ইতিহাসে ম্যান্ডেলার পুত্র বিয়োগ - Women Words

ইতিহাসে ম্যান্ডেলার পুত্র বিয়োগ

Yahya Fazalনেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার থেম্বু রাজবংশের ক্যাডেট শাখায় ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। বেঁচে  থাকলে তাঁর বয়স এখন ৯৮ বছর হতো।  বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের এই মহান নেতাকে নিয়ে সাংবাদিক  ইয়াহইয়া ফজল লিখেছেন-  ‘  আমৃত্যু নেলসন ম্যান্ডেলা : এক মহামানবের জীবনরেখা’ গ্রন্থ। কিংবদন্তি  প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই গ্রন্থের অংশ বিশেষ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। এখানে নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনের এক করুণ অধ্যায় আলোচিত হয়েছে-

নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনের সাতাশটি বছর কেটেছে কারা প্রকোষ্ঠে। সেখানেই বসে তিনি মা’র মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলেন। সেই বেদনা কাঠিয়ে উঠতে না উঠতে পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৯ সালে পেলেন পুত্রের মৃত্য সংবাদ। ১৯৬৯ সালের এক বিকেলে অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছ থেকে কমান্ডিং অফিসার একটা টেলিগ্রাম পেলেন। তাতে লেখা- ‘অনুগ্রহপূর্বক নেলসন ম্যান্ডেলাকে অবহিত করবেন যে, তাঁর (ছেলে) থেম্বেকিল চলতি মাসের ১৩ তারিখে কেপটাউনে মোটর দুর্ঘটনায় মারা গেছে।’
ছেলের মৃত্যুর সংবাদ আবেগাপ্লুত করেছিল দৃঢ় ম্যান্ডেলাকে। ছেলের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর ১৬ জুলাই স্ত্রী উইনিকে চিঠি লিখেন ম্যান্ডেলা-
আমার পক্ষে বিশ্বাস করাই কষ্টকর ছিল যে, আমি আর থেম্বিকে দেখতে পাব না। এ বছরই ফেব্রয়ারির ২৪ তারিখে ওর বয়স হয়েছিল ২৪ বছর। ১৯৬২ সালে আমার বিদেশ থেকে ফেরার কয়েক দিন পরেই জুলাই মাসের শেষ দিকে আমি তাকে শেষবারের মতো দেখেছিলাম। তখন সে ছিল ১৭ বছরের এক নাদুসনুদুস কিশোর। তার সঙ্গে আমি কিছুতেই মৃত্যুকে মেলাতে পারছি না। সে আমার একটি ট্রাউজার পরেছিল, যেটা ওর জন্য এক দাগ বড় ছিল, এমনকি লম্বাও। ইঙ্গিতবহ সেই ঘটনাটি নিয়ে আমি ভেবেছি। তুমি তো জানো, ওর অনেক পোষাক ছিল, আর পোষাক নিয়ে ওর বাছবিছারও ছিল। তাই আমার পোশাক পরার কোনো প্রয়োজনই ওর ছিল না। ওর সে আচরণের আবেগের দিকটা ছিল খুবই স্পষ্ট। সেটি আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। পরের বেশ কয়েকটি দিন আমি মনেপ্রাণে তীব্রভাবে আলোড়িত হয়ে ভেবেছি, বাড়িতে আমার অনুপস্থিতি আমার সন্তানদের ওপর কী গভীর চাপ ও প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। আমার মনে পড়েছিল, ১৯৫৬ সালে জোহানেসবার্গ দুর্গে বিচারাধীন বন্দী থাকার সময়ের কথা। তখন কাগঙ্গোর বয়স মাত্র ছয়। সে পূর্ব ওরল্যান্ডোতে থাকত। সে জানত আমি বন্দী অবস্থায় রয়েছি, তবু সে পশ্চিম ওরল্যান্ডোতে গিয়ে মায়ের কাছে বলেছিল, সে আমাকে দেখতে চায়। ওই রাতে সে আমার বিছানায় ঘুমিয়েছিল।
এবার থেম্বির সঙ্গে আমার সাক্ষাতের কথায় আসছি। বোডিং স্কুলে যাওয়ার পথে সে আমাকে বিদায় জানাতে এসেছিল। এখানে এসে সে আমাকে খুবই উষ্ণ অভিবাদন জানায়, কিছুক্ষণ আমার হাত ধরে রাখে। তারপর বসে কথা বলতে শুরু করে। আলোচনাক্রমে তার পড়াশোনার কথা উঠতেই সে আমাকে, তার তখনকার বয়সের তুলনায় অনেক বেশি আকর্ষণীয়ভাবে শেকস্পিয়ারের জুলিয়াস সিজার এর কথা বলেছিল। সেটি আমি বিশেষভাবে উপভোগ করেছিলাম।
সে মাতাতিয়েলে স্কুলে যাওয়ার পরে এবং সেখানে থেকে ঔড হাউসে স্থানান্তরের পরও আমাদের মধ্যে নিয়মিত চিঠিপত্র যোগাযোগ ছিল।
১৯৬০ সালের ডিসেম্বরে আমি গাড়িতে করে কিছু দূরে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখনো আমি তাকে শিশুই মনে করতাম, আর সেভাবেই কথা বলতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু ১৯৬২ সালে কথা বলার সময় বুঝেছিলাম, আমি আর ছোট্ট কারও সঙ্গে কথা বলছি না। বরং তাকে এমন একজন বলে মনে হয়েছিল, যে নিজের জীবন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে ফেলেছে। সে যেন হঠাৎ পুত্র থেমে মিত্রের অবস্থানে উঠে এসেছিল। সত্যি কথা বলতে কী, বিদায় নেওয়ার সময় আমি কিছুটা বিষন্নই হয়ে পড়েছিলাম। আমি তাকে কোনো বাসস্টপ পর্যন্ত নিয়ে যেতে বা স্টেশনে বিদায় জানাতেও যেতে পারিনি। কারণ, আমার মতো কোনো সরকার ঘোষিত অপরাধীর পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ পিতৃসুলভ কর্তব্য পালন করাও ছিল নিষিদ্ধ। সুতরাং, আমার পুত্র, না, আমার বন্ধুটি এ জগতে নিজের দায়িত্ব নিয়ে একাই বেরিয়ে গেল। আমি তো শুধু গোপনেই অনেকদিন পরপর তার সঙ্গে দেখা করতে পারতাম। আমি জানতাম, তুমি তাকে কাপড়চোপড় কিনে দিয়েছ। কিছু নগদ টাকাও দিয়েছ। একজন পালাতক হতভাগার পক্ষে যা সম্ভব, আমিও পকেট উজাড় করে তাম্র মুদ্রা ও রৌপ্য মুদ্রা মিলিয়ে যা কিছু ছিল, সবই তাকে দিয়ে দিয়েছিলাম।

রিভোনিয়া মামলা চলার সময় একদিন সে আমার পেছনে বসে ছিল। আমি পেছন ফিরে মাথা ঝুঁকিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বেশ বড় করে হেসেছিলাম। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি, আর কখনো ওর দেখা পাব না। সে তো পাঁচ বছর আগের কথা… এখন যেমন মনে হচ্ছে, আগে তোমাকে কখনো এমন করে চাইনি। আজকের এ দুর্ভাগ্যের মধ্যে এসব বিপরীত কথা মনে ভাবতেই ভালো লাগছে। লেখক পি জে শোম্যান একজন আফ্রিকি সেনাধ্যক্ষের গল্প লিখেছিলেন, যিনি তাঁর চৌকস কালো যোদ্ধাদের নিয়ে শিকারে গিয়েছিলেন। শিকারের পেছনে ছোটার সময় একটি সিংহী তাঁর পুত্রকে মেরে ফেলেছিল। সেনাধ্যক্ষ নিজেও পশুটির দ্বারা দারুণভাবে আহত হয়েছিলেন। তাঁর ক্ষতস্থানটিকে জীবানুমুক্ত করার জন্য একটি লোহার ফলা লাল-গরম করে ছ্যাঁকা দেওয়ার সময় আহত মান্যবরকে সেই কষ্টদায়ক চিকিৎসাও সইতে হয়েছিল। পরে একসময় শোম্যান তাঁকে জিজ্ঞাস করেছিলেন, কেমন লেগেছিল? সেনাধ্যক্ষ জবাব দিয়েছিলেন, দৃশ্যমান ব্যথার চেয়ে অদৃশ্য ব্যথাই ছিল অনেক বেশি। এখন আমি জানি, সেনাধ্যক্ষ ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন।’

লেখক : নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ