৮০% বিবাহিত নারীরা স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন - Women Words

৮০% বিবাহিত নারীরা স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন

বর্তমানে বিবাহিত নারীদের ৮০ দশমিক ২ শতাংশ জীবনের কোনো না কোনো সময়ে স্বামীর মাধ্যমে কোনো না-কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সরকারের জরিপে কথাটার সত্যতা বেরিয়ে এসেছে। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভে ২০১৫’ শীর্ষক দ্বিতীয় জরিপ বলছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণসংক্রান্ত নির্যাতনের মধ্যে বেশি ছিল স্বামীর অকারণে রেগে যাওয়া। ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ বিবাহিত নারী (বিবাহিত ছিলেন এবং আছেন) অকারণে স্বামীর রেগে যাওয়ার কারণে নির্যাতনের শিকার হন। সম্প্রতি এ জরিপটি প্রকাশিত হয়। জরিপটি পরিচালনায় সহায়তা করে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

দেশীয় ও জাতিসংঘের মানদণ্ড অনুযায়ী জরিপে স্বামীর এ ধরনের আচরণের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বাধিক ছিল‍, স্ত্রী স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার আগে স্বামীর অনুমতি নেবেন, এ ধরনের চাওয়া। জীবনের কোনো না কোনো সময় ৩৬ শতাংশ নারীর এ অভিজ্ঞতা হয়।

স্বামীর হাতে নির্যাতন বলতে এখন পর্যন্ত শারীরিক নির্যাতনই প্রাধান্য পাচ্ছে। তবে স্বামীর এ ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের কারণেও যে নির্যাতন হয়, তা-ও উঠে এসেছে বিবিএসের এ জরিপে।

স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের কারণে নির্যাতনের পরিসংখ্যান নিয়ে জরিপ প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, কেননা মোট নির্যাতনের মধ্যে বিবাহিত নারীর ১৫ শতাংশই এ ধরনের নির্যাতনের শিকার।

জরিপে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা রেখে স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের একটি সংজ্ঞা খোঁজা হয়েছে। জাতিসংঘের মানদণ্ড অনুযায়ী, স্বামী বন্ধুদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে বাধা দেন কি না; বাবার বাড়ি যেতে দেন কি না; স্ত্রী কোথায় থাকেন, কীভাবে সময় কাটান, কী করেন তা সন্দেহজনকভাবে জানতে চান কি না; ভালো বা মন্দ লাগা বিষয়ে কোনো তোয়াক্কা না করে বা গুরুত্ব না দিয়ে অগ্রাহ্য করে কি না; আত্মীয় বা অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে স্বামী রেগে যান কি না; স্বামী প্রায়ই কোনো না কোনো কারণে সন্দেহ বা অবিশ্বাস করেন কি না; স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার আগে স্বামীর অনুমতি নিতে হয় কি না—এই প্রশ্নের ভিত্তিতে জরিপে অংশগ্রহণকারী নারীদের উত্তর দিতে বলা হয়।

এই বিষয়গুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে যে প্রশ্নগুলো যোগ করা হয়েছে তা হলো: পোশাকের বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করেন কি না; পড়াশোনা বা চাকরি করতে বাধা দেন কি না; বাইরে বেড়াতে যেতে বাধা দেন কি না; মা-বাবা সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য বা তাঁদের গালাগাল ও অসম্মান করে কথা বলেন কি না; জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া গ্রহণে বাধ্য করেন কি না বা পদ্ধতি গ্রহণে বাধা দেন কি না; কন্যাসন্তান প্রসবের কারণে খারাপ কথা বা খারাপ আচরণ করেন কি না; ননদ, দেবরসহ পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের নালিশের কারণে খারাপ আচরণ করেন কি না; কোনো কারণ ছাড়াই রেগে যান কি না এবং অন্যান্য কারণ। জরিপমতে, ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ নারীই জীবনে কোনো না কোনো সময়ে স্বামীর এ ধরনের এক বা একাধিক আচরণ সহ্য করেছেন। আর জরিপ পরিচালনার আগের গত ১২ মাসের হিসাবে ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশ নারীর এ অভিজ্ঞতা হয়।

দেশের সাতটি বিভাগের শহর, গ্রাম, সিটি করপোরেশন ও সিটি করপোরেশনের বাইরের শহরকে জরিপের আওতায় আনা হয়েছে। শারীরিক, যৌন, অর্থনৈতিক, স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ বা মনোভাবের কারণে এবং আবেগীয় নির্যাতনকে জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে ১৫ বছরের বেশি বয়সী ২১ হাজার ৬৮৮ জন নারীর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অবিবাহিত নারীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭০১ জন। মাঠপর্যায়ে গত বছরের ১৩ থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

বিবিএসের জরিপের প্রকল্প পরিচালক জাহিদুল হক সরদার বলেন, বাংলাদেশে বাইরে বা চিকিৎসকের কাছে যেতে স্বামীর অনুমতি নেওয়া বা অন্য বিষয়গুলোকে নির্যাতন বলেই ভাবা হয় না। জরিপে শুধু এ নির্যাতনকে যুক্ত করায় নির্যাতনের হার অনেক বেড়ে গেছে। নীতিনির্ধারকদের কাছে পরিসংখ্যান তুলে দেওয়া হয়েছে, এখন সে অনুযায়ী সমাধানের ব্যবস্থা করা হবে।

জরিপে কোন বয়সী বিবাহিত নারীরা স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক নির্যাতনের শিকার বেশি হন, তা-ও তুলে ধরা হয়েছে। জীবনব্যাপী অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে ৬০ বছর এবং তার বেশি বয়সী নারীদের ৫৮ শতাংশ এবং ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী নারীদের ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ নারীর এ নির্যাতনের অভিজ্ঞতা আছে। তবে গত ১২ মাসের হিসাবে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের প্রায় ৪৪ শতাংশের এ অভিজ্ঞতা ছিল, একই সময়ে ৫৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সীদের ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশের এ অভিজ্ঞতা ছিল। জীবনব্যাপী এবং গত ১২ মাসের হিসাবে তালাকপ্রাপ্তা, আলাদা থাকছেন বা স্বামী পরিত্যক্তা নারীদের মধ্যে এ নির্যাতনের হার বেশি ছিল।

এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হওয়ার পেছনে শিক্ষা প্রভাব ফেলে। জরিপ বলছে, অশিক্ষিত নারীদের ৫৬ শতাংশের বেশি নারী এ ধরনের নির্যাতনের শিকার। গত ১২ মাসের হিসাবেও তা ৩৯ শতাংশের বেশি ছিল। ডিগ্রি এবং এর থেকে বেশি পড়াশোনা করা নারীর ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশের এ অভিজ্ঞতা ছিল। অন্যদিকে দরিদ্র এবং গ্রামীণ নারীদেরও এ নির্যাতনের অভিজ্ঞতা বেশি ছিল।

জরিপে বলা হয়, স্বামীর নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর বেশির ভাগ নারী (৭২ দশমিক ৭ শতাংশ) কখনোই নির্যাতনের কথা কাউকে জানাননি। বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ নারী পুলিশের সহায়তা চান। কেন নির্যাতনের কথা জানাননি, এ প্রশ্নের উত্তরে শতকরা ৩৯ জনের বেশি নারী বলেছেন, পারিবারিক সম্মানের কথা চিন্তা করে, নির্যাতনের ভয়ে, স্ত্রীকে স্বামীর মারার অধিকার আছে ভেবে অথবা লজ্জায় তাঁরা বিষয়গুলো কাউকে জানানোর প্রয়োজনই মনে করেননি।

নারী ও মানবাধিকার নিয়ে কর্মরত লোকজনের মতে, স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণও যে নির্যাতন, তা নিয়ে নারীরা অভিযোগ করবেন না, তাই তো স্বাভাবিক। এটি যে নির্যাতন তাই তো অনেক নারী বুঝতে পারেন না।

শুধু যে নারীরা বুঝতে পারেন না, তা নয়, সামাজিকভাবেই শারীরিক নির্যাতনের বাইরে অন্য নির্যাতনকে তেমন একটা গণনায় আনা হয় না।
নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত চলতি বছরের পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ‌বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় শীর্ষক পরীক্ষার একটি প্রশ্ন ছিল—নারী নির্যাতনের প্রধান প্রভাব কোনটি? এ প্রশ্নের চারটি অপশনের মধ্যে একটি হবে সঠিক উত্তর। চারটি অপশন ছিল-মানসিক ক্ষতি, শারীরিক ক্ষতি, আধ্যাত্মিক ক্ষতি ও বিকাশগত ক্ষতি। এবার যারা পরীক্ষা দিয়েছে তারা এর উত্তর দিয়েছে শারীরিক ক্ষতি। কেননা পাঠ্যবইতে তাই বলা ছিল।

এ প্রশ্ন নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, ‌‘এটা আবার কেমন প্রশ্ন? আধ্যাত্মিক ক্ষতি না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু অন্য তিনটির মধ্যে তিনটিই তো সঠিক হতে পারে। তার মানে আমরা এখন পর্যন্ত নারীর মানসিক ক্ষতির প্রভাব নিয়ে চিন্তাই করছি না।’

সূত্র: প্রথম আলো