প্রথম দেখা বন্ধুর মৃতমুখ - Women Words

প্রথম দেখা বন্ধুর মৃতমুখ

ফাহমিদা ফাম্মী

কেন জানিনা মৃত মুখ দেখতে ইচ্ছে হয় না আমার, সেই ছেলেবেলা থেকেই। যদিও হাসপাতালের পাশে বাসা হওয়ায় আম্মুর কল্যাণে প্রায়ই শুনতাম রোগীদের মৃত্যু সংবাদ। একবার কাছের এক চাচা মারা গেলেন। কিন্তু আমি দেখতে গেলাম না। আমার মনে হতো মানুষটার জীবিত স্মৃতিটাই থাকুক আমার স্মৃতিতে। মৃত চেহারাটা দেখে আর পরিচিত চেহারায় দাগ লাগানোর দরকার কি। তাই এই এড়িয়ে চলা।
কলেজে পা দিতেই নতুন নতুন মেয়ের সাথে পরিচয় হল। তেমনই একমুখ পূজা। কমন রুমে অনেক সময় পার করেছি। সেই সময়টায় পূজার সাথে পরিচয়। তবে তেমন ঘনিষ্টতা হয়নি। মেয়েটা ব্লু বার্ড স্কুলের ছিল। বেশিরভাগ সময়ই সায়েন্স বিল্ডিং এর বারান্দায় বসেই বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিত। পূজাকে যতদিন দেখেছি হাসিখুশি চেহারায় দেখেছি। কখনও মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখিনি। প্রায় দেখতাম সহপাঠি শারমিনের সাথে বসে খিলখিল করে হাসছে অথবা গল্প করছে। কমন রুমেও একই অবস্থা। মাঝে সাঝে ক্লাসেও দেখা হত। সে ক্লাস করতো কিনা জানি না, তবে আমি ক্লাস মিস দিতাম প্রায়ই। সারাদিন কলেজের এই কাজ সেই কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। আসলে কলেজে পড়তে গিয়েছিলাম নাকি বান্ধবীদের সাথে মজা করতে আর প্রোগ্রাম করতে তাই নিয়ে মাঝে মাঝে নিজের মাঝে সন্দেহ জাগত।
দিনটির কথা বেশ মনে আছে। রবিবার ছিল। প্রি টেস্ট পরীক্ষার পর দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন পূজার সাথে কথা বলেছিলাম। তার ঠিক এক সপ্তাহ পর এক সকালে আম্মু আমাকে ডেকে তুলে বললেন, পূজা মারা গেছে।
হতবাক আমি বললাম, কি বল এগুলা? মোবাইল হাতে নিয়ে পূজার নম্বরে ফোন দিলাম। মোবাইল বন্ধ। পরে জানলাম, তার মায়ের জর্জেটের শাড়ি সেলিং এ ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করেছে পূজা! কারণ যতটুকু জানলাম, আগের রাতে বাবা বকা দিয়েছিলেন সেই অভিমানে পূজা নিজের জীবনটাই শেষ করে দিল।
সারাটা জীবন মৃত্যু মুখ এড়িয়ে গেছি। কিন্তু পূজার বেলা সেটা পারলাম না। আম্মুর কড়া নিষেধ তুচ্ছ করে পিঙ্কিকে নিয়ে ছুটলাম পূজাদের বাসায়।ভাতালিয়ায় অনেক খোঁজা খুঁজির পরও বাসাটা পেলাম না। যখন খুঁজছি তখন হঠাৎ একটা এ্যাম্বুলেন্স সামনে পড়লো। মনের অজান্তে হাতের ইশারায় থামালাম সেই এ্যাম্বুলেন্সটাকে। এ্যাম্বুলেন্সে পূজার বাবা বসা ছিলেন। জানালা দিয়ে পূজার সবুজ ওড়নায় আচ্ছাদিত মুখটা দেখলাম প্রথমে। নিজের অজান্তেই তার নিথর মাথায় হাত রাখলাম। এই প্রথম আমার মৃত মুখ দেখা।
… খুব কাছের বান্ধবী ছিল না পূজা। তবুও কেমন তীব্র খারাপ লাগা কাজ করলো। প্রায় দুই সপ্তাহ ঘুমাতে পারিনি। সারাক্ষণ ঐ চেহারাটা ভেসেছে চোখে।
গভীর অভিমানে পূজার চলে যাওয়ার পাঁচ বছর হলো ২০শে আগস্টের দিনটায়। আমরা বেঁচে আছি…। তার খুব কাছের বান্ধবীরাও বেঁচে আছে, আত্মীয় স্বজন প্রায় সবাই আছেন, বাবা মা সবাই… শুধু পূজা নেই। এমন চলে যাওয়া কোনভাবেই মেনে নেওয়ার নয়। বৈরি সময় আসবেই। তখন খুব কাছের মানুষের সাথে বিষয়টা ভাগ করে নিতে হয়। কারো উপর অভিমান করে চলে যাওয়াটা বোকামিই।
মৃত্যুর কষ্ট বেঁচে থাকার কষ্টের চেয়ে অনেক বেশি। একটু সাহস করে তাই বেঁচে থাকো, দেখবে একসময় মনে হবে মরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা কতটা ভুল ছিল।নিজের জন্য বাঁচো নিজেকে নিয়ে…