বিস্মৃতি - Women Words

বিস্মৃতি

শবনম সুরিতা ডানা

দুম করে সেদিন একজন জিজ্ঞেস করে বসলেন, “আচ্ছা, আপনার সবচেয়ে বেশি অস্বস্তি কীসে?” এমন প্রশ্নেরও যে কোন উত্তর হয়, বা এমন যে আদৌ কোন প্রশ্ন হতে পারে সেটা তার আগে আমার জানা ছিল না। স্বভাবতই ঘাবড়ে গেলাম। উত্তর দিতে পারলাম না। কিন্ত প্রতিবারের মত এবারো প্রশ্নটা মাথায় গেঁথে গেল।

বিয়েবাড়িতে প্রবল বিরিয়ানি সাঁটিয়ে তারপরের বদহজম আমার চূড়ান্ত অপছন্দ। ডানদিকের চোখে সুনিপুণ হাতে কাজল টানার পর অন্য চোখ আঁকতে গিয়ে দেখি কাজল শেষ-বিরক্তি! বহুদিন পর পরিজনের সাথে দেখা হলে উষ্ণতার উত্তরে ক্ষণস্থায়ী পলকা হাসি আমার প্রবল অস্বস্তির জন্মসূত্র। কিন্ত এই সবকিছুর সাথে হয়ত বা মানিয়ে নেওয়া যায় চেষ্টা করলে। কিন্ত যার সাথে মানিয়ে নেওয়া তো দূর, খানিক ঠকানোও যায়না, সেই যমের অরুচি অস্বস্তির নাম স্মৃতি। স্মরণশক্তি। যা আমার চরম দুর্বলতা।

আমার নামে অপবাদ আছে, আমি কিচ্ছু ভুলিনা। কাজের কথা অবশ্য ভুলে যাই বেমালুম, কিন্ত অকাজের, অপ্রয়োজনীয় স্মৃতিরা আমার কোল পেলে যেন নামতেই চায়না। রিক্সা চেপে সন্তোষপুরের অলিগলি ঘাঁটতে গিয়ে যখন নাকে এসে ঠেকে চালের বস্তার সোঁদা গন্ধ, ফ্ল্যাশব্যাকে আমার তখন বয়েস কমে যায় কয়েক দশক। দেখতে পাই শিলচরের সুভাষকাকুর দোকানে ফর্দ হাতে আমি উঁচু বৈয়মের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছি, আর আমার গোটা শৈশব যেন এক বস্তা চালের নিশ্চয়তা নিয়ে জড়িয়ে ধরছে আমায়।

আরেকদিনের কথা বলি। তখন আমার বয়স বড়জোর আট কি নয়। ভাইকে ঘুম পাড়াতে হবে, বাড়িতে কেউ নেই আর। অথচ এদিকে গোয়ালা দুধ নিয়ে এসেছে। দুধ জ্বাল না দিয়ে রাখলে নষ্ট হবে এবং তাতে দুধের ক্ষতির চেয়ে আমারই ক্ষতি বেশি। কারণ পচা দুধকে আমার মায়ের অত্যন্ত হাই পিচড বকুনি খেতে হয়েছে কখনো বলে কস্মিনকালেও শুনিনি। হালকা আঁচে দুধ জ্বালে বসালাম। ঘ্যানঘ্যান করতে থাকা আধো-ঘুমন্ত ভাইকে নিয়ে বিছানায় গেলাম। কখন যে ভাইয়ের সাথে আমারও চোখে নিদ্রাদেবী নেমে এসেছিলেন, সত্যি বলছি জানিনা। আর ঘুমের মতই বিশ্বাসঘাতকতা করে দুধ গেল পুড়ে। শুধু তাই নয়, সাথে দুধের পাত্রটিও কায়দা করে দুমড়ে মুচড়ে গিয়ে মায়ের গলা চড়বার জন্য কয়েক পিচ ওপরের স্থান পাকা করে দিল। ভাইকে ঘুমে রেখে লেবু, ভিনিগার সহ সবুজ রঙের ভীম সাবান দিয়ে এত ঘষেছিলাম সেই সসপ্যান, মাইরি বলছি দোলখেলার পর নিজেকেও এত রগড়াইনি কখনো। তারপর কী হয়েছিল, বা কার গলা সেদিন সোপ্রানো হিসেবে স্বর্ণপদক পেতেই পারত, সেই গল্পে আর যাচ্ছিনা। শুধু এরপর থেকে পোড়া দুধের গন্ধ পেলে আপনা থেকেই এক হাত কানে ও আরেক হাত গালে আত্মরক্ষার্থক ভঙ্গিতে প্রস্তুত হতে নেয় বড়জোর তিন সেকেণ্ড।

যে দুটি গল্প বললাম, তার একটিও আমায় অস্বস্তি দেয়না। এই স্মৃতির সাথে আমার সখ্য আছে। যে স্মৃতি শুধুই অতীতে বাঁচে, তাদের মধ্যে যন্ত্রণার পরিমাণ অনেকটাই কম। কিন্ত কিছু স্মৃতি থাকে যাদের সাথে আমাদের বর্তমানের ওঠাবসা। যাদের তেমনভাবে বাস্তবে আর কোন অস্তিত্ব নেই, কিন্ত যার বোঝা ঝেড়ে ফেলা এক একটা যুদ্ধের সমান। অতীত হয়ে যাওয়া স্মৃতিরা কষ্ট দেন না। তারা পাথর হয়ে অপেক্ষায় থাকেন সান্ধ্য আড্ডায় গল্পের জোগান হয়ে উঠতে। কিন্ত যে স্মৃতি থেকে ইতিহাস হয়, সেখানেই জমতে থাকে আর্দ্রতা সবচেয়ে বেশি।

কলেজে পড়ার সময় জেনেছিলাম, আফ্রিকা থেকে দাসদের নিয়ে আসা হত জাহাজে করে আমেরিকায়, রাতের অন্ধকারে। তারা তখন সর্বস্বহারা, নগ্ন ক্রীতদাস। নিঃশ্বাস নেওয়া ছাড়া সার্বভৌমত্ব ছিলনা নিজেদের কোনটুকুতেই। অথচ তাদের মাথার ভেতর, একান্তে ঠিকই রয়ে গিয়েছিল কতগুলি গানের সুর আর পরিচয় হারানোর, হেরে যাওয়ার স্মৃতি। এই দুই মিলিয়েই গড়েছিল এক নতুন সাঙ্গীতিক চর্যা, যা পশ্চিমা সঙ্গীতের দুনিয়ায় আলোড়ন এনে দিয়েছিল এককালে। এসবই ইতিহাস। বা আমারই মতন কোন ঐতিহাসিক উদ্বাস্তুর নিছক স্মৃতিচারণ।

আসলে ভুলে যাওয়ার কোন ইতিহাস হয়না। ভুলিয়ে দেওয়ার রাজনীতি হয়। আর ইতিহাস চিরকালই রাজনীতির জন্য বড্ড অস্বস্তিকর।

আমি কোনদিনই কিচ্ছু ভুলিনা, ভুলতে পারিনা। কোন এক কবিতায় পড়েছিলাম, ‘বুকের ভেতর পাথর থাকা ভালো/ আওয়াজ দিলে প্রতিধ্বনি শোনা যায়’

আমাকে কিছুই ভোলানো যায়না। ভালো-মন্দ সব মিলিয়েই আমার স্মৃতিগুলি অনেক ভেতরে কোথাও সারি সারি বৈয়ামে বন্দী। আর ছেলেবেলার মত আমি এখনও ফর্দ হাতে দাঁড়িয়ে আছি, যা চাইছি তা পাবার আশায়।

আমার বুকে কোন স্মৃতি পাথর হয়ে নেই। আছে কতগুলি ফসিল।

আমি কিন্ত ক্রমাগত আওয়াজ দিয়েই যাচ্ছি। অথচ কোন প্রতিধ্বনি শোনা যায়না। বৈয়ামের কাঁচ ভেঙে পড়ার ঝনঝনানিতে আমার গলার স্বর ঢাকা পড়ে যায়। সুগন্ধী চালের পাহাড়ে আমি ডুবে যেতে থাকি।

আমার খুব অস্বস্তি হতে থাকে।