গালিবা নামের ‘পরী’টা সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে চলে গেল! - Women Words

গালিবা নামের ‘পরী’টা সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে চলে গেল!

দেব দুলাল গুহ

আজ ক্রিকেটে বাংলাদেশের জয়ের আনন্দে সবাই যখন আনন্দিত, সাকিবের ছোট্ট মেয়েটি যখন ওর বাবার বিশেষ অর্জনের দিনটিতে বাসায় বসে টিভিতে বাবাকে দেখছে, আমার ক্রিকেটার বন্ধু মিঠু তখন ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ওর নবজাতক মেয়ে গালিবার নিথর দেহটি বুকে জড়িয়ে কাঁদছে। ফরিদপুরে ক’দিন আগে এই মেয়েটিকেই জন্মের পর ‘মৃত’ বলে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন এক ডাক্তার। মিঠু জানিয়েছে এমনটাই। রাতে কবর দেয়া হয়না বলে সারারাত একটা প্যাকেটে করে মেয়েটিকে কবরস্থানে রাখা হয়। সকালে কবর দিতে গেলে দেখা যায় মেয়েটি বেঁচে আছে। তারপর আবার স্থানীয় শিশু হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও অবস্থার উন্নতি নাহলে শিশুটিকে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকায় নেয়া হয়। স্কয়ারে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখার পর আজ গালিবা নামের পরীটা আমাদের সকল প্রচেষ্টা ব্যার্থ করে দিয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলো!

মিঠু আমার স্কুলের বন্ধু। একইসাথে ফরিদপুর জিলা স্কুলে পড়েছি। ও ছোট থেকেই ক্রিকেট খুব ভালো খেলতো। বিশাল বিশাল ছক্কা হাঁকিয়ে আমাদেরকে তাক লাগিয়ে দিতো। আমরা ভালো ছাত্ররাও ওর এই ক্রিকেটীয় গুণের কারণে ওকে আলাদা চোখে দেখতাম। সেদিন রাতে হঠাৎ মিঠুর ফোন। মেয়েটি যে ওর, সেই খবরটি জানাতেই এই ফোন। ক্ষোভ ঝরানো কণ্ঠে ওর দাবি, এই বিষয়টি নিয়ে আমি যেনো কিছু লিখি। সেই লেখা যে আজ এভাবে এমন সময়ে লিখতে হবে, আমি ভাবতে পারিনি।

galiva-2-women-wordsযদিও সেদিন মিঠুকে আমি ‘নিশ্চয়ই স্রষ্টার প্রত্যক্ষ রহমতে তোর মেয়ে বেঁচে ফিরেছে’ বলে সাহস দিয়েছি, কিন্তু আমি এই কথাটি পুরোপুরি মন থেকে বিশ্বাস করিনা। স্রষ্টার ইচ্ছাতেই সবকিছু হয়- এটা ঠিক, কিন্তু মর্তের মানুষের হাতেও অনেক কিছু করার থাকে। স্রষ্টার ইচ্ছাতেই মানুষ মানুষের উপকার করে। একজন ডাক্তারকে যদি কেউ স্রষ্টার পরে স্থান দেয়, তবে সেটা অতিরঞ্জন নয়। অবশ্যই অসুস্থ্য হলে মানুষ ডাক্তারের কাছেই যায়, শুধু মন্দির-মসজিদে গিয়ে প্রার্থনা করে না। সেই ডাক্তারের হাতে জন্ম-মৃত্যু বিধান করার ক্ষমতা না থাকলেও তিনি যদি একটু দায়িত্ব নিয়ে চেষ্টা করেন, হয়তো রোগী মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেও আসতে পারে। ফিরে না আসলেও অন্তত রোগীর স্বজনেরা যদি ডাক্তারের সেবায় খুশি থাকে, তখন বলা যায় ‘সব তাঁর ইচ্ছা, এখানে আমাদের হাত নাই’। কিন্তু ডাক্তারের সেবার মানসিকতার বদলে যদি তাড়াহুড়ো করে বেশি রোগী দেখা এবং বেশি রোজগার করার মানসিকতাটা বেশি প্রাধান্য পায়, তখনই মানুষ সেই ডাক্তারের দিকে আঙ্গুল তোলে। সব ডাক্তারকে মানুষ গালি দেয় না, বেশিরভাগ ডাক্তারকেই মানুষ দোয়া দেয়, শ্রদ্ধা করে। আমি বলবো না ফরিদপুর শিশু হাসপাতালের সেই ডাক্তারটির আরেকটু ভালো করে সময় নিয়ে চেক-আপ করে শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করা উচিত ছিল। আবার আমি আমার বন্ধু মিঠুর পিতৃ-হৃদয়ের ক্রন্দনকেও উপেক্ষা করতে পারিনা। আমি চাই এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হোক এবং ডাক্তারের সেবায় ত্রুটি পাওয়া গেলে তাঁকে আইনের আওতায় আনা হোক। আমি একটু বেশি করে আশা রাখতে চাই যে, আমার ডাক্তার বন্ধুরা গতবারের মতো এবারও আমাকে গালি না দিয়ে এবং আনফ্রেন্ড না করে বরং তারাও আওয়াজ তুলবে, ভালোকে খারাপের সাথে মিশিয়ে ফেলবে না।

ফরিদপুর সেই বৃটিশ আমলেরও আগে থেকেই ঐতিহ্যবাহী এক জেলা শহর। তবুও যুগে যুগে শহরটি বঞ্চিত হয়েছে। এখনো রাজধানী ঢাকার সাথে জেলাটির যোগাযোগ সহজ নয়। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে প্রায়ই চারটির মাঝে বেশিরভাগ ফেরিঘাট অচল থাকে। অন্য রুটে পদ্মা সেতুটি হলে কিছুটা সমস্যা হয়তো কমবে, কিন্তু সেটি হতে এখনও অনেক দেরী। ফরিদপুরের হাসপাতালগুলোতে উন্নত সুযোগ-সুবিধা আজও অপ্রতুল। বেশি সমস্যা হলে রোগীকে ঢাকায় নিতে অনেক সময় লেগে যায়। তার ওপর যদি ডাক্তারদের থেকে এমন সেবা পাওয়া যায়, তবে ফরিদপুরবাসী যাবে কোথায়? বন্ধু মিঠু ঢাকায় থাকে, ঈদে বাড়ি এসেছিলো। ফরিদপুরে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলে হয়তো আজ ওর মেয়েটা মরতো না।

এই রকম দুঃসংবাদ শুনলে আমার বারবার সেই রাতের স্মৃতি মনে পড়ে যায়, যেই রাতে আমার বাবা মারা গিয়েছিল। ২০০৮ সালের ২০ জুলাই অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে গেলাম বাবাকে প্রথম ফরিদপুর পরিচর্যা হাসপাতালে। রাত পৌনে ১০টায় সেখান থেকে জানিয়ে দেয়া হলো, সেখানে একজন ডাক্তারও নেই! গেলাম সদর হাসপাতালে, সেখানেও নাকি ডাক্তার নেই। আমি বাবাকে সেখানে রেখে দৌড়ে গেলাম একটু দূরের ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজে, ডাক্তারের খোঁজে। গেটে একজন ভদ্রলোককে দেখে নাবালক আমি বলে ফেলেছিলাম, ‘স্যার, আপনি কি ডাক্তার? আমার বাবার ঠান্ডা হয়ে পড়ে আছে সদরে। আপনি একটু আমার সাথে চলেন না!’ ডাক্তার সাহেব সোজা মুখে বলে দিলেন, ‘এভাবে কি এতো রাতে যাওয়া যায়? আমার চেম্বার আছে, পিএস আছে। তুমি পিএসের সাথে যোগাযোগ করো, ডেট নাও, তারপর দেখা যাবে…’ । কথাগুলো মনে আছে, কিন্তু নাম আর চেহারা মনে নেই। ফিরে গিয়ে দেখি সদরে কান্নার রোল পড়ে গেছে। একজন ইন্টার্নি চিকিৎসককে খুঁজে আনা হয়েছিলো। তিনি অক্সিজেন দিয়ে নাকি দেখেছেন, বাবা আর নেই! অ্যাম্বুলেন্সে ফেরার পথে অন্য হাসপাতালে গিয়ে দেখাতে চাইলে আমাকে জানিয়ে দেয়া হলো, ফরিদপুরে এর চেয়ে বেশি কিছু নাকি করে দেখার নেই।

আমরা সাধারণ মানুষেরা ডাক্তারদের থেকে কী চাই? আমরা চাই অসুস্থ হলে একটু হাসিমুখে সাহস যোগানো, একটু সুচিকিৎসা। এটুকু পেলেই তো আমরা খুশি। একটু পর মরে যাবো, তবুও যদি ডাক্তার একটু ভালো করে আমাকে একটু বেশি সময় নিয়ে দেখে আমাকে বাঁচানোর চেষ্টাটা ভালোভাবে করে, হেসে পিঠ চাপড়ে বলেন, ‘আরেহ, কিচ্ছু হয়নি, বুকে সাহস রাখো’, তবে আমি মরার আগে এটুকু শান্তি তো পাব যে আমাকে বাঁচাতে সবাই যথাসাধ্য করেছে। ফরিদপুরে এমন ডাক্তার যে নেই, তা নয়। আমার থেকে ভিজিট না নিয়েও ঘন্টার পর ঘন্টা আমার মায়ের চেক-আপ করেছেন, সুপরামর্শ দিয়েছেন, বিপদের দিনে আমাকে সাহস দিয়েছেন, গভীর রাতে ফোন ধরে ডাক্তারি পরামর্শ দিয়েছেন, এমন ডাক্তাররূপী ফেরেশতার কথা আমি ভুলে যাই কী করে? আমরা এমন ডাক্তার চাই, এমন হাসপাতাল চাই, যারা টাকাকে নয় সেবাকে আগে প্রাধান্য দেবে। এজন্য ডাক্তারদের যা যা সুযোগসুবিধা লাগে তা সরকারিভাবেই দেয়া হোক। আমরা চাইনা আর কোনো বাবার বুকে এভাবে খালি হোক। চাইনা, আর কোনো মায়ের বুক ভরে ওঠার আগেই এভাবে প্রশ্নবোধক চিকিৎসার দরুন খালি হোক। চাই প্রশাসনের সঠিক পদক্ষেপে দ্রুততম সময়ে ফরিদপুরের চিকিৎসাব্যবস্থা প্রকৃত অর্থেই উন্নত হোক।

লেখক :  সাংবাদিক ও প্রবন্ধকার