যেমন ছিলেন ইশরাত আখন্দ - Women Words

যেমন ছিলেন ইশরাত আখন্দ

ইশরাত আখন্দ এর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর তার বন্ধু নাদিয়া ইসলাম ফেসবুকে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন দীর্ঘ পোস্ট। সেখানে ইশরাতের সাথে তাঁর প্রথম পরিচয় থেকে শুরু করে বন্ধু হয়ে ওঠার বিবরণ আছে। তাতে আমরা দেখতে পাই বন্ধু হিসেবে, দেশপ্রেমী নাগরিক হিসেবে, শিল্পবোদ্ধা হিসেবে, সর্বোপরি মানুষ হিসেবে ইশরাত কেমন ছিলেন তার একটা স্পষ্ট চিত্র। উইমেন ওয়ার্ডস এর পাঠকদের জন্য সেই লেখাটি হুবহু তুলে ধরা হলো-

Nadia Islam women wordsমৃত্যুর সাথে আমার পরিচয় নতুন না। আমি ল্যাবে, মর্গে প্রতিদিন লাশ দেখি। অর্ধেক নাই হইয়া যাওয়া লাশ, পইচা গইলা যাওয়া লাশ, মাংস খইসা পড়া লাশ। এ্যাক্সিডেন্টে গাড়ীর উইন্ডশিল্ডে ঢুইকা যাওয়া চোখ খোলা লাশের সামনে দাঁড়ায়ে আমি মুখ শক্ত কইরা নোট নেই। নিজে মারা যাইতে যাইতে বাঁইচা গেছি বহুবার। বহুবার। তবুও এই মৃত্যুটা আমারে নাড়ায়ে দিয়া গেলো অদ্ভূতভাবে।

ইশরাতের সাথে আমার দেখা হওয়ার কথা ছিলো গতকাল। আমার ড্রাইভার অসুস্থ থাকায় আমি বাড়ি থিকা বাইর হইতে পারলাম না। বললাম, ‘আচ্ছা, নেক্সট উইকে দেখা হবে!’ নেক্সট উইক যে আর আসবে না, সেইটা কি আমাদের দুইজনের কেউই ভাবছিলাম?

উনার সাথে আমার পরিচয়টা মজার। সেইদিন আমার বন্ধু আরিফ হাফিজের একটা বুক-রিডিং ছিলো। আমি গুলশানের রেড শিফটের বিল্ডিং এ ঢুকতে যাইতেছি, একজন দৌড়ায়া আইসা বললেন, ‘হোল্ড দ্যা লিফ্ট- হোল্ড দ্যা লিফ্ট প্লিজ!’ আমি লিফ্টের দরজা ধরলাম উনার জন্য। উনি আমারে ধন্যবাদ জানাইলেন। বললেন, ‘আপনাকে কিন্তু আমি চিনি!’

-আমারে চিনেন? ক্যামনে?
-আপনি লিখেন তো ফেইসবুকে! তাই না? আপনি আলমগীর হক স্বপনের বন্ধু! নাকি?

Ishrat Akhond 02 Women wordsআমি মাথা নাইড়া সায় জানাইলাম। তো লিফ্টে উঠতে উঠতেই আমাদের বিশাল খাতির হইয়া গেলো। রেড শিফটের লাউঞ্জে আরিফ আসলেন আমার সাথে ইশরাতের পরিচয় করায়ে দিতে। ইশরাত হাসতে হাসতে আমার গায়ে গড়ায়ে পড়তে পড়তে কইলেন, ‘আরিফ, আমরা একজন অন্যজনকে খুব ভালোমত চিনি!’ আমি বললাম, ‘হ, আমাদের অনেকদিনের বন্ধুত্ব!’ আরিফ আমাদের রাইখা দূরে গিয়া বসলেন।

তো আরিফ হাফিজ আর মুনিজ মানসুর গম্ভীর গলায় উনাদের বই থিকা রিডিং পড়তেছেন, ইশরাত ফিশফিশ কইরা আমারে কইলেন, ‘চলেন, বিরিয়ানী খেতে যাই! আমার খুব স্টারের বিরিয়ানী আর বোরহানি খেতে ইচ্ছা করছে! ওদের ফিরনীটাও মারাত্মক!’

তো গেলাম আমরা বিরিয়ানী খাইতে। বিরিয়ানী খাইলাম, কাবাব খাইলাম, রোস্ট খাইলাম, বোরহানি খাইলাম। শেষমেষ ফিরনীও খাইলাম। খাওয়া শেষে আমি নড়তে পারি না, উনি কন, ‘চলেন, সুবরানা আপার ছবি দেখে আসি!’ তো গেলাম শামীম সুবরানার এক্সিবিশানে। সেইখান থিকা আরেক মডার্ন আর্ট এক্সিবিশান। সেইখানে গিয়া উনার মনে হইলো আইসক্রিম খাইতে যাওয়া যাইতে পারে। আইসক্রিম পার্লারে ঢুইকা উনার মনে হইলো ফুচকা খাবেন। ফুচকা খাওয়া হইলে বললেন, ‘চল, (ততক্ষণে আমরা একে অপররে তুমি বলা শুরু করছি) আমার বাসায়। কফি খাওয়াবো!’ আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘আজকে আমাদের পেট খারাপ না হইলেই না!’ উনি কইলেন, ‘ডার্লিং, পেটের নাম মহাশয় জানো তো-!!’

তো এই হইলো ইশরাত আখন্দ। ফুল অফ লাইফ, মাথা খারাপ, হাসিখুশী, আর্ট পাগল, ফুড পাগল, রান্ডম, এ্যাক্সেন্ট্রিক একটা মেয়ে। তো আমাদের নিয়মিতই দেখা হওয়া শুরু হইলো ঢাকায়। আজকে এইখানে জামদানী শাড়ির এক্সিবিশান, কালকে ঐখানে এক রেষ্টুরেন্টের খুব ভালো লবস্টার পাওয়া যায়, আজকে অমুক আর্টিস্ট খুব সুন্দর ডিজাইনার জুতা বানাইতেছেন, তো পরশু তমুক জায়গায় জ্যাজ শো হইতেছে, সুতরাং ইশরাতের উৎসাহের অভাব নাই। উনি কাজও করতেন প্রচুর। উনি ছিলেন একই সাথে বি-জি-এম-ই-এ এবং জেড-এক্স-ওয়াই-এর হিউম্যান রিসোর্স ডিরেক্টার, ওয়েস্টিন হোটেলের মার্কেটিং ডিরেক্টার এবং ইন্সটিটিউট অফ এশিয়ান ক্রিয়েটিভসের আর্ট প্রভোকিউরেটার। গ্রামীণ এবং ব্র্যাকনেটেও কাজ করতেন একসময়। তবে উনার সবচাইতে পছন্দের কাজ ছিলো ‘আই এ্যাম হ্যাপি, বি’কজ-’ বইলা একটা দাতব্য কাউন্সেলিং কোর্স চালানো। এবং তার অংশ হিসাবে উনি প্রতিদিন আগরুম বাগরুম সব ছবি আপ করতেন ফেইসবুকে। যেমন উনার রান্না করা শুঁটকি মাছ, বা উনার জানলার বাইরে বইসা থাকা কাক, বা আকাশ, বা উনার দারোয়ান অফিসে একটা কামিনী গাছ নিয়া আসছেন, সেই গাছভর্তি সাদা রঙ্গের ফুল! উনার ভাষায়, ‘ডেইলি ডোজ অফ পজিটিভিটি!’

Ishrat Akhond 03 Women wordsতো সেই মেয়েটারে গতকাল ইসলামী জঙ্গীরা ‘কালিমা’ বলতে না পারার অপরাধে জবাই কইরা মাইরা ফেলছেন। সকালবেলা আরিফ যখন আমারে জানাইলেন, ইশরাতরে জিম্মি করা হইছে, এবং সম্ভবতঃ মাইরা ফেলা হইছে, আমি তখনো নিজের কানরে বিশ্বাস করতে পারতেছি না। আরিফের নিশ্চয় মাথা খারাপ হইয়া গেছে। কই, গতকালকেই ইশরাতের সাথে আমার কথা হইলো! গতকালকেই আমরা আগামী সপ্তাহে দেখা করবো বইলা প্ল্যান ঠিক করলাম! মানুষ মারা এত সহজ? এত সহজ? এত সহজ?

আমি আরিফের সাথে কথা বলতে বলতে ইশরাতের ফেইসবুক পেইজ ঘুরতেছি। আমার মাথায় তখন উনার ‘ডেইলি ডোজ অফ পজিটিভিটি’। বাংলাদেশ নিয়া কেউ খারাপ কথা বললেই খুব ক্ষেইপা যাইতেন উনি, কইতেন, ‘এ্যাহ্ আমাদের যা আছে, ওদের কি ঐসব আছে নাকি?’ এরপর একদিন আমাদের শ্রীলংকান বন্ধু হারিকেশের সাথে উনি বিশাল ঝগড়া লাগায়ে দিলেন। হারিকেশ বাংলাদেশের মৌলবাদ নিয়া কিছু একটা বলতেছিলেন, তার উত্তরে ইশরাত বললেন, ‘আমাদের যদি খারাপ কিছু থাকে, সেটা আমরা দেখবো। তোমরা বিদেশীরা আমার দেশে বসে আমার দেশ নিয়ে খারাপ কথা বলবে, এসব ফাজলামীর মানে কী? টাকা তো কম নিচ্ছো না আমাদের কাছ থেকে, তাই না? এই দেশ ভালো না লাগলে নিজের দেশে ফেরত যাও না ক্যানো? আমার দেশের কোনটা খারাপ?’ হারিকেশ খুব ভয় পাওয়ার ভঙ্গি কইরা বলেন, ‘না না, ক্ষমা চাই! তোমার দেশের সবই ভালো! এই যে তুমি কত সুন্দর!’

Ishrat Akhond 04 Women wordsতো আজকে ইশরাতরে যখন ‘ইসলামের’ নামে জবাই করা হইলো, ইশরাত তখন কী ভাবতেছিলেন, ভাবি আমি। তখনও কি উনি মনে মনে বলতেছিলেন, ‘আমার দেশের মত সুন্দর দেশ পৃথিবীতে আর একটাও নাই?’ বলতেছিলেন কি? উনার চোখ দিয়া উনার সুন্দর দেশের জন্য তখন এক ফোঁটা পানি গড়াইয়া পড়ছিলো কি?

নাদিয়া ইসলাম, গবেষণা সহকারী, কিংস কলেজ লন্ডন