দমবন্ধ করা রাতের শেষে... - Women Words

দমবন্ধ করা রাতের শেষে…

অদিতি দাস
মেয়েটির গায়ের সুরমা রঙের ফ্রকে সোনালি কারুকাজ, পেছনে পরীর মতো গোলাপী দুটি ডানা, হাতে ম্যাজিক স্টিক। ছোট্ট হাত দুটিতে আঁকা মেহেদীর আলপনা বলে দেয় মা কিংবা বড় বোন যত্ন করে এঁকে দিয়েছেন। ছবিটি কোন অনুষ্ঠানে তোলা সম্ভবত। হতভাগা মেয়েটির জন্মদিনেরও হতে পারে। এমন একটি ছবি ফেসবুকজুড়ে ভাইরাল হয়েছে। এমন ছবি দেখলে যেখানে মুহূর্তে মনটা ভালো লাগায় ভরে ওঠার কথা সেখানে ছবিটা দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছে হচ্ছে, মেয়েটির দিকে তাকালে নিজেকেই কেমন অপরাধী অপরাধী ঠেকছে।

সামিয়া আক্তার সায়মা

তাকানোর সৎ সাহসটুকু যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। এমন কোমল, তুলতুলে, ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুকে কেউ ধর্ষণ করেছে-ভাবতেই গায় কাঁটা দিয়ে উঠছে। এমন শিশুকে শাসন করতে যেখানে বিবেকে বাঁধার কথা সেখানে ধর্ষণের মতো ন্যাক্কারজনক, ঘৃণ্য কাজ করার চিন্তা মাথায় আসে কিভাবে? আমি ভেবে কূল পাই না।

রাজধানীর ওয়ারীর একটি বহুতল ভবনের একটি অব্যবহৃত ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হয়েছে সাত বছরের শিশু সামিয়া আক্তার সায়মার মরদেহ। গত ৫ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যায় নিখোঁজ হয় সায়মা। সংবাদমাধ্যম থেকে জানা গেল, সায়মা’রা থাকতো ওয়ারির একটি বহুতল ভবনে। তাদের ঠিক ওপর তলার একটি ফ্ল্যাটে তার সমবয়সী এক শিশুর সঙ্গে খেলতে প্রতিদিন বিকেলে সেখানে যেত সে। ঘটনার দিনও গিয়েছিল। কিন্তু সেই ফ্ল্যাটের শিশুটি বাইরে বেড়াতে যাবে বলে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল সেদিন। সায়মা নিজেদের ফ্ল্যাটে ফিরতে আবার লিফটে উঠেছিল। এরপরই সে হাওয়া। সন্ধ্যার পরও বাসায় না ফেরায় তার খোঁজ পড়ে। যে দুই ফ্ল্যাটে সে খেলতে যেত সেগুলোতে খোঁজ নিতে গিয়ে বিষয়টি প্রথম টের পান পরিবারের লোকজন। তাকে অনেক খোঁজাখুঁজির পর ভবনের সবচেয়ে উপরের তলার একটি অবিক্রিত শূন্য ফ্ল্যাটের রান্নাঘরের সিংকের নীচে পাওয়া যায় সায়মাকে নিথর দেহ। পরদিন শনিবার ঢাকা মেডিক্যালে ময়নাতদন্ত শেষে জানা যায়, ছোট্ট সায়মাকে প্রথমে ধর্ষণ পরে হত্যা করা হয়েছে। তার ঠোঁটে কামড়ের চিহ্ন এবং যৌনাঙ্গে আঘাতের চিহ্ন। মূলত শিশুটিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। তার আগে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে আলামত পাওয়া গেছে।

শুরুতে বর্ণনা দেওয়া মেয়েটির এমন পরিণতি কিছুতে মেনে নিতে পারছি না। প্রতিদিন ধর্ষণের পর ধর্ষণের সংবাদ দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে জীবনের প্রতি এক ধরণের বিতৃষ্ণা এসে গেছে। এ কেমন দেশ? এ কেমন সমাজ? এ কেমন সভ্যতা? এত এত ধর্ষণের সংবাদ। আমরা কিছুই করতে পারছি না। কাহাতক আর সহ্য হয়? গত কয়েকদিন ধরে বিষয়গুলো যেন মাত্রা ছাড়া হয়ে গেছে। মেয়েরা আজ কোথায় নিরাপদ। গত দুইদিন ধরে আলোচিত নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার মাদরাসা অধ্যক্ষ আবুল খায়ের বেলালী। শিশু ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া এই শিক্ষক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মোট আট শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন। একজন শিক্ষক যদি এমন হন তাহলে আমাদের নৈতিকতা কোথায় গিয়ে ঠেকে ভাবতেই দু চোখে অন্ধকার দেখি। এবার অন্যদিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক, ‘নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা এক স্কুলছাত্রীর অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ঘটনায় দুই পুলিশ সদস্যসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে গাজীপুরের কোনাবাড়ীর শিশু উন্নয়ন (মহিলা) কেন্দ্র।’ (সূত্র : নিরাপত্তা হেফাজতে নাবালিকা অন্তস্বত্বা/আমাদের সময় অনলাইন/৭ জুলাই) কিংবা রাজধানীর ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে গত বৃহস্পতিবার (৪ জুলাই) এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে এক কিশোরের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার খবর কিংবা নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী এলাকায় এক কিশোরীকে (১৬) বাসায় আটকে রেখে ধর্ষণ। শরীয়তপুরের জাজিরার স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রীকে (১৬) আন্তঃজেলা পরিবহনের তিনজন শ্রমিক গণধর্ষণের অভিযোগের খবর আমাদের বিচলিত করে।

এমন ধর্ষণের খবর আমাদের বিচলিত করে, আতংকিত করে, হতাশ করে, অনিরাপত্তার অনুভূতি দেয়, অসহায় করে তুলে ঠিকই-অবাক করে না আর। মানুষেরও এখন যেন সবকিছু গা সওয়া হয়ে গেছে। আগে একেকটা ধর্ষণের খবরে মানুষ ফুঁসে উঠত, রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করত, দেশের নানা প্রান্তে মানববন্ধন হত। কিন্তু এখন কি আর এটুকু প্রতিবাদও আমরা দেখতে পাই? গত কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহে না হয় একটু চোখ রাখি। গত এক সপ্তাহে কতটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে গেছে হিসেব রেখেছেন? একটা দুইটা হলে ঝট করে বলে ফেলা যেত। কিন্তু বিষয়টা সেরকম নয়। রীতিমতো ঘাটাঘাটি করে হিসেবটা বের করতে হবে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এর প্রতিবেদন অনুযায়ি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে ৬৩০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তার মানে মাসে শতাধিক নারী ধর্ষিত হচ্ছেন। গত কয়েকদিনে যে পরিমাণ ধর্ষণের সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে সেটি অব্যাহত থাকলে পরের ছয় মাসে সেই সংখ্যা আরো বাড়বে সন্দেহ নেই।

যা হোক, আগেই বলেছি ধর্ষণের সংবাদ আমাদের আজকাল বিচলিত, আতংকিত, হতাশ করে ঠিকই তবে অবাক করে না। এরকম পরিস্থিতি থেকে নারীর মুক্তি কবে ঘটবে কে জানে। আমি আসলে এসব বিষয় নিয়ে আজ লিখতে বসিনি। কিংবা লিখতে বসব এমন পরিকল্পনাও ছিল না। কিন্তু প্রতিদিনের অভ্যাসবসত ঘুমুতে যাওয়ার আগে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একবার চোখ বুলিয়ে নিতে গিয়ে এক ধরণের অপরাধবোধে পড়তে হয়েছে। শিশু সায়মার ছবিটি ফেসবুকে বারবার চোখে পড়ায় নিজেকে বড্ড বেশি অসহায় মনে হচ্ছে। অপরাধী মনে হচ্ছে। ফেরেস্তার মতো নিস্পাপ শিশুগুলোকে আমরা এইটুকু নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারছি না। সায়মার গোলাপী ডানাওয়ালা ছবিটির দিকে তাকাতে পারিনি বলে চোরের মতো ফেসবুক লগআউট করে বেরিয়ে এসেছিলাম। শোবার ঘরের আলো নিভিয়ে যখন চোখ বন্ধ করেছি তখন ফেসবুকে দেখা সেই ছবি যেন জীবন পেয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। সায়মা আমাকে জিজ্ঞাস করে, আমি তো কোন অন্যায় করেনি। খেলতে গিয়েছিলাম। খেলতে চাওয়া কি অন্যায়? তবে কেন আমার সঙ্গে এমন হলো? এত কষ্ট, শ্বাস নিতে পারছি না…।

আচ্ছা এমন ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুটার প্রতি যখন তার কাম জেগে উঠল তখন কি তার নিজের মেয়ের কথা মনে হয়নি একবারও? হয়তো তার মেয়ে নেই, তাতে কি? তার ছোট্ট বোনটি, যাকে সে কোলে-কাঁধে করে বড় করেছে? কিংবা তার ভাইয়ের মেয়ে, বোনের মেয়ে? নাকী এমন নর পিশাচদের এমন মানবিক অনুভূতি বা বোধ সৃষ্টিকর্তা দেননি?

সায়মার সঙ্গে এমন অমানবিক কাজ যে করেছে তার মুখোশ নিশ্চয়ই উন্মোচিত হবে। রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি এতটুকু আস্থা অন্তত আছে যে, ধর্ষক ঠিকই ধরা পড়বে। আমার মনে অদ্ভুত সব প্রশ্ন ভিড় করে- আচ্ছা অসভ্য, পাষণ্ড, জানোয়ারটার চেহারা দেখতে কি রকম হবে? আমি ভেবে পাই না। আচ্ছা তার কি মাথার পেছনে দুটি শিং থাকবে? দুই পাশে লম্বা দুটো দাত বের হয়ে থাকবে? সে কি দেখতে ভয়ংকর কোন দৈত্য-দানবের মত হবে? নাকি সে দেখতে অবিকল মানুষের মত হবে? সে দেখতে কেন মানুষের মত হবে?আমি ভেবে পাই না। অথচ আমি জানি, নিশ্চিত করে জানি, এই ঘৃণ্য কাজ যে করেছে সে দেখতে মানুষের মতোই হবে। আর তখনই নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়। মানুষ হিসেবে নিজেকে ভাবতে অপরাধী মনে হয়। কারণ এমন ঘৃণ্য কাজ যে করেছে সেও আমার-আমাদের মতই মানুষ। মানুষ হওয়াটা এখানেই আমাকে অপরাধী করে দেয়, কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়।

উফ! আর ভাবতে পারি না। সায়মার জীবনের অন্তিম মুহূর্তগুলোর কথা ভাবতে গিয়ে আমি কুঁকড়ে যাই। শিরদার বেয়ে ঘামের স্রোত নামে। অন্ধকারের মাঝেও আমি নিজেকে লুকাতে মরিয়া হয়ে উঠি। চোখ বন্ধ করে আরো অন্ধকার খুঁজি, যেখানে আমাকে আর দেখা যাবে না, কিংবা আমাকেও আর এই নিষ্ঠুরতা দেখতে হবে না। কিন্তু তবুও কোথা থেকে সায়মার ছবিটি চোখের সামনে চলে আসে। আমার দম বন্ধ লাগে। আমি লম্বা করে একটা শ্বাস নিতে ধড়ফড় করে উঠে বসি, জানালার দিকে ছুটে যাই প্রাণভরে শ্বাস নেব বলে। রাত শেষ হয়, ভোর হয়। সব অন্ধকার পেছনে ফেলে নগর আবার জেগে ওঠে। আমার ঘুম হয় না। নিজের অসহায়ত্ব, অপরাগতা ঢাকতে আমি কলমকেই অবলম্বন করি…।