মিনিট পঁচিশে লোপামুদ্রা - Women Words

মিনিট পঁচিশে লোপামুদ্রা


কবি জয় গোস্বামীর বেণিমাধব গানটি শিল্পী হিসেবে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল লোপামুদ্রা মিত্রকে। তাঁর বাড়িshabnam-surita-05-women-words ‘চড়ুইভাতি’ তে উইমেন ওয়ার্ডস এর সাথে আড্ডা জমেছিল। ভারতীয় বস্ত্র ও রূপোর গয়নার একটি বিপণনীও এখানে গড়ে তুলেছেন তিনি। নাম দিয়েছেন ‘প্রথা’। দেয়াল আলো করা শাড়ি-গয়না দেখার ফাঁকে ফাঁকেই আড্ডা জমে
গেল। প্রথা’র বাইরেও তাঁর আরেকটি প্রতিষ্ঠান ‘লোপামুদ্রা প্রোডাকশনস’—গত তিন বছর ধরে জনপ্রিয় লোকগানের দল ‘দোহার’কে নিয়ে আয়োজন করছে বাঙালি ঐতিহ্যের সংস্কৃতি উৎসব ‘সহজ পরব’। এসবও বাদ গেল না আড্ডার বিষয়বস্তু থেকে।

প্রিয় পাঠক, লোপামুদ্রা মিত্রের সাথে সেই আড্ডার চুম্বক অংশ আপনাদের জন্য তুলে ধরেছেন

শবনম সুরিতা ডানা


শবনম সুরিতা ডানা : ‘সহজ পরব’ এবছরের মত শেষ হল। কেমন লাগছে?
লোপামুদ্রা মিত্র: ‘সহজ পরব’ তৃতীয়বারের মতো হয়ে গেল। ‘সহজ পরব’ করতে গিয়ে এই তিনবছর পেরিয়ে একটা শিক্ষা হয়েছে। আসলে আমরা তো সবাই মিউজিশিয়ান, শিল্পী। আমাদের মধ্যে আবেগের পাল্লাটাই একটু বেশি ভারী। তিনবারে শিখলাম, আবেগকে বাগে এনে আরো বাস্তবিক হতে হবে। তবে এটা ঠিক, সহজ পরব আমাদের কাছে সত্যিকারের একটা পরব। অনেকটা দুর্গাপূজোর মতন। এখন তাই বিজয়া দশমীর মন কেমন করা ভাব কাটিয়ে উঠতে পারছি না।

আবেগ না থাকলে ২৫ বছরের শিল্পী জীবন সফলতার সাথে কাটাতেও পারতেন না। কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত ‘পঁচিশে লোপা, lupa-02-women-wordsকুড়িতে বেণীমাধব’ অনুষ্ঠানেও একথা বলেছেন আপনি। ফিরে তাঁকালে বিগত পঁচিশে লোপাকে কেমন দেখেন? কিছু কি পাল্টেছে?
বয়েসটা হয়েছে। আগের মতন ছুটে বেড়াতে পারিনা। নিজের মধ্যে আগের তুলনায় অনেক স্থিরতা, প্রশান্তি দেখতে পাই, দেখতে চাইও সেটা। গানে কিন্তু বয়সের ছাপ পড়েনি, যেমন ছিলাম ঠিক তেমনই আছি। আনুষাঙ্গিক যা কিছু তাতে বয়সের ছাপটা পাই।

আগে গায়িকা ছিলেন, এখনও তাই। সাথে জুড়েছে সফল সংগঠকের ট্যাগ, ‘প্রথা’ও আছে। এতকিছু সামলান কীভাবে? মনে হয়নি কখনও যে বাড়ির মানুষটাকে কম প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে?
বাড়ির মানুষের ক্ষেত্রে আমি অসম্ভব লাকি, কারণ আমার জীবনসঙ্গি (সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক জয় সরকার) যে সেও আমার মতই, আমার দুনিয়ার মানুষ। কিন্তু মজার বিষয় সে আমার এই সংগঠক ভূমিকাটাও বুঝে না, শাড়ি-গয়নাটাও বুঝে না। আমার মিউজিকটুকু বুঝে। তাঁর কাছে মিউজিকটাই সব। সেই কারণেই কখনও মনে হয়নি প্রাধান্যের কথা। আর একজনের কথা না বললেই নয়, তিনি হচ্ছেন আমাদের বাড়িতে সর্বক্ষণ কর্মরতা মাসি। যার অক্লান্ত পরিশ্রম, ভালোবাসা আর প্রশ্রয়ের কারণে আমি কেন, আমার স্বামীও নিজেদের বাড়িতে রীতিমত ‘ পেয়িং গেস্ট’ হয়ে কাটিয়ে দিচ্ছি দিব্যি।

অবশ্যই। আপনার জীবনে এমন অনেক নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে জানি।
হ্যাঁ, আমার মা আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে আধুনিক এবং স্বাধীনচেতা নারী। একটা মজার কথা বলি, যে সময়ে ঠিক করলাম বিয়ে করব, বাড়িতে জানানোর পর মায়ের প্রতিক্রিয়া শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। যে মানুষটা সারা জীবন শুধু সংসার করে গেল, তেমন আহামরি পড়াশোনাও করেনি, সেই মা আমায় বলেছিলেন ‘বিয়ে তো সবাই করে, আমিও করেছি। তুই যেমন একটা মানুষ, তোর কি বিয়ে করতেই হবে?’ মা তো জয়কেও বলেছিলেন, ‘তুমি জান তো কাকে বিয়ে করছ?’ আসলে এমন মানুষদের পেয়েছি বলেই আমি আমার মত করে, স্বাধীনভাবে যা করতে চেয়েছি, তা করতে পেরেছি।

lupa-03-women-wordsআপনার মা বা আপনি যে প্রজন্মের মানুষ, তার সাথে এখনকার প্রজন্মের মেয়েদের কোন মিল-অমিল পান কি?
একটা বিষয় আমার খুব মনে হয়, তবে সেটা ছেলে-মেয়ে বলে আলাদা করে বলতে পারব না। আমার মনে হয় আজকের প্রজন্ম অনেক বেশি স্পষ্টভাষী। হয়ত সেটা তাদের বেড়ে ওঠার পারিপার্শ্বিক পরিবেশের কারণে। তবে একই সাথে মাঝে মাঝে নিজেকে কিছু কিছু জায়গায় এই প্রজন্মের সাথে মেলাতে পারিনা। যখন দেখি স্বাধীনতার চেতনাকে উচ্ছৃঙ্খলতার সাথে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে, তখন সেটা মেনে নিতে পারি না একদমই। আসলে আমাদের সামাজিক সংস্কৃতির একটা বড় অংশ তো এই ধারণাগুলো থেকেই জন্ম নেয়।

lupa-06-women-wordsধারণার কথাতেই যদি আসি, একটা সময়ে তো বাংলার সঙ্গীত জগতে নির্দিষ্ট কিছু গলারই চলন ছিল। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে আপনি একটা নিজস্ব ঢং, স্টাইল তৈরী করতে পেরেছিলেন। এখনকার অবস্থা কেমন বলে মনে হয় আপনার?
এখন আর আগের মত দিন নেই। পরিস্থিতি অনেক ভালো। আমাদের সময়ে কেউ ভাবতেই পারত না আমায় দিয়ে হিরোইনের গান গাওয়াবে। হিরোইনের গান মানেই শুধু পাতলা গলার আওয়াজ আর নরম, কোমল হাবভাব। এমনই যেন আদর্শ মেয়ের গলা হওয়া উচিত আর কি। কিন্তু আমার খুব স্বপ্ন ছিল (এখনও আছে) শুধু মেয়েদের একটা বাংলা গানের ব্যান্ড হবে। মেয়েরাই ড্রামস, গিটার সব বাজাবে, গাইবে। হইহই করে দাপিয়ে গান-বাজনা করতে পারবে এমন একটা ব্যান্ডের স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি। কিন্তু এটা আর হলো না।

কেন?
ইন্ডাস্ট্রির লোক যদিও বা করতে দেয়, মেনে নেয়, বাড়ির লোক দেবে না। এতগুলো মেয়ে মিলে রাত-বিরেতে গান গেয়ে বাড়ি ফিরবে কখন ঠিক নেই, এটা মেনে নেবার জন্য আমাদের সময়-সমাজ এখনও তৈরী হতে পারেনি।

lupa-04-women-wordsশেষ প্রশ্ন। একদমই এসবের বাইরে গিয়ে করছি। এপার বাংলার বাইরে ওপারে, বাংলাদেশে তো গান গাইতে গিয়েছেন অনেকবারই। সেখানে আপনার পরিচিতিও ভালো। ‘সহজ পরব’ বা ‘প্রথা’ কে ওপারে নিয়ে যাওয়ার কোন পরিকল্পনা আছে কি?

প্রথা আসলে আমার সময় কাটানোর একটা দারুণ অজুহাত। জানি না হবে কি না, কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে দুই বাংলার শাড়ির যুগলবন্দী আয়োজন করার। আসলে শিকড়ের টানটা এখনও রয়ে গেছে তো, তাই ওটার বাইরে বেরোতে পারিনা। আমার মামার বাড়ি মাগুরায়। এখনও মামা থাকেন সেখানে, যদিও আমার কখনো যাওয়া হয়নি ওখানে। অনুষ্ঠান করতে যাওয়া ছাড়া আমি স্রেফ বেড়াতেও কক্সবাজার গিয়েছি। আমার অত্যন্ত প্রিয় জায়গা। তবে সহজ পরবের বাংলাদেশ যাত্রা নিয়ে ভেতরে ভেতরে কিছু ইচ্ছে-আশা জন্ম যে নেয়নি সেটা বলব না। পরিকল্পনাও তৈরী হচ্ছে আস্তে আস্তে। মনে হচ্ছে, ‘সহজ পরব’ আজ না হোক কাল, ওপার বাংলায় পৌঁছবে নিঃসন্দেহে।

শবনম সুরিতা ডানা, ভারত চ্যাপ্টার সম্পাদক, উইমেন ওয়ার্ডস