ব্রিটেনের প্রথম বাংলাদেশি নারী মেয়র হলেন নাদিয়া - Women Words

ব্রিটেনের প্রথম বাংলাদেশি নারী মেয়র হলেন নাদিয়া

আহমেদ নূর
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশি দিন কন্যার ইতিহাস গড়েছেন আগেই। এবার নতুন আরেক কৃর্তি গড়লেন সিলেটের মেয়ে নাদিয়া শাহ। যুক্তরাজ্যের প্রথম বাংলাদেশি নারী মেয়র হয়ে হিসেবে ইতিহাসের পাতায় নাম লেখালেন। গত বুধবার  (১১ মে) রাতে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে লন্ডনের কেমডেন কাউন্সিলের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। নাদিয়া কেমডেনের রিজেন্ট পার্ক ওয়ার্ড থেকে লেবার দলের নির্বাচিত কাউন্সিলর। এর আগে এই আসনের কাউন্সিলর ছিলেন বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপ সিদ্দিক।
নাদিয়া শাহের জন্ম এবং বেড়ে উঠা লন্ডনে। চার বোনের মধ্যে নাদিয়া সবার বড়। তার বাবার বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া শহরে এবং মায়ের বাড়ি সিলেট শহরে। নাদিয়ার বাবা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম প্রথম জীবনে ব্যাংকিং পেশার সাথে জড়িত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ব্যবসায় যুক্ত হন। ষাটের দশকে তিনি যুক্তরাজ্য যান এবং সেখানে ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। নাদিয়ার মা আম্বিয়া ইসলাম লন্ডনের একটি নার্সারী স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ব্যক্তি জীবনে নাদিয়া তিন সন্তানের জননী। নাদিয়ার স্বামী জলিল শাহ একজন আইটি বিশেষজ্ঞ এবং কেমডেন কাউন্সিলের ইনফরমেশন টেকনোলজি বিভাগের প্রধান হিসেব কর্মরত। তাঁর গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার আশ্রাকাপন গ্রামে।
লন্ডনের পার্লামেন্ট হিল স্কুলে শিক্ষা জীবন শুরু করেন নাদিয়া। পরে গ্রিনউইচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে ইনভেস্টমেন্ট অ্যাডভাইজর হিসেবে ইংল্যান্ডের ন্যটওয়েস্ট ব্যাংকে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর হোম অফিস, স্থানীয় সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কাজ করার অভিজ্ঞতা লাভ করেন। ২০১৪ সালে নাদিয়ার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। লেবার পার্টির রাজনীতি করেই তিনি কেমডেন বরো কাউন্সিলের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। নির্বাচিত কাউন্সিলর হিসেবে তিনি ডেপুটি মেয়রও নির্বাচিত হন। বুধবার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর ডেপুপি মেয়র পদে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন কাউন্সিলর রিচার্ড কটন।
Nadia 02 Women wordsযুক্তরাজ্যে প্রথম বাংলাদেশি নারী মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাতকারে নাদিয়া শাহ নিজের অনুভূতির কথা ব্যক্ত করে বলেন, বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি বিশ্ব দরবারে তুলে ধরাই হবে তাঁর অন্যতম প্রধান কাজ। যুক্তরাজ্যে তাঁর বেড়ে উঠা, পেশাগত জীবন, রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া এবং ভবিষ্যৎ কর্ম পরিকল্পনা সম্পর্কেও তিনি আলোকপাত করেন।
ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নাদিয়া বলেন, ‘তাদের সকলের সহযোগিতাই আমি কাউন্সিলর নির্বাচিত হই এবং এরই ধারাবাহিকতায় ডেপুটি মেয়র এবং সর্বশেষ মেয়র পদে আসীন হই।’ একজন নারী হিসেবে মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় যুক্তরাজ্যে এবং বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করেন।
মেয়র নাদিয়া শাহ বলেন, ‘লন্ডন আমার কাছে এক অন্যন্য বৈশিষ্ট্যমন্ডিত এলাকা। এখানকার বৈচিত্রময় বিশ্ব সংস্কৃতি, থিয়েটার, সামাজিক সংগঠন, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু মিলে এক অনন্য জায়গা।’ তাঁর পিতা ষাটের দশকের শুরুর দিকে লন্ডনে আসেন জানিয়ে নাদিয়া বলেন, বিলেতের গতিময় সমাজ ব্যবস্থা তাকে অকৃষ্ট করে। তিনি সেখানে ব্যবসার সাথে যুক্ত হন। মা আম্বিয়া ইসলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর মাত্র বারো বছর বয়সে যুক্তরাজ্য যান বলে তিনি জানান। বর্তমানে তারা বাংলাদেশেই স্থায়ীভাবে অবস্থান করতে আগ্রহী উল্লেখ করে নাদিয়া বলেন, কিন্তু তৃতীয় প্রজন্মের টানে এক ধরণের মধুর দ্বন্দ্বে আছেন তারা। সুতরাং সেটা শেষ পর্যন্ত কতটুকু সম্ভব হবে সেটা বলা যাচ্ছে না। নিজের মা-বাবা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে নাদিয়া বলেন, ‘তারা অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে আমাদের চারবোনকে গড়ে তুলেছেন। আমাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য যা করা দরকার তাই করেছেন।  মেয়র নাদিয়া বলেন, ‘আমি সবসময় বাংলাদেশি মূল্যবোধ লালন করি এবং আমার শেকড় নিয়ে আমি এক্সট্রিমলি গর্ববোধ করি।’ নিজের পরিবারে বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং বাংলা সংস্কৃতির চর্চার পাশাপাশি বাংলা ভাষা এবং ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে আরবীর চর্চা রয়েছে বলে তিনি জানান। নিজের তিন সন্তানকে সেই মূল্যবোধেই গড়ে তুলছেন যে মূল্যবোধ তাঁর পিতা-মাতা তাঁকে শিখিয়েছিলেন বলে তিনি মন্তব্য করেন। স্বামীর প্রশংসা করে তিনি বলেন, সবসময়ই তাঁর সহযোগিতার হাত প্রসারিত রয়েছে। ব্রিটেনে তরুণ প্রজন্মের কাছে তাঁর স্বামী একজন আদর্শ উল্লেখ করে বলেন, তরুণদের এগিয়ে নিয়ে যেতে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে তাঁর সম্পৃক্ততা রয়েছে।
Nadia 03 Women wordsবাংলাদেশে স্বপরিবারে নিয়মিত যাওয়া-আসা করেন জানিয়ে নাদিয়া বলেন, নিজের শেকড়ের পরিচয় অক্ষুন্ন রাখতে এবং মাতৃভূমির সাথে যোগসূত্র অব্যাহত রাখাই এর মূল কারণ। তিনি বলেন, সুযোগ পেলেই আমরা বাংলাদেশে যাই। কারণ বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ, ভাষা ও সংস্কৃতি, মূল্যবোধ এবং নৈসর্গিক সৌন্দর্য অনন্য, অতুলনীয়।
নিজের কর্মজীবন সম্পর্কে নাদিয়া শাহ বলেন, লন্ডনে ব্যাংকিং পেশার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ব্যাংকিং পেশায় তিনি দ্রুত উন্নতি লাভ করেন। পাশাপাশি তিনি সামাজিক কর্মকান্ডেও সম্পৃক্ত হন। তরুণ প্রজন্মের উন্নয়ন, সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্পে তিনি ঘনিষ্টভাবে অংশগ্রহণ করেন।
রাজনীতিকে নিজের জড়িয়ে পড়ার ঘটনাকে অপ্রত্যাশিত উল্লেখ করে নাদিয়া শাহ বলেন, প্রবাসী বাংলাদেশি এবং স্থানীয় মানুষের অব্যাহত চাপের কারণে তিনি রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। শুরুতে এ নিয়ে শঙ্কায় থাকলেও কমিউনিটির সকলের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে বিশেষ করে নারী সমাজের অব্যাহত সহযোগিতায়ই তাঁকে সাফল্য এনে দিয়েছে।
মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় কমিউিনিটির জন্য বড় পরিসরে কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই অর্জনে আমি সম্মানিত বোধ করছি। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশিদের সম্মানজনক অর্জনগুলোর মধ্যে এটি একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন বলে তিনি মনে করেন। নাদিয়া শাহ বলেন, বাংলাদেশের একজন দূত হিসেবে যুক্তরাজ্য তথা বহির্বিশ্বে তিনি কাজ করে যাবেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যে একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় দেশ এবং অন্যদের জন্য রোল মডেল ও উদাহরণ হতে পারে সে বিষয়টি বিশ্বের কাছে তুলে ধরাই হবে আমার মূল লক্ষ্য।
মেয়র হিসেবে ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘ লন্ডন একটি বহু সংস্কৃতির শহর। আমি সবাইকে নিয়েই কাজ করতে চাই। সকল ক্ষেত্রে কাজ করতে চাই। ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ না করে মানুষের কল্যাণে বিশেষত কেমডেনের জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়নে কাজ করে যাওয়াই হবে আমার মূল দর্শন।
মেয়ের এই অর্জনে বাবা নজরুল ইসলাম গর্বিত। মেয়ে সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি আমার মেয়েকে নিয়ে সবসময়ই আশাবাদী ছিলাম। স্বপ্ন দেখতাম আমার মেয়ে একদিন এমন কিছু করবে যা অন্যদের জন্য অনুকরীয় হবে।’ যুক্তরাজ্যে প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে মেয়র হওয়া বড় অর্জন মনে করে তিনি বলেন, ‘আমি আশাবাদী আমার মেয়ে আরো অনেকদূর এগিয়ে যাবে।’ সেদিন বাংলাদেশের মুখ বিশ্ব দরবারে আরো উজ্জ্বল হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।