এক শহীদ জননীর কথা - Women Words

এক শহীদ জননীর কথা

সাহাদাত পারভেজ

রাবেয়া খাতুনের বড় ছেলে আবদুল আউয়াল। মুক্তিযুদ্ধের সময় আউয়াল পড়ত পঞ্চম শ্রেণিতে। সে ছিল চার ভাই বোনের  মধ্যে সবার বড়। বাবা বাইরে সামান্য চাকরি করতেন। তাই মায়ের কাছে ছিল তার সমস্ত বায়না। গ্রামের ছেলে, তাই সহজ সরল তার চাওয়া-পাওয়া। এক সকালে আউয়াল তার মায়ের কাছে মাংস খাওয়ার বায়না ধরে। মা খোয়ার থেকে একটি পোষা মুরগি বের করে ছেলেকে জবাই করতে দেন। মুরগি জবাই করে ছেলে দাঁড়িয়াবান্দা খেলতে চলে যায় ফজর আলীর বাড়ির পেছনে। মা রান্না-বান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ তিনি গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। লোকজন আতঙ্কিত হয়ে বলতে শুরু করল, ‘বাজারের কাছে আর্মিরা ঢুকে পড়েছে। যাকে সামনে পাচ্ছে, মারছে। দ্রুত বাড়ি থেকে পালান।’

আউয়াল ছাড়াও রাবেয়া খাতুনের ছোট ছোট আরও তিন সন্তান। আউয়ালের বয়স তখন বারো। সেলিমের বয়স ছয়, মাকসুদার তিন। আর কোলে দেড় বছরের মিজান। রান্নাবান্না ফেলে অবুঝ এই তিন সন্তানকে নিয়ে রাবেয়া খাতুন গ্রাম ছেড়ে পালান। জীবনের ভয়ে আশ্রয় নেন হোগলাকান্দি গ্রামে, তার ছোট বোন রহিমা খাতুনের শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু বিকেলে যে এমন একটি ঘটনা শুনতে হবে, সেটা কখনো ভাবতে পারেননি রাবেয়া খাতুন।

৭ ডিসেম্বর ১৯৭১। মঙ্গলবার। হানাদার বাহিনীর নির্মমতায় শহীদ হন রাবেয়া খাতুনের বুকের ধন, আবদুল আউয়াল। খেজুরকাঁটা দিয়ে যেমন করে আমের মোরব্বা বানানো হয়, সে রকম বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় তাকে। ছেলের ওপর এমন পাশবিক নির্যাতন কখনো ভুলতে পারেন না রাবেয়া খাতুন। মাঝেমধ্যেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। প্রায় রাতে তিনি ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে ওঠেন। যন্ত্রনায় ছটফট করেন।

আমি মাঝে মাঝে ভাবি, তিনি কেমন করে বেঁচে আছেন! রাবেয়া খাতুনের জন্য আমি সব সময় গর্ব অনুভব করি। কারণ বাংলাদেশের অসংখ্য শহীদ জননীর সারিতে তিনিও একজন। শিশুকাল থেকেই আমি এই শহীদজননী কাছ থেকে মাতৃস্নেহ পেয়েছি। বিমূর্ত এই জননী সম্পর্কে আমার জেঠিমা। কিশোর বয়সেই জেঠি আমাকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতেন। তার মুখে যুদ্ধের বর্ণনা শুনে আমি শিহরিত হতাম। জেঠি ঘুরেফিরে তার ছেলে হারানোর কষ্টের কথা বলতেন। অঝরে চোখের জল ফেলতেন। আঁচল দিয়ে অশ্রু মুছতেন। মৃত্যুর আগে ছেলে মুরগির মাংস খেতে চেয়েছিল। ছেলের সেই ইচ্ছে পূরণ হলো না! তাই রাবেয়া খাতুন এই জীবনে আর কখনো মুরগীর মাংস ছুঁয়ে দেখলেন না।

মুক্তিযুদ্ধের চলাকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ছিল মৃত্যু ফাঁদ। তখন এর প্রতিটি ব্রীজ, কালভার্টের নিচে ছিল হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প। পাকবাহিনী সড়ক ঘেঁষা গ্রামগুলোতে ঢুকে মানুষের উপর জুলুম-অত্যাচার করতো। ফলে মহাসড়কের বিভিন্ন সেতু বিচ্ছিন্ন করা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে। আগের দিন তারা গ্রামবাসীর সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন। সিদ্ধান্ত হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের চারটি দল সশস্ত্র অবস্থায় থাকবেন সড়কের পাশ ঘেঁষে। এক দল থাকবেন আলীপুরা সেতুর কাছে আর আরেক দল মধ্য বাউশিয়ায়। হানাদার বাহিনীর জিপ দেখলেই চালানো হবে গুলি।

সকাল থেকেই ভবেরচর ঈদগাঁর কাছের কাঠের সেতুটি ভাঙতে শুরু করেন দুই শয়ের বেশি স্বাধীনতাকামী মানুষ। তাদের এই অপারেশনে সহায়তা করতে যায় জনা বিশেক কিশোর। সেই দলে আউয়ালও ছিলো। বেলা তখন সাড়ে এগারোটা। সেতু ভাঙার কাজ প্রায় শেষ। হঠাৎ আলীপুরার দিক থেকে দ্রুত আসে একটি মাইক্রোবাস। মুক্তিবাহিনী ভাবতে পারেনি, এটা হানাদারবাহিনীর। তাই তারা গুলি চালানোর চেষ্টা করে নি।
কোনো রকম প্রতিরোধ ছাড়াই মাইক্রোবাস চলে আসে সেতুর কাছে। সেতু ভাঙতে দেখেই প্রবল আক্রোশে হানাদার বাহিনী ব্রাশ ফায়ার শুরু করে। জীবন বাঁচাতে সবাই পালাতে শুরু করে। কিন্তু পালাতে পারে না সেই কিশোরের দল। তারা পাশের কবরস্থানে গিয়ে লুকানোর চেষ্টা করে। তখন কবরস্থানটি ছিলো ঝোপঝাড়ে ঘেরা। সেখানে গিয়ে পাকবাহিনী ১০ জনকে হত্যা করে। ক্ষোভ আর আক্রোশে তাদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এদের মধ্যে কেবল সুভাস চন্দ্র দাস জুইন্না নামের এক কিশোর একটি কবরের গর্তের ভেতর ঢুকে প্রাণে বেঁচে যায়। মুক্তিযুদ্ধের এত এত ঘটনার কাছে এটা হয়তো খুব বড় কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু এরকম ছোট ছোট শিশিরবিন্দু দিয়েই তো রচিত হয়েছে আমাদের পূর্ণাঙ্গ মুক্তিযুদ্ধ।

সেদিনের ওই নারকীয় হত্যাকান্ডের পর হতভাগ্য কিশোরদের লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে কবরস্থান আর মহাসড়কের কাছে। চরপাথালিয়া গ্রামের সাহসী যুবক গাজী সিকদার। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন মাটিতে পড়ে আছে কয়েকজনের রক্তাক্ত দেহ। গাজী চাচা আমাদের আত্মীয়। তিনিই আউয়ালের লাশ মাথায় করে বাড়ি নিয়ে আসেন। আমাদের উঠানে লাশ রেখে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। শূন্য বাড়িতে ধানের গোলায় লুকিয়ে ছিলেন বয়োবৃদ্ধ আমজাদ আলী, আমার দাদার ছোট ভাই। তিনি অনেক খুঁজে হোগলাকান্দি গিয়ে জেঠিকে দেখতে পান। সব কিছু খুলে বলেন। বাড়ি এসে জেঠি দেখতে পান নাড়িছেড়া ধনের ক্ষত-বিক্ষত লাশ।

গল্পে গল্পে জেঠি একদিন বলেছিলেন, আগের রাতে আমার দাদা নাকি একটি খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলেন। সকালে ঘুম থেকে ওঠে তিনি তার বড় নাতি আউয়ালকে বলেছিলেন উত্তরে আর পুবে না যেতে। পুবদিকেই ঘটল ঘটনা। দাদার স্বপ্ন যে সত্যি হবে, কে জানত!
বিকেলে বাড়ির পাশের কোলার খেতে তড়িঘড়ি করে দাফন করা হয় শহীদ আউয়ালের লাশ। সন্ধ্যায় খবর আসে, পাকিস্তানি বাহিনী রাতে আবারও হামলা চালাতে পারে। জেঠিকে বলা হয় গ্রাম ছেড়ে পালাতে। জেঠি বলেন, ‘মরতে হয় মরব, তবু বাড়ি ছেড়ে আর কোথাও যাব না।’ ছেলে শোকে কাতর রাবেয়া খাতুন অবুঝ শিশুদের বুকে নিয়ে শঙ্কা আর আতঙ্কে রাত কাটান। আমার জেঠা আবদুর রহমান চাকরি করতেন ময়মনসিংহে। তিনি ছেলের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেশ স্বাধীন।

আউয়াল ছাড়াও সেদিন পাক বর্বরতায় নিহত হয় মতিউর রহমান জাহাঙ্গীর, মোহাম্মদ হোসেন ব্যাপারী, শাহাদাত হোসেন, ইসমাইল সরকার, হরিপদ ঠাকুর, উমেশ মালি, রুহুল আমীন, শাহজালাল মৃধা ও মো. ইব্রাহিম। দেশের স্বাধীনতার জন্য এই দশ জনের আত্মত্যাগের কথা আমরা হয়তো স্বাভাবিক ভাবেই ভুলে গেছি। কিন্তু ভুলেনি রাবেয়া খাতুন। ছেলেহারা এই মায়ের চোখ এখনো মাঝেমাঝেই সজল হয়ে ওঠে। আমি তার সজল চোখে খুঁজে বেড়াই এক শহীদ জননীর গর্বিত অবয়ব।

এই গর্বিত জননীর সামান্য পরিচয় আমি তুলে ধরতে চাই। তার মত সরল মানুষ আমি জীবনেও দেখি নাই। খুব সাধারণ তার জীবন। ১৫ বছর বয়সে বউ হয়ে এসেছিলেন আমাদের বাড়ি। কালীপুর গয়জন সরকার কান্দির কাঠ ব্যবসায়ী ওসমান ব্যাপারীর মেয়ে তিনি। দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। জেঠি বলেন, তার বিদ্যাবুদ্ধির জোড় আলীফলামের বারো পাতা পর্যন্ত। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন শহীদের মা। হাতের তালুর সমান এই জীবনে এরচেয়ে বেশি আর কী সম্মান হতে পারে মানুষের?

আমাদের পুরনো বাড়ির যে ঘরে আশ্বিনের শিশির ভেজা সকালে আমি জন্মেছিলাম, সেই ঘরে এখন বসবাস করেন রাবেয়া খাতুন। হারানো ছেলের জন্য তিনি একাকী হাহাকার করেন।