‘উড়নচন্ডি’ মা ও সংসারী মেয়ের গল্প - Women Words

‘উড়নচন্ডি’ মা ও সংসারী মেয়ের গল্প

লোসা মির্জা

উড়নচন্ডি এই আমিকে প্রথম সংসারী যে করেছিল, সে আমার কন্যা আয়ীদা ফাতিমা কবীর। ডাক নাম ‘ঋ’ । তার জন্মদিন ২৩ শে ফেব্রুয়ারি। তার জন্মের আগের রাতে হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলাম আমি। আমার স্বামী বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন কি হয়েছে। আমি শুধু কাঁদতে কাঁদতে বলেছি… ‘কালকে থেকে আমি কি করব? আমিতো কিছু পারি না। বাচ্চা হলে কি করতে হয় তার কিছুই জানিনা। আমি এর আগে কোন ছোট বাচ্চা কোলেও নেইনি ‘
কথাটা সত্যি। আমি বড় হয়েছিলাম পরিবারের প্রচন্ড আদর নিয়ে। জীবনের কঠিন দিকগুলি কখনোই আমাকে বুঝতে দেয়া হয়নি। আমার সময় কেটেছে পড়াশোনা, গান, কবিতা, বিতর্ক, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন, ক্লাব এবং বন্ধুদের নিয়ে ঢাকা শহরে গাড়ি চালিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে আর নতুন রেঁস্তোরা পরীক্ষা করে। এমনকি আমার বিয়ের পরেও তা অপরিবর্তিত থেকেছে আমার স্বামীর কারণে। সারাজীবন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া আমাকে গড়ে তোলা হয়েছিল বিশ্বের দরবারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে। তাই আমার প্রতি কারও চিন্তাধারা কখনই ঘরমুখি ছিল না। আমি বড় হয়েছিলাম আমার মায়ের মৃত্যুর পরদিন থেকে। তারপর পরিবারে একের পর এক অঘটন লেগেই থাকল। যে পরিবারে নানি ছিলেন, খালা ছিলেন, মা ছিলেন সেই পরিবারে হঠাৎ করেই আমি একমাত্র নারী সদস্য হয়ে গেলাম।

মনে আছে গর্ভাবস্থায় কি করা উচিত তা বের করতাম ইন্টারনেট ঘেঁটে। জীবন আসলেই জীবনের নিয়মে চলে যায়। কে কি পারে বা না পারে তাতে কিছুই যায় আসে না। একটাই নিয়ম… হয় কর, নয় মর। আমিও তাই করলাম। যেভাবে যখন যা আসলো তা সামাল দিতে লাগলাম। বুঝে গেলাম… এটাই মন্ত্র।

তবে আমার জন্য খোদা আরও অনেক আশ্চর্যজনক ঘটনা রেখে দিয়েছিলেন। আমি দেখলাম আমার মেয়েটা আমার ঠিক উল্টো। সে অসম্ভব ঘরোয়া যাকে বলে লক্ষ্মী মেয়ে। মাত্র আট এ পড়বে অথচ এখনই ভীষণ সংসারী সে। নিজেই নিজের সব কাজ করে। তার ছোট ভাইয়েরও খেয়াল রাখে। স্কুলের দেয়া বাড়ির কাজ শেষ করে ভাইকে আবার পড়ায়ও। আমাকে ছাড়া সাত বছর বয়সে একা তার বাবার সাথে অস্ট্রেলিয়ায় থেকেছে ছয় মাস। নিজের সবকিছু গুছিয়ে রাখে আবার বুয়াকে দিয়ে কাজও করায়। আমি অবাক হয়ে প্রতিদিন দেখি। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার মায়ের ছায়া পুরোটাই তার ভেতরে। স্নিগ্ধ ব্যবহার, আস্তে কথা বলা এবং যা বলে খুব গুছিয়ে বলে। খুবই শক্ত মানসিকতা তার মধ্যে। কাঁদেনা সহজে। আর কাঁদলেও চোখের পানি আড়াল করে রাখে। ও প্রতিদিনই আমার মা হয়ে উঠছে আর আমি আবার যেন আমার ছোটবেলায় ফিরে যাচ্ছি।

আয়ীদা নামটির মানে ফিরে আসা আনন্দ। ও ঠিক তাই। আজ আমার মেয়ের জন্মদিন। তার জন্য সবাই প্রার্থনা করবেন যাতে আমার মত কঠিন পরীক্ষায় নামতে হয়না কখনও তাকে।