলাম বাড়ি।সতর্ক দৃষ্টি চারদিকে। আমার আসার খবর পেয়েও আলো ছুটে এলো না।আমি ফ্রেস হয়ে তার ঘরে গেলাম। আলো, আমার আলো সোনা, যে আমার অন্ধকার দূর করেছে সেই এখন অন্ধকারে বসা। মা এগিয়ে গেলো ছেলের কাছে, কোলে নিল। আমার ছোট্ট ভুতু সোনা এই স্পর্শের, এই মমতার অপেক্ষায় ছিল হয়ত, সে তার কচি দুহাত দিয়ে মাকে শক্ত করে ধরে রইলো। আমার ছেলে কাঁদছে কিন্তু শব্দ হচ্ছে না।এমন সময় বুয়া ঘরে হাজির, লাইট জ্বালাতে চাইলো সে।আমার পাখি ভয় পাচ্ছে, মা সাথে মিশে যাচ্ছে। মা কানে মুখ নিয়ে চাপা স্বরে বলছেআলো জ্বালাতে না কর মা। আমি সাথে সাথেই বুয়াকে আলো জ্বালাতে না করলাম।তাকে কাজ বুঝিয়ে দিলাম।কিন্তু বুয়া আমাদের পেছনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। আর সেই সময়টুকু আমার আলো ভয় পাওয়া পাখির মত ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে লাগলো।আমি আজ আমার সম্পূর্ণ মাতৃত্ব নিয়ে, আমার সতর্ক দৃষ্টি,সতর্ক ইন্দ্রিয় নিয়ে বাসায় এসেছি তাই আমি বুঝতে পারছি আমার সুখের ঘরে অশুভ ছায়া আছে।এই অনুভূতি আমি বুঝতে দিলাম না। যথেষ্ট শান্ত থেকে বুয়ার কাজ তদারকি করলাম ছেলেকে নিয়ে পড়তে বসালাম। আজ আমার সম্পূর্ণ মনোযোগের কেন্দ্রতে আমার আলো, আমার ছোট্ট পাখি সোনা। আমি তাকে দেখছি আর আমার বুক ফেটে কান্না আসছে। আমার পাখির চোখে চঞ্চলতা নেই, সে মা গা ঘেষে বসে আছে।মা আঙ্গুল নিয়ে খেলছে কিন্তু একবারও ডিগবাজি ডিগবাজি খেলার বায়না করছে না।

রাতে ছেলের মাথায় বিলি কেটে ঘুম আনার চেষ্টা করলাম।কিন্তু ছেলেটি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার রক্তের স্পন্দন তার কচি দুহাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে রেখেছে। মা নীরবতা দিয়ে কথা বলছে, স্পর্শ দিয়ে দিচ্ছে নির্ভরতা।এভাবে কিছুক্ষণ কাটার পর আমার বাবুই পাখি কবিতা শুনতে চাইলো। আমি অনুভব করতে পারলাম আমার পাখি, ছোট্ট সোনা স্বাভাবিক হচ্ছে আমি আবৃত্তি করলামখোকা মাকে শুধোয় ডেকে, এলেম আমি কোথা থেকে, কোনখানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে,,,কবিতার পাশাপাশি তাকে ব্যাখ্যা করে বুঝালাম। বুঝালামমাপরম নির্ভরতার স্থান।মা সন্তানকে দশ মাস, দশ দিন গর্ভে ধারণ করে রাখেন। মায়ের হৃদস্পন্দন সন্তানের সবচেয়ে পরিচিত শব্দ। হৃদয় দিয়ে মা সন্তানের সাথে কথা বলেন।কথাগুলো যখন বলছিলাম ছেলে তখন মা বুকে কান পেতে হৃদ স্পন্দন শুনতে লাগলো। আমি বুঝলাম আমার হৃদপিন্ড আমার প্রাণ ভ্রমরাকে নির্ভরতা দিয়েছে। সারারাত নির্ঘুম কাটালাম। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। তবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ছেলেকে চাপ দিয়ে কথা বের করব না। ভোরের নরম আলোয়, নতুন সকালে কখন ঘুমিয়েছি জানি না। চিৎকারে ঘুম ভাংলো, তন্দ্রার মধ্যে শুনতে পেলাম আমার পাখির ভয় পাওয়া কন্ঠ।চোখের ঘুম নিমিষেই উধাও। শুনতে পাচ্ছি ছেলে বলছেআমি মা কাছে গোসল করব, তুমি আমাকে ধরবে না। তারপর ফোঁসফোঁস শব্দ।আমি উড়ে গেলাম।আমার ভয়ার্ত পাখি মাকে পেয়ে তার ডানার ভিতর লুকালো। চোখ পড়ল বুয়ার দিকে তার চোখে মুখে হিংস্রতা। আমি আজ নতুন আমি, সেই হিংস্রতাকে পাত্তা না দিয়ে আমার বাচ্চাকে কোলে নিলাম,গোসল করালাম। আমার ছেলে মায়ের আদর পেয়ে বলে উঠলো— “তুমি কত সুন্দর করে গোসল করও মা, আর পচা বুয়া আমাকে শুধু ব্যথা দেয়। আমি আর বুয়া খালার কাছে থাকব না মা ঝরণার জলের ধারা মা ছেলেকে ভিজিয়ে দিচ্ছে আর মা তার চোখের জল লুকাচ্ছে ঝরণার জলে

আমার জীবন বৃথা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কি হবে এত বৈভব আর বিত্ত দিয়ে? একটা দুধের শিশুকে নিরাপত্তা দিতে পারছি না আমি। আলোর রেখার শুভাগমনে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম নিজের মনে তা রাখতে পারছি না বলে নিজেকে ধ্বিক্কার দিচ্ছি। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নতুন আমি আবার শপথ করলাম আলোকে সুস্থ পরিবেশ দেবো। আমার শান্ত, সৌম্য ছোট্ট পাখি সোনা মায়ের আদরে ফিরে এলো স্বাভাবিক জীবনে।এর ফাঁকে ফাঁকে জানলাম লোমহর্ষক কাহিনী।কাজের বুয়াকে বিদায় দিলাম। সবুজের হাত ধরে কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে ফেললাম। এই সবুজ আমাকে সতর্ক করেছে। হয়ত সবুজ এরকম নির্যাতনের শিকার। হয়ত সবুজ আরো ভয়ংকর পরিবেশের মধ্য দিয়ে গেছে। ভাবতে চাই না এসব। আমার বাবাই পাখিকে আমি আগের মত পাচ্ছি আনন্দে আমি আত্মহারা। এখন আমি আমার আলোক পাখি, বাবাই সোনাকে পৃথিবীর এসব ভয়ংকর মানুষের মুখোশ উন্মোচন করা শিখাব। তাকে শেখাব মা পরম নির্ভরতার স্থান। যা ভালোলাগছে না তা মা সাথে শেয়ার করা। মা সন্তানকে আগলে রাখে সব সময়, যেরকম রেখেছিলো জন্মের আগের দশ মাস দশ দিন। মা আর সন্তানের বন্ধন সূর্য আর পৃথিবীর বন্ধনের মত। আমার আলো যখন আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় আমার মনে হয় আমি স্বর্গে আছি

পৃথিবীর সকল শিশুর জন্য আমরা নিরাপদ আশ্রয় গড়ে তুলি। সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখা