রাষ্ট্রীয় ভঙ্গুরতা সূচক ও সাম্প্রতিক বাংলাদেশ - Women Words

রাষ্ট্রীয় ভঙ্গুরতা সূচক ও সাম্প্রতিক বাংলাদেশ

Moni Women wordsপ্রতি বছরের ন্যায় যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘ফান্ড ফর পিস’ ২০১৬ সালের ভঙ্গুর দেশের ইনডেক্স প্রকাশ করেছে। ১৭৮ টি দেশের এ তালিকায় ১ম স্থানে অবস্থান করছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভঙ্গুর দেশ সোমালিয়া এবং শেষ অবস্থানে আছে সবচেয়ে সুস্থিত দেশ ফিনল্যান্ড। বাংলাদেশের অবস্থান ৩৬তম। গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩২। সে তুলনায়, এ প্রতিবেদন অনুযায়ী গত এক বছরে বাংলাদেশের ভঙ্গুরতা কমেছে। এ থেকে আমরা আসলে কী বুঝতে পারি? এটা কি কোনভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন নির্দেশ করে? এ থেকে বাংলাদেশ কী ধরণের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে? এ ধরণের প্রশ্নগুলো সামনে চলে আসে। এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে জানতে হবে এই ভঙ্গুরতা বলতে কী বুঝায়। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের ভঙ্গুরতার কী ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে তা না বুঝে এ বিষয়ে কোন উপসংহারে পৌঁছানোও ঠিক হবে না।

ফান্ড ফর পিস মূলত চারটি বিষয় ভিত্তিক সূচকের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের ভঙ্গুরতা নির্ধারণ করে থাকে। এগুলো হলো- সামাজিক, অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক ও সামরিক সূচক। সামাজিক ও অর্থনৈতিক নির্দেশকগুলোর মধ্যে রয়েছে জনতাত্ত্বিক চাপ, উদ্বাস্তু ও আভ্যন্তরীণ বাস্তচ্যুতি সমস্যা, গ্রুপ অসন্তোষ, মানবাধিকার ও ব্রেইন ড্রেইন, অসম অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামগ্রিক অর্থনীতি। রাজনৈতিক ও সামরিক নির্দেশকের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা, পাবলিক সার্ভিসের গুণগত মান, মানবাধিকার ও আইনের শাসন, নিরাপত্তা কৌশল, এলিট শ্রেণীর দাপট এবং বাহ্যিক শক্তির হস্তক্ষেপ।  ১ থেকে ১০ এর এই স্কেলে ৫ টি ধাপ রয়েছে- উত্তম (১-২); ভালো (৩-৪); সহনীয়/মধ্যমমান (৫-৬);দূর্বল/খারাপ (৭-৮); আশঙ্কাজনক/বিপদাপন্ন (৯-১০)। সারা বিশ্বের বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংগঠনের হাজার হাজার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এই সূচক তৈরি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

ফান্ড ফর পিস এর গবেষণা অনুযায়ী এই সব সূচকের গড় বিচারে বাংলাদেশ ক্রমাগত উন্নতি করছে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২। অনির্বাচিত, অগণতান্ত্রিক ও সামরিক সমর্থিত সরকারের বদৌলতে সেটাই ছিল সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে খারাপ অবস্থান। সেই পরিপ্রেক্ষিতে গত এক দশকে বাংলাদেশে ভঙ্গুরতা কমেছে। অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশের উন্নতি ধারাবাহিক। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জিডিপি ও মাথাপিছু আয় একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। সামাজিক সূচকে গত দশ বছরে বাংলাদেশের উন্নতি হলেও গত দুই বছরে সে ধারা ব্যাহত হয়েছে, বিশেষ করে গ্রুপ অসন্তোষে বাংলাদেশের স্কোর গত বছরের তুলনায় ০.৫ বেড়েছে, বর্তমান স্কোর ৮.৯। যার অর্থ, সমাজের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে অসন্তোষ সামগ্রিক উন্নয়নে একটি বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাছাড়া আভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতিকেও একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

২০০৮ সালের পরে নাগরিকের কাছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আইনি বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়লেও গত দুই বছরে তা কমতে শুরু করেছে। এ বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতার পরিমাপক ছিল দূর্নীতি, সরকারের কার্যকারিতা, গণতন্ত্রের অনুশীলন, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, মাদক ব্যবসা, অবৈধ অর্থনীতি, প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ এবং ক্ষমতার লড়াই। এসব বিচারে এ বছর বাংলাদেশের স্কোর স্কোর ৮.০ যাকে ‘দুর্বল’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে এইসব সূচকে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে খারাপ করতে শুরু করেছে। ২০০৮ সাল থেকে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের মান উঠানামা করলেও এখনও তা দুর্বলই (৭.৬) রয়ে গেছে। পাবলিক সার্ভিসের মান বৃদ্ধি পেলেও আভ্যন্তরীণ নাগরিক নিরাপত্তা এখনও দুর্বল। এলিট শ্রেণীর দাপট বরাবরই বেশি ছিল এবং তা বর্তমানে বিপদসংকেতপূর্ণ অবস্থায় আছে (স্কোর ৯.৬)। বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান সহনীয়। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান এখনও ভীতিকর।

এ সূচক অবস্থান থেকে এ বিষয়টি পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত থাকলেও সার্বিকভাবে উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে মূলত আভ্যন্তরীণ অন্যান্য অনেক সমস্যার কারণে। সামাজিক সমস্যাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে বিরাজমান অসন্তোষ। এই গ্রুপগুলোর বিভক্তি মূলত রাজনীতি, ধর্ম, মত, শ্রেণি ও আয়ের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় যে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে তাতে এই বিভাজন আরও স্পষ্ট হতে পারে। এ সকল গ্রুপের মধ্যে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও ভালোবাসা গড়ে তুলতে না পারলে এই অসন্তোষ আরও বাড়তে থাকবে এবং সাথে রাষ্ট্রের ভঙ্গুরতাও।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও গণ অংশগ্রহণের চর্চা ও সুযোগ সীমিত বলে অনেক আন্তর্জাতিক সংগঠনই দাবি করেছে। ফলে রাষ্ট্রের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতাও কমে যাচ্ছে। মানবাধিকার ও আইনের শাসনেও বাংলাদেশ খুব বেশি উন্নতি করতে পারছে না। সাম্প্রতিক সময়ে পাবলিক সার্ভিসের কিছুটা উন্নতি হলেও জীবনের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি নেই। বাড়ছে ধনী গরীবের দূরত্বও।

অনেকেই এই সূচকের মানদণ্ড, গুণগত মান ও এর পদ্ধতি নিয়ে সমালোচনা করতে পারেন। সেটি আসলে প্রত্যাশিতও। অনেক সমালোচকের মতে, এ ধরণের ইনডেক্স থেকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা পাওয়া যায় না। ভঙ্গুর অবস্থাতেও অনেক দেশ অতীতে উন্নয়ন (সার্বিক অর্থে) বজায় রাখতে পেরেছে (উদাহরণ, ভারত); আবার আপাত দৃষ্টিতে ভঙ্গুর না হলেও যে কোন সময় ভেঙ্গে যেতে পারে (উদাহরণ, যুক্তরাজ্য)। এ ধরণের সমালোচনা আসলে সব ইনডেক্সের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে, এটা মোটামুটি সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য যে, এই ধরণের সূচক থেকে আলোচনা শুরু করা ভালো। এর ভিত্তিতে পরিকল্পনা করা ও সতর্ক অবস্থা নেয়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কার্যকর। বর্তমানে বাংলাদেশ যে সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেই সংকট যে অর্থনৈতিক নয় বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক তা এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান থেকে স্পষ্ট।

৪ ধাপ উন্নতি হলেও এর মাঝেই অনেক অপ্রাপ্তি ও সমস্যার গভীরতার বিষয় লুকিয়ে আছে। এ সকল সমস্যার সমাধানের জন্য সরকারের কার্যকারিতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সরকারের উপর জনগণের আস্থা। তা না হলে, আগামী বছর এই সূচকেও বাংলাদেশের উন্নতির সম্ভবনা নেই।

লেখক : শিভেনিং স্কলারশিপে যুক্তরাজ্যের ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ এ গভার্নেন্স ও উন্নয়ন বিষয়ে অধ্যয়ন করছেন।