বৃষ্টিময় স্বপ্ন আর বাস্তবতা - Women Words

বৃষ্টিময় স্বপ্ন আর বাস্তবতা

রাহিমা বেগম

ফাগুনের মাঝামাঝি, সকালে মিষ্টি রোদ, দুপুরে চায়ের সাথে গরম গরম পাকোরা, বিকালে স্ত্রী সন্তানের হাত ধরে ঠান্ডা বাতাসে ঘুরে বেড়ানো- সব শেষে সন্ধ্যার পর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে ঘরে ফিরা। সব মিলিয়ে জীবন সুন্দর, সুন্দর এই বেঁচে থাকা। রাতের খাবার খেয়ে কিছুক্ষন গল্পের বই পড়ছিলাম, ততক্ষণে তারা দুজনেই গভীর ঘুমে। এতক্ষন আস্তে আস্তে যে বাতাস বইছিলো হঠাৎ করে তার গতি বেড়ে গেল। ঝুম বৃষ্টি! মা মেয়ে দুজনে শীতে কুকড়ে আছে, কাঁথাটা টান দিয়ে দুজনের গায়ে দিলাম। ঠাস করে জানালায় শব্দ হলো, বৃষ্টির পানিতে রুমের কার্পেট ভিজে গেল। আজ ও একই ভুল, জানালা বন্ধ করা হয়নি! মশারি খুলে বের হলাম। জানালার কাঁচ টান দিতে যাব তখনই আরেকটা দমকা হাওয়া আর বৃষ্টির ঝাপটা আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল। কোন রকমে কষ্ট করে জানালা বন্ধ করলাম, ততক্ষণে অবশ্য পুরো ভিজে গেছি। জানালার পাশে গাছটার ডালপালার জন্যই বৃষ্টির পানি বেশি ঢুকে রুমে, গাছটা কাটতে ইচ্ছে করেনা, মায়া লাগে। অন্ধকারে কোন রকম তোয়ালে খুঁজে নিলাম। মাথা মুছতে যাব তখন অনুভব করলাম পিছন দিক থেকে কেউ একজন দুহাত শক্ত করে ধরেছে। এই স্পর্শ আমার খুব পরিচিত, তবুও অনভ্যাসে, মনের ভুলে মা মেয়ে দুজনের দিকে তাকালাম। দুজনে আরাম করে ঘুমাচ্ছে। এইটা সেই হাতের স্পর্শ যে হাত ধরে বসে থাকতাম চুপটি করে। সে শুধু স্বপ্নগুলো বলত, আমি শুধু মাঝে মাঝে হুঁ হা করতাম। ওর স্বপ্নগুলো এত সুন্দর হত, এত বাস্তব মনে হত, ও গল্প করার সময় আমি স্বপ্নের মাঝে হারিয়ে যেতাম! শোন বৃষ্টিতে ভিজলে আসলে মানুষের ঠান্ডা লাগেনা, বিয়ের পর বাড়ির যে রুমের জানালা দিয়ে পুকুরে বৃষ্টির পানি পড়তে দেখা যায় সেই রুমটাই আমরা নিব। সবদিন না, মাঝে মাঝে দুএকটা রাতে জানালার পাশে দুজনে বসে গল্প করব, গাছের ফাঁকে চাঁদের আলো দেখব, দুজনে জোৎস্না উৎসব করব। বৃষ্টির দিনে তোমাকে আমার সাথে ভিজতে হবে। ছাদে যেতে হবেনা, পুকুর পাড়েও না। আমরা জানালা খুলে রাখব, জানালায় দাঁড়িয়ে গল্প করব। আমি যখন গল্প করতে করতে পুরো ভিজে যাব, তুমি ব্যস্ত হয়ে উঠবে, কাপড় বদলানোর তাগদা দিবে। দৌড়ে গিয়ে তোয়ালে তুমি নিজেই খোঁজে আনবে, আমি তোমার হাত শক্ত করে ধরে আটকে দিব। তোমার হাত থেকে তোয়ালেটা নিয়ে তোমার মাথা মুছে দিব। তুমি আমার কপালের ভিজে চুলগুলো সরিয়ে কপালে ছোট্ট একটা চুমু খাবে! বাইরে মেঘের প্রচন্ড শব্দ হলো, খুব কাছাকাছি কোথাও কি বজ্রপাত হলো? মেয়ে ভয় পেয়ে জেগে উঠলো। মেয়ের কান্না শুনে মা ও জেগে উঠেছে, সে মেয়েটাকে টেনে বুকের কাছে নিল। কি ব্যপার তুমি বাইরে কেন? মেয়েটার পাশে থাকলে মেয়েটা এত ভয় পেতনা। লাইটটা জ্বালাও ত, মেয়েটার ভয় কাটুক। লাইট জ্বালাতে সে চিৎকার করে উঠলো আজকেও কার্পেট ভিজাইছো? আচ্ছা বলতো এইটা শুকাইতে আমার কত দিন লাগবে? কোন কাজেই ত হেল্প করোনা,উল্টা আমার জন্য শুধু্ শুধু কাজ বাড়াও। তোমার হাতে তোয়ালে কেন? তুমি কী আজকেও বৃষ্টিতে ভিজছো? আচ্ছা তোমার কি শিক্ষা হয়না। সপ্তাহ ও ত পার হয় নাই, বৃষ্টিতে ভিজে তোমার জ্বর এল, কত ভোগলে সাথে আমাদের মা মেয়েকেও ভোগালে। আরে কিচ্ছু হবেনা। কিচ্ছু হতে হবেনা। জামা চেইঞ্জ করে তাড়াতাড়ি বিছানায় আসো। অনুভুব করলাম খুব ঠান্ডা লাগছে। তাড়াতাড়ি জামা চেইঞ্জ করে লাইট নিভিয়ে বিছানায় গেলাম। মেয়েটা আমার কোলে আসলো। কিন্তু আমার হাত পা ভিজে বেশী ঠান্ডা, হয়ত বেশি ঠান্ডা হয়ে যাওয়ায় সে আমার কাছ থেকে আবার মায়ের কাছে চলে যায়। মাথার চুল তো ভাল করে মুছো নাই, হাত পা ভিজে ঠান্ডা বরফ হয়ে আছে আজকেও তুমি জ্বর বাধাবে। ঠান্ডায় কাঁপতেছো তুমি। আচ্ছা এসব পাগলামো না করলে হয়না? ঘুমাও তো। এত কথা ভালো লাগছেনা। সাথে সাথে চুপ, মেয়েকে আরো কাছে টেনে আমার থেকে দূরত্বটা বাড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। রাগ হয়েছে আমার উপর, রাগ ভাঙ্গানোর এনার্জি নাই। ঘুমে দুচোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসছে। লেপটা গায়ে টেনে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। আকাশ আবার গর্জন করে উঠলো, ঘুম ভেঙ্গে গেল। সেই হাতের স্পর্শ পিঠের উপর পেলাম। মনে বড্ড প্রশান্তি অনুভব করলাম, আমার পিঠে হাত রেখে যদি এই ঝড়ো রাতে আরাম করে ঘুমাতে পারে ঘুমাক না। আমি ওর হাতে হাত রাখতে চাইলাম। আমার হাতের স্পর্শ পেয়ে সে দৌড়ে বের হয়ে গেল রুম থেকে। আমি উঠে বসলাম। বড্ড অভিমানি মেয়ে। এমন বৃষ্টির দিনে সে ঘুমাবেনা, খুব শীত পড়লে সে ঘুমাবেনা! চোখের নীচে কালি জমে গেছে সেদিকে তার খেয়াল নাই। আস্তে আস্তে উঠে জানালার কাছে গেলাম। যা ভেবেছিলাম তাই ছোট্ট গাছটার নীচে দাড়িয়ে সে বৃষ্টিতে ভিজছে। জানালার গ্লাস খোলে দিলাম। হাতে বৃষ্টির পানি নিয়ে মুখ ধুয়ে নিল। মাথার লম্বা চুলগুলো বেয়ে পানি পড়ছে। মাথা ঝাঁকি দিল। ওর চুলের পানির ঝাপটা এসে মুখে লাগলো আমার। বড্ড ভাল লাগা ছুঁয়ে গেল। মেয়েটা মুখ ঘুরিয়ে নিল, দুহাতে বৃষ্টির পানি নিয়ে হাত ভর্তি করলো পানি দিয়ে। বার বার মুখে পানি দিচ্ছে। আকাশ চমকে উঠলো, দেখলাম ওর দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে। সেই পানি আড়াল করার জন্য বার বার মুখে পানি দিচ্ছে। ওর সব ঘুম কেড়ে নিয়েছি আমি, সব কষ্টের কারণ আমি। কাঁদছে সে। আজ সারারাত কাঁদবে। আমি চাইলে ওর কান্না থামাতে পারবনা। পারিনা আমি। ওর কান্না বাড়ছে। একফোটা চোখের পানি এসে আমার বুকের উপর পড়ল। আমি বুকের উপর হাত রাখলাম। মনে হলো একটা বড় পাথর পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়ে আমার বুকের উপর আটকে গেছে। জানালার চাদর শক্ত করে ধরলাম। ভিজা জামাকাপড় নিয়ে সে দৌড়ে রুমে ঢুকলো। তার চোখে মুখে এত ভয় আমি কোনদিন দেখিনি। কার্পেটের উপর সে বসে পড়লো। ওর হাঁটুর উপর আমার মাথা রাখলো। তার ভিজা ওড়না ভাল করে চিপে আস্তে আস্তে আমার চুলের পানি মুছে দিচ্ছে। অনেক সময় নিয়ে চুলের পানি তুললো। বুকের উপর থেকে আমার হাতটা সরিয়ে নিয়ে ওর হাত রাখলো। পাথরটা নেমে গেল। কখন ঘুমিয়ে পড়লাম টের ও পেলামনা।