মেরিনা তাবাসসুমঃ প্রতিভাময়ী তরুণ স্থপতি - Women Words

মেরিনা তাবাসসুমঃ প্রতিভাময়ী তরুণ স্থপতি

শাকুর মজিদ

প্রথম আলোর ছুটির দিনে ২০০৮ সালের পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ১০ জন প্রতিভাময়ী বাংলাদেশী তরুণীকে নিয়ে প্রচ্ছদকাহিনী করবে। এর মধ্যে একজন তরুণী স্থপতি নাম মেরিনা। আমি মেরিনাকে ভালো চিনি। ১০ এপ্রিল আনিসুল হক ফোন করে বললেন, মেরিনা তোমার অফিসে যাবে, তার সঙ্গে গল্প করে ৬-৭শ শব্দের মধ্যে একটা কিছু লিখে দাও। আজই দিতে হবে, পরশু ছুটির দিন বেরোবে।

marina-01-women-wordsআমি রাজি হলাম। মেরিনা দুপুরে এলো। আমরা এক সঙ্গে অফিসে বসে দুপুরের ভাত খেলাম, কথা বললাম। তারপর সে চলে গেলো। সে বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমি লিখে পাঠিয়ে দিলাম ইকবাল-এর কাছে। ১২ এপ্রিল ২০০৮ নববর্ষ সংখ্যায় লিড ছিলো মেরিনা।

গতকাল তাঁর পরম সুসংবাদটি (স্থাপত্যে বিশ্বের অন্যতম সেরা আগা খান পুরস্কার জয়) শুনে প্রথম আলোর আর্কাইভ খুঁজতে গিয়ে দেখি ২০১৩র আগের কোন ডেট নিচ্ছে না। আমার কম্পিউটারে খুঁজে লেখাটি পেয়ে গেলাম। আমার ফেসবুক বন্ধুদের জন্য লেখাটি হুবহু দিয়ে দিলাম। অভিনন্দন মেরিনা।

একই সঙ্গে তারই ব্যাচমেট কাশেফ মাহবুব চৌধুরীকেও অভিনন্দন, কাশেফ আরেকটি প্রজেক্টের জন্য এ বছর আগাখান পুরস্কার পেয়েছে।

মেরিনা তাবাসসুমঃ প্রতিভাময়ী তরুণ স্থপতি

১৯৮৮ সালে মেরিনারা যখন আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টে ক্লাস শুরু করে, তখন থেকেই সে আলোচিত একজন। ভর্তি পরীক্ষায় প্রায় তিন হাজার ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে প্রথম হওয়া খুব সহজ কাজ নয়। সবাই পারে না, কেউ একজন পারে। পেরেছিল মেরিনা তাবাসসুম। সেখান থেকেই তার সূচনা।
এর মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে তার জীবণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যাত্রার সূচনা হয়। পড়াশুনায় ভালো, ডিজাইন করে সুন্দর। শিক্ষকদের প্রশংসা, বন্ধুর উৎসাহ আর বাবা মার আশীর্বাদ, সবকিছু নিয়ে ১৯৯৫ সালে বুয়েটের পাঠ যখন সে চুকোলো, তার হিসেবের খাতায় তখন সঞ্চিত হয়ে গেছে ডিজাইন ক্লাসে সবচেয়ে বেশী নম্বর পাওয়ার জন্য হাবিবুর রহমান স্বর্ণপদক।

১৯৯৫ সালে মেরিনারা গ্রাজুয়েশন করে বেরোয় বুয়েট থেকে। এ সময় তার দু’টো বড় ঘটনা ঘটে। তার সহপাঠি স্থপতি কাশেফ চৌধুরীর সাথে তার বিয়ে হয় এবং তারা দু’জনে মিলে ‘আরবানা’ নামে একটা স্থাপত্য উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে এবং শুরু থেকেই তারা দাপটের সাথে স্থাপত্য পেশা চর্চা শুরু করে। নতুন স্থপতি হিসেবে এই যুগলের বেশ নামডাক ও হয়। কাশেফ ও মেরিনা, দু’জনেই ভালো স্থপতি, দু’জনই ভালো ডিজাইনার। শুরুর দু’বছরের মাথায় জাতীয় ভিত্তিক স্থাপত্য প্রতিযোগিতায় – সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে নির্মিতব্য স্বাধীনতা স্থম্ভ ডিজাইন করার জন্য শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে নজরে চলে আসে ‘আরবানা’। নজরে আসে কাশেফ ও, তার সাথে মেরিনা তাবাসসুম। ভিন্ন ধারার কাজ করে এর মধ্যেই তাদের অনেক নাম ডাক হয়ে যায়। কাজের প্রতি নিষ্ঠা এবং দরদ তাদেরকে আরো সামনের দিকে ঠেলে দেয়। ২০০১ সালে ভারতের ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে জে কে সিমেন্ট এওয়ার্ড পাওয়ার ঘটনাটি তার পুরস্কারের ঝুলিকে আরেকটু ভারী করলো। প্রজেক্টের ডিজাইন স্থপতি হিসাবে পুরস্কারটি সেই গ্রহন করে।

কিন্তু বেশী দিন তাদের আর এক সাথে থাকা হলো না। মেরিনার ভাষ্য – আমি আমার স্বাতন্ত্র নিয়ে, আমার পরিচয় নিয়ে আমার কাজটুকু করতে চাই। মেরিনা ‘অনন্যা শীর্ষ’ দশ পদকটি যে বছর পেলো, সে বছরই দীর্ঘ ১৫ বছরের সম্পর্ক ছেড়ে ২০০৫ সালে দু’জন মিলেই সিদ্ধান্ত নিলো আলাদা হয়ে যাবার। সেই থেকে মেরিনা এখন আলাদা। মেরিনার নতুন ফার্মের নাম ‘মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্ট’।

marina-02-women-wordsগত প্রায় ৩ বছর ধরে এই নামেই সে কাজ করছে। বেশ কটি বড় শপিং মলের ইন্টেরিয়র, এপার্টমেন্ট, যশোরে একটি রিসোর্ট, গাজিপুরে ফ্যাক্টরী, একটা মসজিদ – এসবই ওর একান্ত নিজের ডিজাইন।

আলাদা হয়ে যাবার পরও মেরিনা তার কাজ নিয়ে পুরস্কৃত হয়েছে এবার একা। ‘নিসর্গ’ আয়োজিত এই ডিজাইন প্রতিযোগিতায় তার প্রজেক্টটি তৃতীয় স্থান দখল করে।

ধানমন্ডিতে একটা ছোট্ট পরিসরের তার ডিজাইন স্টুডিও। আরো তিন জন তরুণ স্থপতি তার সাথে কাজ করে। এই নিয়ে মেরিনার বর্তমান আয়োজন।

মেরিনার সবচেয়ে বড় আপত্তি, তাকে যখন কেউ মহিলা স্থপতি হিসাবে চিহ্নিত করতে চায়। তার কথা – আমি একজন স্থপতি, এর কোনো লিঙ্গঁ ভেদ নাই। শুধু শুধু আমাকে মহিলা আর্কিটেক্ট বলা কেনো? মেরিনা বলে – কই, মেয়ে হিসাবে কাজ করতে গিয়ে আমি তো কোথাও কোনো সমস্যায় পড়ি না। একটা ছেলে যেমন সাইটে যায়, মিস্ত্রীকে কাজ বুঝায়, কাজের তদারকি করে আমিও তেমনি করি। তবে হ্যা, একটা প্রফেশনাল মেয়েকে একটা ছেলের চেয়ে অনেক গুলো বেশী রোল প্লে করতে হয়। ঘর সামলানো এবং বাইরেরটা দেখা। দু’টো এক সাথে মিলানো খুব টাফ। কেউ কেউ হয়তো পারে। তবে আমার ক্ষেত্রে আমার কাজটাই অনেক বেশী গুরুত্বের। আমি আমার ক্যারিয়ারটাকেই বড় করে দেখি।

মেরিনা বলেন – আমার প্রাক্তন স্বামীর প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। ‘আরবানা’ আমাদের যৌথ অংশীদারীত্বের প্রতিষ্ঠান ছিলো, আমার অংশ আমি ওকে দিয়ে এসেছি। এখন আমার আর পেছনে তাকানোর সময় নেই। মানুষেরতো একটাই জীবন। আমি আমার বেঁচে থাকা সময়টাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে চাই। আমি স্থাপত্যচর্চাটাকেই সবচেয়ে বেশী উপভোগ করি। এটাকে আমি কাজ মনে করিনা। আমার মনে হয়, এটা আমার নেশা।

২০০৫ সাল থেকে মেরিনা ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি হিসাবে কাজ করছেন। ছাত্র পড়ানোতেও তার অনেক আনন্দ। ছাত্ররা যখন তার চিন্তার ফিডব্যাক দেয়, এটাও তাকে আলোড়িত করে।

আর এসব নিয়েই মেরিনা বাকীটা জীবন কাটিয়ে দিতে চায়।

শাকুর মজিদ, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, পরিচালক ও স্থপতি