আমাদের শুভবুদ্ধির উদয় কবে হবে? - Women Words

আমাদের শুভবুদ্ধির উদয় কবে হবে?

মাসরুর রাসেল

ফখরুদ্দিন-মহিউদ্দিনের সময়ে গ্রামের মানুষ টিভির লাইসেন্স সংক্রান্ত জটিলতা বুঝতে না পেরে অনেকে ঘরের চাল, ধানের গোলায়, লাউয়ের মাচাসহ বিভিন্ন জায়গায় টিভি লুকিয়ে রাখত। প্রতিদিনই খবর রটতো আজ অমুক গ্রামে দুইশ টিভি, কাল তমুক গ্রামে তিনশ চিভি  সেনাবাহিনী নিয়ে গেছে। টিভিওয়ালা পরিবারগুলোর যে কি পরিমান শারীরিক এবং মানসিক ভোগান্তি সহ্য করতে হয়ছে, তা মুখে বলে বোঝানো যাবে না। এ ধরণের হুজুগে খবরগুলোর উৎপত্তস্থিল মাতবর গোছের লোকেরা। তারা চা দোকানে বসে বসে বিভিন্ন মুখরোচক আলোচনা করতে থাকত, আর তাদের অতি উৎসাহি মুরীদরা আরো বাড়তি কিছু যোগ করে সেসব খবর প্রচার করতে থাকত। বেডরুম থেকে বঙ্গ ভবন কোন কিছুই বাদ যায় না তাদের আলোচনা থেকে ৷ এক কান, দু’কান করে এক গ্রাম থেকে  আরেক গ্রামে এভাবে পুরো জেলায় এসব হুজুগে খবর জনপ্রয়ি হয়ে উঠে। মানুষের মুখে মুখে রটে যাওয়া এসব খবরে নিরক্ষর লোকেরা আস্থা রাখলেও, শিক্ষিত লোকদের নির্ভরতার প্রতীক ছিল বিভিন্ন গণমাধ্যম। কিন্তু গত কয়েক বছরে বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়ে দলদাসের ভূমিকা পালন এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন সংবাদ পরিবেশন করে কিছু গণমাধ্যমর্কমী নিকৃষ্ট প্রাণীতে পরিণত হয়েছে।

গণমাধ্যম নিয়ে নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। ফ্রেন্ডলিস্টের এক বড় ভাইয়ের ইটালি প্রবাসী মামাত ভাই ছুটিতে দেশে আসার দুদিন পর তার বাড়িতে ডাকাতি হয়। ডাকাতদের আঘাতে ভদ্রলোকের দশ বছর বয়সী মেয়ে মারা যায়। স্ত্রী এবং তিনি নিজেও আহত হয়ে হাসপাতালে র্ভতি হন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটা পত্রিকা হেডলাইন করেছে,  “স্ত্রীর পরকীয়ার জেরে প্রবাসীর সন্তান খুন”।ভদ্রলোক আহত হলেন, সম্পদ হারালনে, সন্তান হারালেন, মান-সম্মানও হারানোর দশা৷ কতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন আর নিকৃষ্ট হলে এমন সংবাদ পরিবেশন করা যায়! বিভিন্ন সময়ে এভাবে বিভিন্ন প্রকার ভুয়া সংবাদ পরিবেশনের জন্য আমাদের গণমাধ্যমগুলো তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। সেক্ষেত্রে ফেসবুক আমাদের জন্য বিকল্প গণ মাধ্যম ৷ ডঃ তুহিন মালিকের মত, “অশিক্ষিত লোকগুলো সংসদ চালায়, আর শিক্ষিত লোকগুলো ফেসবুক চালায় ৷” কিন্তু আমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থা একজন শিক্ষিত এবং নিরক্ষর লোকের মানবিক মূল্যবোধ ও মানসকি চিন্তাধারায় তেমন কোন র্প্রাথক্য সৃষ্টি করতে পারেনি ৷ কিছুদিন র্পূবে একজন বৃদ্ধ লোকের ঘাড়রে উপর বসে মোবাইলে কথা বলা এক ভদ্রলোকের ছবি প্রকাশ হয় ফেসবুকে ৷ পরবর্তীতে দেখা গেলো ভদ্রলোক একজন শিক্ষক এবং কেউ ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে এডিট করে ফেসবুকে ছবিটি প্রচার করেছেন ৷ ততদিনে ছবিটি ভাইরাল হয়ে গেছে। ভদ্রলোক এটা নিয়ে ভীষণ মানসিক যন্ত্রণাতে আছেন৷ অনেককেই দেখলাম শ্রমিকলীগ নেতা কর্তৃক নির্যাতনের শিকার মা-মেয়ের ছবি প্রকাশ করেছেন, কিন্তু এই ছবি প্রকাশের ফলে তাদের জীবনে কি দুর্বিষহ বিভীষিকা নেমে আসবে তা কি আমরা একবারও চিন্তা করেছি? আমাদের সমাজে একজন ধর্ষিতা নারীকে কেউ মেনে নেয় না। যার কারণে ধর্ষণের শিকার কেউ সহজে মুখ খুলতে চায় না, আর কেউ যদি মুখ খুলে, জনসম্মুখে আমরা তার ছবি প্রকাশ করে তার ক্ষতকে আরো বাড়িয়ে দেই। আমাদের উচিত ছিল সমাজের সামনে ধর্ষককে তুলে ধরা, কিন্তু আমরা করছি উল্টোটা। আমাদের উদ্দেশ্য মহৎ কিন্তু পদ্ধতি সঠিক নয় ৷

অধিকাংশ সময় মানুষকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ যাচাই না করে আমরা অনেক খবর প্রচার করি। যেখানে আমরা নিজেরাই সচতেন নই, সেখানে আমরা অন্যদের সচেতন করব কিভাবে? আমাদের অসচতেনতাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন দল, গোষ্ঠী, ব্যক্তি হুজুগ তৈরি করে ফায়দা লুটে। আমরা যারা ফেসবুকে চিলে কান নিয়েছে শুনেই দৌড় মারি, তাদেরকে অবশ্যই আগে কানে হাত দিয়ে দেখতে হবে ৷ অন্য দিকে যারা বিভিন্ন দল, গোষ্ঠীর র্স্বাথে বা লাইক কমেন্ট বাড়ানোর আশায় বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশ করি, তাদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে খবরটা কতটুকু সত্য, এ সংবাদ প্রকাশের ফলে কোন সৎ, নিরীহ, দুর্বল লোক ক্ষতিগ্রস্থ হবে কি না। আমাদের দল, মত, আদর্শ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু এসব যেন আমাদের মানবিকতা, সহনশীলতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, পরকালকে ক্ষতিগ্রস্থ না করে। আমাদের মনে রাখতে হবে, হাশরের মাঠে আলেয়ার বাপের আদর্শ, ছালেহার স্বামীর দল, ফেসবুকের ফ্রেন্ডস-ফলোয়ার, এসব কোন কাজেই আসবে না।