চলে গেলেন নারী সাংবাদিকতার ‘বাংলাদেশ’ - Women Words

চলে গেলেন নারী সাংবাদিকতার ‘বাংলাদেশ’

তাঁর আয়ূস্কাল ছিলো ৯১ বছর। এ উপমহাদেশের হিসেবে এই সংখ্যাটা অনেক বেশিই। তারপরও তাঁর বিদায় আমাদের কি তারাশঙ্করের কবিতার সেই লাইনটি মনে করিয়ে দেয় না- ‘জীবন এত ছোট কেনে?’
বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের নারীদের প্রথম সাপ্তাহিক ‘বেগম’ এর সম্পাদক, নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত ও কথাসাহিত্যিক নূরজাহান বেগমের জীবনঘড়ি থেকে গেছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত সোমবার (২৩ মে ২০১৬) সকাল ১০টায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
নূরজাহান বেগম ছিলেন কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতা রোকনুজ্জামান খান (দাদা ভাই) এর সহধর্র্মীনি। ১৯৫২ সালে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দাদা ভাই ১৯৯৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তারা দুই কন্যাসন্তানের জনক। দাদা ভাই শুধু একজন প্রখ্যাত সাংবাদিকই ছিলেন না বাংলা শিশুসাহিত্যের অন্যতম নক্ষত্র ছিলেন তিনি।
নারী অগ্রযাত্রার অন্যতম প্রতিকৃত নূরজাহান বেগম ১৯২৫ সালের ৪ জনু চাঁদপুর জেলার চালিতাতলী গ্রামে জন্ম নেন। বাবা ছিলেন বিখ্যাত সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন। বাড়িতে তার আদুরে নাম ছিলো ‘নূরী’। নূরজাহানের শৈশব কেটেছে কলকাতায়। ১৯২৯ সালে সাড়ে তিন বছর বয়সে মা আর মামা ইয়াকুব আলী শেখের সঙ্গে তিনি কলকাতায় বাবার বাসায় চলে আসেন। প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় বেগর রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বিদ্যালয়ে। অষ্টম শ্রেণী থেকে মেট্রিক পর্যন্ত তিনি ইংরেজী মাধ্যমে পড়াশোনা করেন। ১৯৪২ সালে পশ্চিমবঙ্গের ভাগলপুরের সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন। আইএ পড়তে ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রাবোর্ন কলেজে। সেখানে দর্শন, ইতিহাস ও ভূগোল নিয়ে পড়েন। সেখানে সহপাঠি হিসেবে পেয়েছিলেন সাবেরা আহসান ডলি, রোকেয়া রহমান কবির, সেবতি সরকার, জ্যোৎ¯œা দাশগুপ্ত, বিজলি নাগ, কামেলা খান মজলিশ, হোসনে আরা রশীদ, হাজেরা মাহমুদ ও জাহানারা ইমামকে। এই কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে বিএ ডিগ্রী লাভ করেন। নূরজাহান ব্যাডমিন্টনও ভালো খেলতেন।
অথচ এই নারী জীবনের শুরুতেই মরতে বসেছিলেন। ছোট্ট বয়সে একবার বাড়ির পাশের খালের পানিতে পড়ে ডুবতে বসেছিলেন। সেটা ছিল দুর্ঘটনা। পরবর্তী জীবনে সেই নারী তৎকালীন সমাজের ‘দুর্ঘটনা’ হয়ই আবিভূত হন যেন। গত শতাব্দির তিরিশের দশকে মুসলিম পরিবারের মেয়েদের পড়তে চাওয়া তো ‘দুর্ঘটনা’ই ছিলো। সেই দুর্ঘটনা ঘটিয়ে তিনি কিন্তু সমাজের বাঁক বদলে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন।
লেখালেখির প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল বরাবর। হয়তো বাবার সূত্রে তা হয়েছিল। কারণ বাবার সওগাত পত্রিকায় তখন নিয়মিত আসর জমাতেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, হাবীবুল্লাহ বাহার, ইব্রাহীম খাঁ, কাজী মোতাহার হোসেনের মতো মহারতিরা। তাদের সাহিত্য আসরের শ্রোতা ছিলেন নূরজাহান বেগম।
‘বেগম’ পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয় ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই। মেয়েদের সাহিত্য চর্চায় নিয়ে আসতে তাঁর বাবা নাসিরুদ্দীন প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাটির প্রথমদিকে সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। প্রথম চারমাস তাঁর সম্পাদনায় বের হয় বেগম। শুরুতে নূরজাহান বেগম ছিলেন পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল ও লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে যারা তাঁর সহপাঠি ছিলেন তারাই কাজ করতেন বেগমে। সুফিয়া কামালের পরপরই সম্পাদকের দায়িত্ব নেন নূরজাহান বেগম। বাংলাদেশের অনেক প্রথিতযশা সাহিত্যিকের লেখালেখির হাতেখড়ি হয়েছিল এই পত্রিকায়।
প্রথমদিকে কলকাতা থেকে পত্রিকাটি প্রকাশিত হলেও দেশভাগের পর ১৯৫০ সাল থেকে পত্রিকা ঢাকা থেকে বের হতে শুরু করে। ঢাকায় এসে নারীদের লেখালেখি ও ছবি আঁকতে উদ্বুদ্ধ করেন নূরজাহান। প্রায় ৬৩ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে পত্রিকাটি। নারী জাগরণ, নতুন লেখক সৃষ্টি, সাহিত্য ও সৃজনশীলতার চর্চায় পত্রিকাটি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। এই দীর্ঘসময় তিনি একাধারে এই একটি কাজই একাগ্রচিত্তে করে গেছেন। একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন সে কথা, বেগম এর বাইরে আমি কোনোদিন কোনো কিছু করার চেষ্টা করিনি। বেগমই তো আমার সারাজীবনের কাজ।
সেই কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন। নারী শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৯৭ সালে রোকেয়া পদকে ভূষিত হন নূরজাহান বেগম। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, লেখিকা সংঘ, কাজী জেবুন্নেসা-মাহবুবউল্লাহ ট্রাস্ট পদক ও রোটারী ক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠন তাকে সম্মাননা জানিয়েছে।
এদেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় নূরজাহান বেগম অনেক অবদান রেখেছেন। জাগতিক নিয়মে ৯১ বছর বয়স একেবারেই কম নয়। তবু তাঁর যাবার বেলা আফসোস থেকেই যায়। আহা এদেশের অধিকার বঞ্চিত নারীদের কত কী পাওয়ার ছিল তার কাছ থেকে। আরো কত কী তিনি দিতে পারতেন জাতিকে। তাই আক্ষেপ নিয়ে বলতেই হয় বড্ড অসময়ে চলে গেলেন ‘ক্ষণজন্মা’ নূরজাহান বেগম।