রবীন্দ্রনাথ কোনোদিন আমাকে কল করেননি - Women Words

রবীন্দ্রনাথ কোনোদিন আমাকে কল করেননি

ডাঃ রাজীব দে সরকার

ঘুম ভাঙলো একা একাই।

একটু ঘেমে গিয়েছি।
চোখ খুলে একবার মনে হলো, নিজের ঘরটাকেও চিনতে পারছি না।

মোবাইলটা বাজছে। সম্ভবতঃ এ কারণেই ঘুম ভেঙ্গেছে।

– হ্যালো, কে? (ঘুম এখনো কাটেনি আমার কন্ঠে)
– আমি শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জোড়াসাঁকোর। তুমি এক সময় আমার কবিতা পড়েছো।

– ও, কি চাই? আমি ভ্যাকসিন সংক্রান্ত কাজে জড়িত নই।
– আমার ভ্যাকসিন লাগবে না, বাবা।
(“বাবা” বলায় একটু ঘুম কাটিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলাম। কারন রোগীদেরকে ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করতেন আমার সার্জারীর গুরু)

– ও, কেন ফোন দিয়েছেন, কেউ কি অসুস্থ?
– হ্যাঁ অসুস্থ। সেটা বলতেই ফোন দেওয়া।

– জ্বী, বলুন। আমি শুনছি।
– বৈদ্য রাজীব, তোমার সমাজের একদল পুরুষ খুব অসুস্থ।

– আচ্ছা কাল হসপিটালে পাঠিয়ে দেবেন, দেখে দেবো।
– পারবে তো দেখে দিতে? আচ্ছা, একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো। তোমরা কবিতা পড়া ছেড়ে দিলে কেন?

– কবিতা পড়া ছাড়িনি তো।
– মিথ্যা কথা। তোমরা এখন কবিতা পড়ো না। আগের পড়া কবিতাগুলো কোটেশন অভ্র দিয়ে লিখে ফেইসবুকে পোস্ট করো। শেয়ার করো। ব্লগে লেখো। কিন্তু কবিতা আর পড়ো না।

– ও, তাহলে বোধহয় ভালো লাগে না। আপনি লেখেন এখনো?
– না। লেখার প্রয়োজন পড়ে না। কবিতা-গল্প কিছুই লিখি না

– কেন?
– তোমাদের সমাজে নিরুপমা, কেটি, বিনোদিনী, গোরা কিংবা হৈমন্তী এরা আজো কেউ ভালো নেই। অপু সেদিনও ওর বাবার করা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে নি, আজও একজন মেয়ে লাঞ্ছিত হলে তোমরা প্রতিবাদ করো না। তোমাদের চোখের সামনে জলজ্যান্ত মেয়েদের সম্ভ্রমহানি হয়। তোমরা প্রতিবাদ করো না।

– নাহ। প্রতিবাদ তো করি।
– দৌড়ে গিয়ে ফেইসবুকে বসে টিপাটিপি শুরু করলে তাকে কি প্রতিবাদ বলে? প্রোফাইল পিকচার টা কালো রঙের করে দিলেই বুঝি প্রতিবাদ হয়? গান্ধী – মুজিবরা এই শিখিয়েছিলো তোমাদের?

– না, আমরা বীরের জাতি, আমরা অন্যায় সহ্য করি না।
– এজন্যই আমি গল্প-কবিতা লেখা ছেড়েছি।

– মানে?
– নিজেকে বীরের জাতি ভেবেই লেখালেখি করতাম। কিন্তু তোমাদের নির্বুদ্ধিতায় আমারই লেখা নারী চরিত্ররা আমাকে অপমান করে। আমারই লেখা ধর্মান্ধ চরিত্রগুলো আমাকে দেখে হাসে।

– পহেলা বৈশাখের কথা বলছেন? নাকি বাউলের চুল কেটে দেওয়া? নাকি মৌলবাদীদের ফতোয়া? আমি বুঝতে পারছি না।
– কুষ্টিয়ায় ছিলাম কিছুদিন। বাংলাদেশ গেছি বহুবার। এমন বাংলাদেশ আমরা রেখে আসিনি। হানাদার নেই যে দেশে, সে দেশে আমাদের কন্যাদের ধর্ষণ করে কারা? কেন আজো আমার দেশের বাতাস একজন অত্যাচারিত মেয়ের চিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে, বলতে পারো?

– আপনি রাজনৈতিক কথা বলছেন।
– “মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে… পার হয়ে আসিলাম… আজি নব প্রভাতের শিখর চুড়ায়; রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়, আমার পুরানো নাম, … ফিরিবার পথ নাহি”

– থামেন, মাঝরাতে কবিতা ভালো লাগছে না
– থামলাম, কিন্তু মানুষের চিকিৎসার পাশাপাশি সমাজের চিকিতসা শুরু করো বৈদ্য।

– সে দায় কি আমার একার নাকি?
– দায় আমাদের সবার। হৈমন্তীর গা থেকে কাপড় খুলে নেওয়া হলে, ওর আগে তোমার সমাজ ল্যাংটা হবে, তুমি ল্যাংটা হবে – সাদা পাঞ্জাবী পরে শরীরের কালো লুকানো যায়, মনের কালি না। তাই সমাজের চিকিৎসা করার দায় বৈদ্য-বণিক-শিক্ষক-ছাত্র-সাহিত্যিক-ব্লগার সবার!

– কি করবো?
– তোমার যতোটুকু করার আছে।

– যদি আমার ক্ষতি হয়?
– তোমার ঘরের সামনে তোমারই প্রেয়সীর কাপড় ধরে টানা হলো। এর থেকে আর কি ক্ষতিই বা হতে পারে। এটা তো ১৯৭১ না। নাকি তোমরা মনে করো, মরে যাওয়া পাকিস্তানি হানাদারগুলো, তোমাদের শরীরে আবার জন্ম নিয়েছে?

– ছিঃ ছিঃ এসব কি বলেন?
– আমার লেখা গানটাকে এবার ছেড়ে দাও। ওটা নিয়েও তোমাদের জাতের রশি ঢিলে হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া এক মালাউন কবির গান দিয়ে কেন তোমরা দেশের সব শুভ কাজ শুরু করবে?

– আমার ঘুম পাচ্ছে, কাল সকালে হসপিটালে যাবো।
– বেশ, বাঙালি জাতি হিসেবে তুমি ঘুমিয়ে যাও। ঘুমিয়ে থাকো। ঠিক যেমন করে আমার নোবেলটি চুরি গেলো, তোমার-তোমাদের প্রতিবাদ করার শক্তিটুকুও নিঃশব্দে চুরি গেছে তা তোমরা জানো না।

– আচ্ছা আপনি আমাকে এসব বলছেন কেন, হ্যালো… … শুনছেন…
– টু… টু… … টুট…টু

আমি ঘুমিয়ে গেলাম, অনেক গভীর সে ঘুম…
আমার সামনে আমার সমাজের মেয়েরা আক্রান্ত হলেও ভাঙে না সেই ঘুম…
আমার সামনে রেলস্টেশনে কয়েকজন মিলে একজন নারীর কাপড় ধরে টানলেও ভাঙে না সেই ঘুম। যে দেশে হানাদার নেই, চরিত্রহীন জমিদার নেই, তারপরেও মেয়েদের সম্ভ্রম হানি হলে ভাঙে না সেই ঘুম… সেই ঘুম পাচ্ছে আমার…

পুনশ্চঃ
আজ নারী দিবস না। এটা নারী দিবসের লেখা না। যে দেশে বাঁধাহীন ভাবে পথে ঘাটে একজন নারী কিংবা একজন পুরুষের সম্মান ক্ষুন্ন হতে পারে, এটা সেই ‘প্রতিবাদ করতে ভুলে যাওয়া’ মানুষের দেশের জন্য লেখা। ভাগ্যিস আমরা সেই দেশে থাকি না!

লেখক: রেজিস্ট্রার, সার্জারী বিভাগ (৩৩ বিসিএস)
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল