বৃষ্টি বিরতি - Women Words

বৃষ্টি বিরতি

নমিতা দাশ

বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা টপ টপ করে পরে ভিজে গেছে সারা পথ, নিরালা বৃষ্টি। অথৈ জলে ভিজে মাটির উঠানে ডানা ঝাপটাচ্ছে হাঁস। কেউ কেউ একটু দূরে সরে একাই দাঁড়িয়ে আছে, যেনো বৃষ্টিতে ভিজাটা একটুও উচিত হয়নি। মাটির পথ ধরে হাঁটছি – থেমে যাবে একটু পরে নিশ্চয়ই। বৃষ্টি তো এখন আর বেশিক্ষন বেঁচে থাকে না। অল্প দম। সকালে নদী পার হওয়ার সময় কি ঝকঝকে রোদ ছিলো, কমিনিউটির স্যাঁতস্যাঁতে রুম থেকে বসে আকাশটাও কি আলো-হাসি মাখা পরিস্কার দেখা যাচ্ছিলো। ৬০ তম রোগীর সিরিয়াল শেষ করে বের হতে কিছু তো সময় লাগেই। তাতেই আকাশ জল ছেড়ে দিলো। হাঁটতে তো হবেই।

এখানে রিক্সা কোথায়? প্রায় এক মাইল পথ প্রতিদিন হেঁটে তারপর নৌকায়। সেখান থেকে সিএনজি, ল্যাগুনা যা পাওয়া যায়। সমস্যা হচ্ছে প্রতিদিন সেখানে কিছু না কিছু ঝামেলা লেগে থাকে – ল্যাগুনা আর সিএনজি চালকদের মাঝে। গ্রামের বড় বাজারের সিএনজি স্ট্যান্ড থেকে এই বাজার প্রায় ৩ কিলোমিটার দূর। মেইন বাজারে গিয়ে আবার শহরের যাবার সিএনজি ধরতে হবে। এখনো নদীর কাছেই যাই নি, নৌকা পাবো তো? গিয়াস আসছে পিছন পিছন। গিয়াস কমিনিউটির পিয়ন। ওই হচ্ছে একমাত্র ভরসা। রিকশা না পেলে, সিএনজি না জুটলে সে তখন পরিচিত ড্রাইভার ডেকে এনে যাবার ব্যবস্থা করে দিবে। না হলে সেদিন ওদের কারো বাড়িতে গিয়ে উঠতে হবে। আজকের অবস্থা সেরকম হয়ে যায় কিনা কে জানে! ছাতা হাতে বৃষ্টির জল আর আটকানো যাচ্ছে না।

-গিয়াস ওই বাড়ির উঠানে একটু দাঁড়াতে দিবে?

-দিবো তো ম্যাডাম। আইন আমি কইরাম।

সেই তখন থেকে মাটির ঘরের বারিন্দায় দাঁড়িয়ে ভিজা হাঁস আর মাঠ দেখছি। গতকাল সকালে যে যক্ষা আক্রান্ত রোগীটাকে হাসপাতাল থেকে রেফার করে টিবি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিলো ওর বাড়ি শুনেছি এই গ্রামে। বয়স্ক নারী, ৫ ছেলেমেয়ে। তাও নাকি উনারে দেখার কেউ নাই।

– ম্যাডাম, আদাব। বালা আছওইন? বাড়ির ভিতর থেকে একজন কথা বলে উঠলেন।

– হুম, ভালো।

– আমি দেখাইছলাম আফনারে, চিনচইন নি আমারে?

– না, মনে নাই। কি সমস্যা ছিলো?

– আমার পুতের (ছেলের) বৌ রে লউয়া গেসলাম। মরি গেছে বেটি গু।

কপাল ভাঁজ করে জিজ্ঞেস করলাম, – মরে গেছে কেনো? কি সমস্যা ছিলো?

-ম্যাডাম বিতরে আইয়া বইন। তাইর তো পয়লা বাচ্চা আছিল,আপনে দেখিয়া কইছলা প্রেসার বেশি, ওউদিন সিলেট নিবার লাগি। নিতাম পারছি না। ওখানর এক মহিলা বাড়িত ডেলিভারি করায়। ওউ বেটিয়ে বাচ্চা ডেলিভারি করাইসে। বাচ্চা গুতা ও মরি গেসে!

সবুজ মাঠের ধান গাছ গুলি এমনিতে খুব ঝলমল করে, এখন বৃষ্টির জলে ভিজে একেবারে কাতান-বেনারসি শাড়ির সবুজ রঙ ধরেছে। চেয়ারে বসে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে মহিলার পেটের উচ্চতা মাপার চেষ্টা করছি। ফুল টার্ম প্রেগন্যান্সি মনে হচ্ছে।

-আপনি ডাক্তার দেখাইসেন?

– না গো মাই, আমার এখন কোন অসুবিধা নাই। অসুবিধা হইলে যাইমুনে।

বৃষ্টির দাপট কিছুটা কমে আসছে। গিয়াস তাড়া দিচ্ছে। উঠানে কাঁদা জমেছে।

-আচ্ছা আসি। আপনার সমস্যা হলে কমিনিউটিতে এসে আমাকে দেখিয়ে যাবেন।

-আইচ্চা ম্যাডাম। আউক্কা।

– গিয়াস, নৌকা পাবো? অলেরেডি ৩টা বাজে।

– পাইবা ম্যাডাম।

নৌকা যদিও বা পাই, ল্যাগুনা বা সিএনজি কি পাওয়া যাবে? বড় বাজারে অবশ্য সিএনজি পাওয়া যাবে। অনেক টেনশন হবার কথা, কিছুই হচ্ছে না। আষাঢ়ের বৃষ্টির লাবন্য সব টেনশন মুছে দিয়েছে। মরে যাওয়া বৌ টার জন্য কষ্ট হবার কথা, সেও এই পথ দিয়েই হেঁটে হাসপাতালে গিয়েছিলো। ঠিক সময়ে ওকে হাসপাতালে নিলে একটা ফুটে ফুটে শিশু নিয়ে সেও আজকের এই বৃষ্টিটা উপভোগ করতো, বাচ্চাটাকে ঘরে শুইয়ে দিয়ে উঠানের হাঁস গুলিকে ঘরে তুলতো, কাপড় গুলি তুলে ঘরে নিতো। বাচ্চাটাও বেঁচে নেই। যাক সেসব ভেবে লাভ নেই, আমার বরং ভিজে চুপসে যাওয়া হাঁসগুলোর জন্য মন খারাপ লাগছে। ওদেরকে একটু ঘরে তোলার কথা বলে আসলে ভাল হতো। যদিও তুলতো না, সামান্য হাঁস। ওই গ্রামে অনেক হাঁস, একটা মরলে আরো দশটা পাবে। আবার তুলতেও পারে, এটাই এখানকার লোকদের ইনকাম সোর্স। ছেলের বৌ এর চেয়ে হাঁসের প্রায়োরিটি এদিক থেকে কিছুটা হলেও বেশি। নৌকা ঘাটেই ছিলো, ছাতা মাথায় সাবধানে উঠতে গিয়ে পড়েই যাচ্ছিলাম। পড়িনি।