আইএস'র যৌনদাসী থেকে জাতিসংঘের ‘শুভেচ্ছাদূত’ নাদিয়া - Women Words

আইএস’র যৌনদাসী থেকে জাতিসংঘের ‘শুভেচ্ছাদূত’ নাদিয়া

ইসলামিক স্টেট-এর যৌনদাসী হিসেবে দিনের পর দিন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। সইতে হয়েছে অকথ্য অত্যাচার। কাঁদতে কাঁদতে চোখের জলও একসময় শুকিয়ে গিয়েছিল। শরীর আর মনের নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যে থেকেও মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন সবসময়। ভেবেছেন- পালাতে হবে। পালাতেই হবে। শেষ পর্যন্ত চরম ঝুঁকি নিয়ে সেই নরক থেকে পালাতে পারা নাদিয়া মুরাদই এখন জাতিসংঘের গুডউইল অ্যাম্বাসাডর বা শুভেচ্ছাদূত।

গত বছর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নিজের ‘পুনরুজ্জীবন’এর কাহিনি শুনিয়েছেন নাদিয়া। শিউরে ওঠার মতো সে কাহিনি।

ইরাকের কুর্দ জনগোষ্ঠীর ইয়াজিদি ধর্মের মেয়ে ছিলেন নাদিয়া মুরাদ। ২০১৪ সালে যখন ইরাক ইসলামিক স্টেটের দখলে একটু একটু করে চলে যাচ্ছিল তখন সদ্য যৌবনে পা রেখেছেন মাত্র নাদিয়া। ১৯ বছর বয়স। ইসলামিক স্টেটের তাণ্ডব চলছে তখন ইরাকের নানা অংশ জুড়ে। দুর্ভাগ্যবশত তেমনই এক অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলো নাদিয়ার পরিবার। মা, বাবা এবং ছয় ভাইয়ের সঙ্গে দিব্য কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু আইএস-এর নারকীয় তাণ্ডব ভেঙে তছনছ করে দেয় তাঁর সেই সুখের দিন।

চারদিকে ইয়াজিদি মহিলাদের তখন জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল আইএস-এর লোকেরা। নাদিয়াও বাদ গেলেন না। যে ৫ হাজার মহিলাকে অপহরণ করেছিল আইএস, তাঁদের মধ্যে তিনিও একজন।

নাদিয়া বর্ণনায়, একদিন আইএস জঙ্গিরা গ্রামে এসে ঢুকে। ইয়াজিদিদের তারা ইসলামে ধর্মান্তরণ শুরু করে। যাঁরা বিরোধিতা করেছিলেন, মুখে কলাশনিকভের নল ঢুকিয়ে গুলি করে মেরে ফেলতে থাকে। ইয়াজিদি মেয়েরা ভয়ে গ্রামেরই একটি স্কুলে গিয়ে আশ্রয় নেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তাঁদের টেনে টেনে বের করে তুলে নিয়ে যায় জঙ্গিরা।

শুরু হয় এক দীর্ঘ এবং ভয়ঙ্কর বাসযাত্রা। ঠাসাঠাসি বাসে তখন ইয়াজিদি মেয়েদের আর্ত চিৎকার। নাদিয়ার কথায়- তা দেখে জঙ্গিরা জোরে জোরে হাসতে থাকে আর বলে, ‘তোরা এখন আইএস-এর। তোদের বিয়ে করা হবে।’ বাসে যেতেই যেতেই শুরু হয়ে গিয়েছিল যৌন নির্যাতন।

যে দিন তাঁকে অপহরণ করা হয়, মা-বাবা এবং ভাইয়েরা প্রতিরোধ করতে গিয়েছিলেন। চোখের সামনে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয় তাঁদের। ওই দিনই গ্রামের আরও ৩০০ পুরুষকে খুন করে আইএস-এর লোকেরা।

নাদিয়া এবং তাঁর তুতো বোনেদের তুলে নিয়ে যায় আইএস। নাদিয়া জানান, এরপরই শুরু হয় ধর্ষণ। ধর্ষণ বললে ভুল হবে, শুরু হয় গণধর্ষণ। দিন নেই, রাত নেই, সময় নেই, যখনই মনে হত তাঁদের ধর্ষণ করা হত।

প্রথমবার ধর্ষণের কথাটা আলাদাভাবে মনে আছে নাদিয়ার। আইএস ধর্ষকের মোবাইলে হঠাৎ জ্বলে উঠেছিল একটা নাম। সারা। এই একটা মাত্র নামই নাদিয়া জানতে পেরেছিল সেই নরক জীবনে। কে এই সারা? নাদিয়া জানতে পারে, সারা ওই লোকটার মেয়ের নাম।

নাদিয়ার কথায়, যারা ইয়াজিদি মহিলাদের যৌনদাসী বানিয়ে ধর্ষণ করত, তাদের স্ত্রী-রাও জানত গোটা বিষয়। আর এটাকে মেনেও নিত তারা। নাদিয়া বলেন, “আইএস মহিলারা ইয়াজিদি মহিলাদের পশুর থেকেও অধম মনে করত।”

তিন মাসের বেশি বন্দি ছিলেন নাদিয়া। এই তিন মাসে কতবার ধর্ষিত হয়েছেন, কতবার তাঁকে মারধর করা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। নাদিয়া বলেন, ধর্ষণের আগে তাঁদের দিয়ে প্রার্থনা করানো হত। তারপর শুরু হত মার, যৌন অত্যাচার, ধর্ষণ। ‘এক এক সময় মনে হত আত্মহত্যা করি। এই অত্যাচার সহ্য করা যায় না। পরক্ষণেই মনে হত, না, মরব না। বেঁচে থাকব এবং এখান থেকে পালাব।’

পাশবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে কয়েকবার গলা উচিয়ে ছিলেন নাদিয়া। কিন্তু তার পরিণতি আরও ভয়ঙ্কর হল। ছোট্ট অন্ধকার কুঠুরিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। বন্ধ করে দেওয়া হল খাবার। তবে মারধর আর ধর্ষণ কিন্তু থেমে থাকেনি।

থেনে থাকেননি নাদিয়াও। প্রতিমুহূর্তেই তিনি ছক কষেছেন কীভাবে পালানো যায়। প্রথমবার পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। শাস্তি হিসেবে ছ’জন মিলে ধর্ষণ করে তাকে। ততক্ষণ পর্যন্ত মনে আছে, যতক্ষণ না পুরোপুরি জ্ঞান হারিয়েছিলেন তিনি।

lowyer-women-wordsতবে শেষ পর্যন্ত পালাতে পারেন নাদিয়া। আগষ্টে অপহৃত হয়েছিলেন। পালাতে সক্ষম হন নভেম্বরে। পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় পান
এক জার্মান অ্যাসাইলামে। চিকিৎসা শুরু হয়। ধীরে ধীরে সুস্থ হন শারীরিক ভাবে। কিন্তু মানসিক অবস্থা পৌঁছেছিল একেবারে তলানিতে। এই অবস্থা থেকে তাঁকে আলোর পথ দেখান আমল ক্লুনি নামে এক মহিলা আইনজীবী। ক্লুনি একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার কর্মী। নাদিয়ার মতো আরও অনেক মহিলা যাঁরা আইএস-এর হাতে নির্যাতিত হয়েছেন, তাঁদের পরিস্থিতি জানিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে একটি মামলা করেন তিনি।

এখন নাদিয়াও কাজ শুরু করেছেন তাঁরই মতো অত্যাচারিত, নির্যাতিত মহিলা ও শিশুদের নিয়ে। আর সেই কাজেরই জন্য নাদিয়া মুরাদকে গতকাল (শুক্রবার) আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের গুডউইল অ্যাম্বাসাডর করে জাতিসংঘ।

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা