প্রতিকূল পরিবেশে কাজই নতুন কিছু শেখায় - Women Words

প্রতিকূল পরিবেশে কাজই নতুন কিছু শেখায়

বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইয়াহু’র প্রধান নির্বাহী মারিসা মেয়ার। জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনে ১৯৭৫ সালের ৬০ মে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। সার্চ জায়েন্ট গুগলে তাঁর কর্মজীবন শুরু। প্রতিষ্ঠানটির শুরুর দিকের কর্মীদের একজন মেয়ার। ইলিনয়েস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ইন্টারনেট সার্চে অবদানের জন্য হনারিস কসা ডক্টরেট ডিগ্রি গ্রহণের সময় তিনি যে বক্তব্য দেন তার চুম্বক অংশ উইমেন্স ওয়ার্ড -এর পাঠকের জন্য-

 

সবাইকে অভিনন্দন। বিশ্বখ্যাত কলেজ থেকে স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আজ তোমরা গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্মান পেতে চলেছ। নিজের পথ খুঁজে বের করার জন্য গ্র্যাজুয়েশন জীবনের অনন্য এক ঘটনা। আমরা সবাই জানি, কিছু খোঁজার চেষ্টা থেকেই আমরা কিছু না কিছু পাই। যে কারণেই সম্ভবত আমি এখানে। আর গুগল তো পুরোটাই খোঁজাখুঁজির কাজ কারবার। আজ তোমাদের আমি আমার জীবনের কয়েকটি গল্প আর অভিজ্ঞতা শোনাতে চাই।
প্রথমেই ভেবে দেখ এখান পর্যন্ত আসতে তোমাদের কী কী করতে হয়েছে। ১ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হয়েছে। পড়াশোনা করতে হয়েছে ১৩০টি কোর্সে। পড়েই শেষ নয় সেই বাঁধাও অতিক্রম করতে হয়েছ্ েদিনের পর দিন নিজের নিজের শক্তি, চকোলেট, কফি আর পিৎজার পেছনে সময় ব্যয় করতে হয়েছে। বিনিদ্র রজনী কাটাতে হয়েছে পড়াশোনা, ইন্টার্নশিপ, রুমমেটদের জন্য। আজকে তোমরা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সব ধরনের শক্তি আর জ্ঞান অর্জন করেছ।
তোমাদের বলি, তুমি যা করতে আগ্রহী তাই খুঁজে বের করো। এই আগ্রহের পথটাই খুঁজে বের করা জীবনের সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর অন্যতম। আমি এক বিজ্ঞান ক্যাম্প করার সময় আমার জীবনের আগ্রহের কথা খুঁজে পেয়েছিলাম। আমি বিজ্ঞানের প্রতি ভীষণ আগ্রহী ছিলাম। পাগল ছিলাম। বিজ্ঞানের সবকিছুতেই ছিল আমার ভীষণ ভীষণ আগ্রহ আর আনন্দ। হাইস্কুলে পড়ার সময় আমি প্রথম জাতীয় যুব বিজ্ঞান ক্যাম্পে যাওয়ার সুযোগ পাই। হাজার ধরনের মানুষের সঙ্গে আমি গল্প করার সুযোগ পাই তখন। আমি জুন নগুয়েন নামে এক মেধাবী লেকচারারের সঙ্গে পরিচিত হই। সে ছিল পেশাজীবনে চিকিৎসক আর ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। তিনি আমাকে চীনা এক প্রবাদবাক্য একটু বদলে শুনিয়েছিলেন, ‘মানুষ যা জানে সে তা নয়, মানুষ যেভাবে চিন্তা করে সে তাই’। সেই কথা আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময়ও সারাক্ষণ মাথায় ঘুরত।
আমি চিকিৎসক হতে চেয়েছিলাম বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন আর জীববিজ্ঞানের সব কোর্স নিয়েছিলাম। সবকিছু জানার চেষ্টা করতাম। বিজ্ঞান, প্রকৃতি আর পৃথিবী নিয়ে ভাবতাম। তখনই প্রথম বিশ্বাস করা শুরু করেছিলাম, মানুষ যা জানে সে তা নয়, মানুষ যেভাবে চিন্তা করে সে তাই। সবকিছু জানার কৌতূহল থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানের কোর্সেও অংশ নিই। পড়তে পড়তে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে ভীষণ আগ্রহী হয়ে উঠি। আগ্রহ থাকার কারণেই চিকিৎসক না হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করি। সেই ডিগ্রিই আমাকে গুগলে নিয়ে যায়।
নিজের আগ্রহ খুঁজতে তোমাকে প্রথমেই নিজের সঙ্গে সৎ থাকতে হবে। আর নিজের চারপাশে মেধাবী মানুষদের একটা বলয় গড়ে তোলো। মেধাবীদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবে, তোমার কাছ থেকেও তারা শিখতে পারবে। আমার বন্ধু লরা বেকম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভলিবল দলে চান্স না পেলেও প্রতিনিয়ত সে খেলত। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে লরা ভলিবল দলে সুযোগ পায়। সে দলে ঢোকার সুযোগ না পেয়েও কেন খেলত এই প্রশ্নের উত্তরে আমাকে বলেছিল, ‘আমি জানি আমি একসময় ভলিবল দলের সদস্য হবই। আর সে জন্য প্রতিদিন দলের ভালো ভালো খেলোয়াড়ের সঙ্গে অনুশীলন আমাকে আরও শক্ত খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তোলে।’ আমিও বিশ্বাস করি, চারপাশে যখন একদল মেধাবী কর্মঠ মানুষ কাজ করে তখন আমিও ধীরে ধীরে তাদের মতো হয়ে উঠি। আর সেই কারণেই বলতে চাই, নিজে মেধাবী মানুষদের সঙ্গে মিশো, কাজ করো।
গুগলের প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি আর সের্গেইও কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সকালে পিৎজা খেতেন, গোসল করতেন না। এমনকি কারও সঙ্গে ধাক্কা খেলে দুঃখ প্রকাশ করেও কিছু বলতেন না। এখন তাঁরা বড় ব্যবসায়ী, কিন্তু নিজের লক্ষ্যে তাঁরা অটুট। তাঁরা নিজেরা যেমন প্রতিভাবান, তেমনি চারপাশে একদল প্রতিভাবান মানুষের সঙ্গে কাজ করেন। মেধাবী মানুষের সঙ্গে কাজ করে নিজের মেধাকে আরও বিকশিত করা যায়। আরেকটা কথা, নতুন বন্ধু, নতুন সহকর্মী, নতুন মানুষদের সঙ্গে মিশে নিজেকে অনেক বদলে ফেলার সুযোগ আমাদের নেওয়া উচিত। সামনে অনেক সুযোগ আছে, তুমি খুঁজে বের করে তা লুফে নাও। সুযোগ নিজে নিজে সামনে আসে না, খুঁজতে থাকো দেখবে সুযোগ ধরা দেবেই।
সাহসি হতে হবে। যা হয়নি, তা করার সাহস তোমার অর্জন করতে হবে। আমি জীবনে চারটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যার জন্য নিজেই প্রস্তুত ছিলাম না। ১৮ বছর বয়সে বাড়ি থেকে দুই হাজার মাইল দূরের কলেজে পড়তে যাওয়া। জীববিজ্ঞান আর রসায়নে পড়ার ভীষণ আগ্রহ থাকলেও পড়েছি অন্য বিষয়ে। জার্মান না জেনেও সুইজারল্যান্ডের জুরিখে শিক্ষানবীশ হিসেবে গবেষণা করতে যাই। সর্বশেষ, ১৯৯৯ সালে মাস্টার্স শেষ করে গুগল নামে এমন এক উদ্ভট প্রতিষ্ঠানে যোগ দিই, যার মোট কর্মীসংখ্যা তখন ছিল আটজন। সব সিদ্ধান্তই আমি নিজেই নিয়েছিলাম। নিজের ওপর ভরসা রেখে সামনে যাওয়ার উপায় খুঁজে বের করেছিলাম। প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করার আগ্রহই আমাদের অনেক কিছু শেখায়। অনুকূল পরিবেশ আসলেই তো নতুন কিছু শেখা যায় না। তোমাদের বলতে চাই, এমন কিছু করো, যা তোমার জন্য তৈরি নয়, অনুকূল নয়।
সবশেষে বলব, নিজেকে তথ্যের ঝরনা হিসেবে তৈরি কর। সব ধরণের তথ্য জানতে চেষ্টা কর। সৃজনশীলতা আর উদ্ভাবনী কাজই পৃথিবীকে বদলাতে পারে। অন্যকে সহযোগিতা, তথ্য সাহায্য আসলে নিজের বৃদ্ধিমত্তাকেই বাড়িয়ে দেয়।
আমি প্রত্যাশা করি তোমরা নিজের লক্ষ্য খুঁজে বের করবে। পৃথিবীকে নতুন প্রত্যয়ে বদলে দেয়ার দায়িত্ব নেবে।
সবাইকে ধন্যবাদ।