বিজয় দিবস ২০১৬ - Women Words

বিজয় দিবস ২০১৬

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

ভাবতে খুব অবাক লাগে যে একাত্তর সালের সে অবিশ্বাস্য বিজয়ের দিনটির পর পয়তাল্লিশ বছর কেটে গেছে। যখন ফিরে তাকাই মনে হয় মাত্র সেদিন বুঝি ছিল সেই বিজয়ের দিন। আমাকে মাঝে মাঝেই কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করে আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন কোনটি, আমার কখনো এই প্রশ্নের উত্তর দিতে এক মুহুর্তও দেরি হয় না। সব সময় বলি উনিশ’শ একাত্তর সালের ষোলই ডিসেম্বর ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন।

শুধু আমি নই, আমি নিশ্চিত আমার বয়সী যারা একাত্তরের ভেতর দিয়ে এসেছে তারা সবাই একই উত্তর দেবে। আমি সবসময় বলি যারা যারা একাত্তরের ভেতর দিয়ে এসেছে তাদের জীবনটি পৃথিবীর যেকোনো মানুষের জীবন থেকে ভিন্ন একটি জীবন। এই জীবনে আমরা পাকিস্তানি মিলিটারী এবং তাদের পদলেহী অনুচরদের অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতা দেখেছি এবং সেটি দেখে আমাদের মানুষ নামক প্রজাতির ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলার কথা ছিল। কিন্তু আমরা বিশ্বাস হারাইনি।

মুক্তিযুদ্ধের সেই নয়মাস এই দেশের সাধারণ মানুষের ভেতর একজনের জন্য আরেকজনের ভালোবাসা দেখেছি সেটি আমাদেরকে সারা জীবনের জন্য পরিবর্তিত করে দিয়েছে। আমরা কখনো মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাস হারাই না। শুধু যে মানুষকে বিশ্বাস করতে শিখেছি তা নয়, আমরা আবিষ্কার করেছি বাঙালি নামে যে জাতিটি আছে সেই জাতির ত্যাগ, বীরত্ব এবং অর্জন এতো সুবিশাল যে তার সাথে তুলনা করার মত জাতি পৃথিবীতে খুব বেশী নেই।

মুক্তিযুদ্ধের অবরুদ্ধ নয়মাস আমরা সন্তানহারা মায়ের হাহাকার শুনেছি, স্বামী হারা স্ত্রীর কান্না শুনেছি, ধর্ষিতা মেয়ের আর্তনাদ শুনেছি এবং আমি জানি আমার পক্ষে সেগুলো কোনোদিন ভুলে যাওয়া সম্ভব হবে না। একই সাথে আমি যখন অবরুদ্ধ বাংলাদেশে নয় মাস পর প্রথমবার ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানটি শুনতে পেরেছিলাম সেই শ্লোগানটিও আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না।

একটি শ্লোগান মানুষের জীবনে কী অবিশ্বাস্য আনন্দ বয়ে নিয়ে আসতে পারে সেটি সম্ভবত শুধুমাত্র আমাদের প্রজন্মই অনুভব করতে পারে। আমার মনে আছে সেই শ্লোগানটি শুনে সাথে সাথে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম সুদীর্ঘ নয় মাসের অমানুষিক নিষ্ঠুরতা, হত্যাকাণ্ড, ধ্বংসলীলা, দুঃখ, কষ্ট, হতাশা এবং হাহাকার এক মুহুর্তে অদৃশ্য হয়ে গিয়ে একটি অবিশ্বাস্য আনন্দ আমাদের ওপর ভর করেছিল।

আমার মনে আছে সেই অবিশ্বাস্য আনন্দটুকু অনুভব করার পর ধীরে ধীরে একটি গভীর বিষাদ আমাকে ভর করেছিল। এই নয় মাস প্রাণ বাঁচানোর তাড়নায় প্রায় বুনো পশুর মত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে বেড়াতে হয়েছে। কখনো স্বজন হারানোর বেদনাটুকু অনুভব করার সময় পাইনি। যখন জানতে পেরেছি আমাদের আর বুনো পশুর ছুটে বেড়াতে হবে না তখন এই দীর্ঘ নয় মাসের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা এবং হাহাকারের স্মৃতি এসে ভর করেছিল। একই সাথে বিজয়ের তীব্র আনন্দ এবং স্বজন হারানোর একটি গভীর বিষাদে সেই বিচিত্র অনুভূতিটির কথা আমি কখনো ভুলতে পারবো না।

০২.
তারপর কতোকাল কেটে গেছে। এখনো ঘুরে ঘুরে বছরের শেষে একটি বিজয় দিবস আসে। এই বিজয় দিবসটি কী এখন শুধুমাত্র বিজয়ের দিনটি স্মরণ করার দিন? আমার কেন জানি মনে হয় শুধু স্মরণ করে দিনটি পালন করা যথেষ্ট নয়। প্রতিটি বিজয় দিবসে আমাদের কোনো একটি নতুন বিজয় অর্জন করার কথা। স্বাধীনতার জন্য এই দেশটির মাটি যত মানুষের বুকের রক্তে সিক্ত হয়েছে পৃথিবীতে সেরকম উদাহরণ খুব বেশি নেই। সেই রক্তের ঋণ শোধ করতে হলে আমাদের আরো অসংখ্য বিজয়ের দরকার।

ক্ষুধার বিরুদ্ধে বিজয়, দারিদ্রের বিরুদ্ধে বিজয়, অশিক্ষার বিরুদ্ধে বিজয়, কুশিক্ষার বিরুদ্ধে বিজয়, দূর্নীতির বিরুদ্ধে বিজয়, ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে বিজয়- ইচ্ছে করলেই আমরা দীর্ঘ একটা তালিকা করে ফেলতে পারি। কিন্তু এই মুহুর্তে সবচেয়ে বড় বিজয়টি আমরা কার বিরুদ্ধে অর্জন করতে চাই? সেই বিষয়ে আমার ভেতরে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই-আমরা বিজয় চাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে।

সাম্প্রদায়িকতা শব্দটি দিয়ে আসলে এর ভয়াবহতাটুকু বোঝানো সম্ভব নয়। এটি বুঝতে হলে এই ভয়ংকর বিষয়টির ভেতর দিয়ে একজনকে যেতে হবে। আমাদের আবার স্মৃতিতে যে ঘটনাটি সবচেয়ে বেশি দাগ কেটে রেখেছে সেটি হচ্ছে ৩০ নভেম্বর ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসির নগরের ঘটনাটি। সারাদিনের ঘটনা প্রবাহে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন বুঝে গিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন আসতে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় তারা বুঝে গিয়েছিল তাদেরকে রক্ষা করার কেউ নেই।

নির্বাচনে তারা কাউকে ভোট দেবে এটুকুই শুধুমাত্র তাদের পরিচয় এ ছাড়া তাদের অন্য কোনো পরিচয় নেই, তাদের অন্য কোনো প্রয়োজনও নেই। কেউ তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে না। তাই তারা বাড়ীঘর ছেড়েৎ গিয়ে লুকিয়েছিল এবং সত্যি সত্যি তাদেরকে আক্রমণ করার জন্য একজন নয় দুইজন নয় শত শত মানুষ লাঠিসোটা অস্ত্র নিয়ে হুংকার করতে করতে ছুটি এসেছিল। তাদের বাড়ীঘর লুটপাট করেছে তাদের মন্দির উপসানালয় ধবংস করেছে।

তখন সম্পূর্ন নিরীহ বাবা মা তাদের সন্তানদের বুক আগলে নির্জন চরে গিয়ে লুকিয়ে ছিল। যারা যায়নি তারা নির্যাতিত হয়েছে, প্রহৃত হয়েছে আক্রান্ত হয়েছে। এই মানুষগুলোর দোষ কী? তাদের একটি মাত্র দোষ সেটি হচ্ছে তারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী।

তাই সবকিছু জানার পরও এই দেশের রাষ্ট্রযন্ত্র তাদেরকে রক্ষা করার প্রস্তুতি নেয়নি, যখন আক্রাক্ত হয়েছে তখন রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসেনি। ছোট ছোট শিশুগুলো মানুষের এই বীভৎস রূপ দেখে শিউরে উঠেছে, তাদের কচি মনটি সারা জীবনের জন্য সংকুচিত হয়ে গেছে। তারা কী আর কখনো মানুষকে বিশ্বাস করতে পারবে?

আমরা যখন সাম্প্রদায়িকতা শব্দটি বলি তখন সেটি শুধু একটি শব্দ। যখন সাম্প্রদায়িকতা নামক একটি পৈচাশিক প্রক্রিয়া একজন হিন্দু ধর্মালম্বীকে সহ্য করতে হয় সেটি তখন শুধুমাত্র একটা শব্দ থাকে না তখন সেটি তার জীবনের সব সপ্নকে চিরদিনের জন্য ধবংস করে দেয়। আমরা সেটি ধবংস হতে দেই।

০৩.
নাসিরনগরের ঘটনার পেছনে ইতিহাস ধীরে ধীরে বের হতে শুরু করেছে এবং সেটি জানতে পেরে আমরা আতঙ্ক শিউরে উঠতে শুরু করেছি। প্রকৃত কারণটি ধর্ম বিদ্বেষ কিংবা সাম্প্রদায়িকতা থেকে একশ গুণ বেশি ভয়ংকর। আওয়ামী লীগের দুই দলের ভেতরে একধরণের রেশারেশি রয়েছে এবং একদলকে অপদস্ত করার জন্য অন্য দল এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে। ঘটনাটি ঘটানোর জন্য প্রেক্ষাপট তৈরি করার জন্য একজন অতি নিরীহ নিরক্ষর ছেলেকে বেছে নেয়া হয়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যাণে এখন একজন নিরীহ নিরক্ষর ছেলেরও স্মার্টফোন থাকে এবং ফেসবুক অ্যাকাউণ্টকে নিরাপত্তা দেয়ার মতো অভিজ্ঞতা থাকে না। সেই সুযোগটি নিয়ে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ইসলামবিরোধী পোস্ট দিয়ে শত শত হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে আক্রমণ করা হল। পুরো বিষয়টিই যে বানানো সেটি বোঝার জন্যে কাউকে সায়েন্টিস্ট হতে হয় না কিন্তু আমরা সবিস্ময়ে দেখেছি কেউ কেউ সেটি বুঝতে রাজি হয়নি। একেবারে সবাইকে জানিয়ে শুনিয়ে হইচই করে মাইকে ঘোষণা দিয়ে দূর থেকে ট্রাক বোঝাই করে এসে শত শত হিন্দু পরিবারকে আক্রমণ করা হল।

যারা আক্রমণ করেছে তার মাঝে ধর্মান্ধ মানুষ রয়েছে, সাম্প্রদায়িক মানুষ রয়েছে এবং নিশ্চিতভাবে স্থানীয় অপরাধীরা রয়েছে কিন্তু পুরো ফাইলটি যারা নিখুঁত একটি পরিকল্পনা করে ঘটিয়েছে তারা কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতা এবং কর্মী! এই দেশটিকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য আমরা যে রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা যদি শুধুমাত্র তাদের বিপক্ষ দলকে অপদস্ত করার জন্যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে আক্রমণ করে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে মন্দির ধ্বংস করে একটা ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করে তাহলে আমরা কোথায় যাব? এই দেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষেরা কী মানুষ নয়? শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলের ষড়যন্ত্রে ব্যবহৃত হওয়ার জন্যে নাম পরিচয়হীন কিছু সংখ্যা?

শুধু কী ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর আক্রমণ হয়েছে? আমরা সবাই জানি সেখানেই শেষ হয়নি- গাইবান্ধাতেও সাঁওতালদের ওপর আরো ভয়াবহ আক্রমণ হয়েছে এবং সেই আক্রমণে শুধু যে সাঁওতালরা মারা গেছে তা নয় তাদের বাড়ীঘরে আগুন লাগিয়ে তাদেরকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, তাদের সর্বস্ব লুট করে নেওয়া হয়েছে। এই অসহায় মানুষগুলোও বিচারের জন্যে কারো কাছে যাবার জায়গা নেই।

১৯৭১ সালের সেই অবিশ্বাস্য বিজয়ের দিনটিতে আমরা সবাই কিন্তু কল্পনা করেছিলাম আমাদের দুঃখ, কষ্ট হতাশা এবং বঞ্চনার দিন শেষ হয়েছে। অনেক কষ্ট করে পাওয়া এই দেশটিতে সকল ধর্মের সকল বর্ণের সকল ভাষার মানুষ পাশাপাশি একে অন্যের হাত ধরে বেঁচে থাকব। সুদীর্ঘ ৪৫ বছর পরেও যদি দেখি সেটি ঘটেনি, এই দেশ এখনো হিন্দু ধর্মাবলম্বী কিংবা আদিবাসী মানুষেরা অবহেলার মাঝে বেঁচে আছে তাহলে হঠাৎ করে বিজয় দিবসের আনন্দটুকু ফিকে হয়ে যায়।

আমরা বিজয় দিবসের উৎসবটি উপভোগ করতে চাই। কিন্তু যদি আমরা জানি এই দেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কিংবা আদিবাসী মানুষেরা বুকের ভেতর একটা চাপা আতঙ্ক নিয়ে দিন কাটায়- যদি তারা মনে করে এই দেশটি আসলে তাদের জন্যে নয়- এই দেশে থাকতে হলে তাদের অবহেলা সহ্য করে তুচ্ছ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে হবে। তাহলে হঠাৎ করে তারা কী নিজেদের প্রতারিত মনে করবে না? আমাদের আপনজনেরা তো এই রকম একটি দেশের জন্যে রক্ত দিয়ে দেশের মাটিকে সিক্ত করেননি।

আমি খুব আশাবাদী মানুষ। আমার জীবনে আমি মানুষের চরিত্রের সবচেয়ে পাশবিক দিকটি যেমন দেখেছি ঠিক সেরকম সবচেয়ে মানবিক দিকটিও দেখেছি। আমি নিশ্চিতভাবে জানি মানুষের এই মানবিক দিকটিই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। কাজেই আমি বিশ্বাস করি এই দেশেও শেষ পর্যন্ত আমাদের মানবিক শক্তিটিই জয়ী হবে। সেটি করার জন্যে আমাদের শুধুমাত্র নিজের কাছে অঙ্গীকার করতে হবে।

এই বিজয় দিবসে আমরা নিজেদের কাছে অঙ্গীকার করতে চাই যেভাবেই হোক সবার আগে আমরা এই দেশের মাটি থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর করবই করব। এই দেশের জেলেপল্লীতে যেন একটি শিশু তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে রাতের বেলা পরম শান্তিতে ঘুমাতে পারে। একটি সাঁওতাল শিশু যেন তার বই-খাতা বুকে চেপে ধরে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতে পারে। তারা যেন এই দেশের আকাশ বাতাস মাঠ ঘাট দেখে মনে করতে পারে এটি আমার দেশ। তারা যেন এই দেশ নিয়ে ঠিক আমার মতোই স্বপ্ন দেখতে পারে।

 লেখক : কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়