এক সংগ্রামী নারীর হাওর বাঁচানোর লড়াই - Women Words

এক সংগ্রামী নারীর হাওর বাঁচানোর লড়াই

সুনামগঞ্জের হাওরগুলোতে যখন হু হু করে পানি ঢুকতে শুরু করেছে তখন তিনি ঘর ছাড়েন। একে একে হাওরগুলোকে গ্রাস করতে থাকে বানের জল। কিন্তু তখনও নিরাপদ শনির হাওর। হাজারো মানুষের মুখের দিকে চেয়ে এক নারী টানা ২৪ দিন পড়ে ছিলেন বাঁধ রক্ষায় শনির হাওরে। তিনি মনেছা বেগম। জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলী ইউনিয়নের সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য। যদিও শেষ পর্যন্ত তাঁর সংগ্রাম বৃথা গেছে। গত শনিবার মাঝরাতে (রাত ১২টার দিকে) ভেঙে পড়ে তাহিরপুর ও জামালগঞ্জের শনির হাওরের বাঁধের একাংশ। ভোররাতের মধ্যেই বাঁধের তিনদিক থেকে অনর্গল পানি ঢুকে তলিয়ে যায় শনির হাওরে বেঁচে থাকা বোরো ধানের শেষ সম্বলটুকু। তবু এই নারীর গল্প প্রেরণা হয়ে থাকবে হাওরের বাতাসে।

বাধ রক্ষায় চৈত্র মাসের ১১ তারিখ শনির হাওরে গিয়েছিলেন মনেছা বেগম। এরপর একটানা ২৪ দিন কাটিয়ে দেন সেখানে। তাঁর ভাষায়, ‌‌‌‌‘জানটা দিয়া দিলাম, কিন্তু বানধ বাঁচাইতে পারলাম না’‌।

মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে রোববার (২৩ এপ্রিল) ভোররাত পর্যন্ত ২৪ টি দিন ও রাত তিনি কাটিয়েছেন শনির হাওরে। বাঁধ রক্ষায় কাজ করে গেছেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। শনিবার মাঝরাতে (রাত ১২টার দিকে) ভেঙে পড়ে তাহিরপুর ও জামালগঞ্জের শনির হাওরের বাঁধের একাংশ। ভোররাতের মধ্যেই বাঁধের তিনদিক থেকে অনর্গল পানি ঢুকে তলিয়ে যায় শনির হাওরে বেঁচে থাকা বোরো ধানের শেষ সম্বলটুকু। মানেছা বলেন, হাওর বাঁচাতে গিয়ে আমি আমার দুধের গরুটাও বিক্রি করে দিছি। এর তার কাছে হাত পাতছি, সাহায্য নিছি, তবুও বাঁচাতে পারলাম না। এখন আমার সংসারই বা চলবে কেমনে, আর পুরো এলাকার মানুষই বা বাঁচবে কেমনে?

মনেছা বেগম জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলী ইউনিয়নের সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য। পেশায় দিন মজুর মানেছাকে এলাকাবাসী গত নির্বাচনে চাঁদা তুলে নির্বাচনে প্রার্থী করেন। এতে বিজয়ী হয়ে ইউনিয়নের ৭. ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। নির্বাচনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত শ্রমজীবীর জীবনযাপন করা এ নারী হাওর রক্ষা বাঁধ প্রকল্পের পিআইসির অন্তর্ভুক্ত একটি প্রকল্পের কাজ করছিলেন শনির হাওরে।

মনেছা বেগম জানান, হাওরে পিআইসির কাজের জন্য বরাদ্দ ছিল ৫ লক্ষ টাকা। তার মধ্যে তিন দফায় আড়াই লক্ষ টাকার মতো পেয়েছেন, কিন্তু কাজ করেছেন পুরোপুরিই। আর বাকি টাকার কাজ ঋণ করেই করতে হয়েছে। এদিকে হাওরে ঠিকাদারি কাজের অংশে বাঁধ ভাঙতে শুরু করে, তখন থেকেই উপজেলা পরিষদ ও প্রশাসনের সামান্য সহযোগিতায় স্বেচ্ছাশ্রমে পুরো বাঁধ এলাকায় কাজ শুরু করেন তিনি।

জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রসূন কুমার চক্রবর্তী বলেন, মনেছা বেগমের পরিশ্রম হাওর সংগ্রামের এক অনবদ্য উদাহরণ। তার সাথে কাজ করেছেন আরো হাজারো মানুষ। আমরাও চেষ্টা করেছে প্রয়োজনমতো বাঁশ, বস্তা ও টাকা দিয়ে সাহায্য করতে। কিন্তু এখন বাঁধের সাথে সাথে ডুবেছে হাওরাঞ্চলের বেঁচে থাকা শেষ ধানের জমিগুলোও।

এ প্রকল্পের কাজ শেষ হতে না হতেই অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হাওরে পানি বাড়তে থাকে আর বাঁধের অন্যপাশে যেখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদারের একটি বাঁধ নির্মাণের কাজ ছিল, তা ভাঙতে শুরু করলে মনেছা বেগমসহ স্থানীয়রা হাওরের ধান বাঁচাতে স্বেচ্ছায় কাজ শুরু করেন পুরো বাঁধেই। তবে শেষ পর্যন্ত তার সাথে সাথে সুনামগঞ্জের শনির হাওর পাড়ের এই দুই উপজেলার ৪০টি গ্রামের হাজারো মানুষের গত ২৪ দিনের অক্লান্ত পরিশ্রম ডুবে গেছে পানির নিচে।

মনেছা বেগম ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হয়েও যে পরিশ্রম করেছে শনির হাওরের বাঁধ বাঁচাতে, তা জামালগঞ্জ-তাহিরপুরের সাধারণ মানুষের কাছে একটি কঠিন সংগ্রামের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমন মন্তব্য স্থানীয়দের। বেহেলী ইউনিয়নের সচিব মো. হান্নান মিয়া বলেন, মনেছা বেগম হাওরে পানি বাড়ার দিন থেকে স্বেচ্ছায় যে পরিশ্রম করেছেন সবাইকে নিয়ে, তা এক কথায় অসাধারণ। কিন্তু অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয়, তাঁর এত পরিশ্রম শেষ পর্যন্ত বৃথা হয়ে যায় নতুন করে শুরু হওয়া প্রবল বর্ষণ ও ঢলে।

গতকাল রোববার (২৩ এপ্রিল) ভোররাত পর্যন্ত মোট ২৪ দিন মনেছা কাটিয়েছেন বাঁধের পাড়েই। সারাদিন-রাত কাজ করে যখন ক্লান্তি অনুভব করেছেন, ঘুমিয়েছেন পাশের একটি বাজারে, কখনোবা নৌকাতেই। দিনরাত বাঁধের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে ছুটে গেছেন তিনি, তবুও শনিবার মাঝরাত থেকে আর শেষ রক্ষা হয়নি শনির হাওরের। আর দীর্ঘ সংগ্রামের শেষে রবিবার সকালে মনেছা বেগম ফিরে গেছেন বাড়িতে। জামালগঞ্জের বেহেলী ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি। দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার। বড় ছেলে দিনমজুরির কামাই আর মনেছা বেগমের ইউনিয়ন সদস্যপদের ভাতা দিয়েই চলে এই নারীর সংসার।

সূত্র : সিলেটটুডে২৪