টাইগার্সদের ৭ রানের রুদ্ধশ্বাস জয় - Women Words

টাইগার্সদের ৭ রানের রুদ্ধশ্বাস জয়

রেজা ঘটক

আমি যখন বাসায় ফিরি তখন জয়ের জন্য আফগানিস্তানের প্রয়োজন ছিল ৬৬ বলে ৮০ রান। হাতে ছিল ৮ ইউকেট। বন্ধুবর মঈনুল বিপ্লব ছোট্ট করে কমেন্ট দিলো, ধরা খাইতাছো নিকি!!! জবাবে আমি কনফিডেন্টলি বললাম, চান্স ৫০ ফিফটি। খেয়াল করলাম, ৪০তম ওভারে তাইজুল ইসলাম মাত্র ১টি রান দিয়েছিলেন। ওটাই ম্যাচ প্রেডিক্ট করতে আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছিল। টিএসসিতে বসে ম্যাচ হেরে যাচ্ছি, এমন একটি আশংকা নিয়েই শেষের ওভারগুলো বাসায় দেখব বলে চলে আসি।

৪১তম ওভারে ম্যাচের অবস্থা দাঁড়ালো জয়ের জন্য আফগানিস্তানের প্রয়োজন ৬০ বলে ৭৭ রান। কিন্তু শাকিব আল হাসানের এই ওভারটি আসলে আজকের ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট। ৪১তম ওভারে শাকিব মাত্র ৩ রান দিয়ে রহমত শাহ’র মূল্যবান ইউকেটটি তুলে নিলেন। মুশফিকের হাতে স্ট্যাম্প হবার আগে রহমত শাহ ৯৩ বলে করেছিলেন মূল্যবান ৭১টি রান।

৪২তম ওভারে তাইজুল ৮ রান দিলে জয়ের জন্য আফগানিস্তানের প্রয়োজন পড়ে ৪৮ বলে ৬৬ রান। হাতে তখন ৭টি ইউকেট। ক্রিজে তখন অপর সেট ব্যাটসম্যান হাসমতুল্লাহ শহীদি। তাসকিন ৪৩তম ওভারে দিলেন ৯ রান। গ্যালারির দর্শকরা কিছুটা চিন্তিত। কিন্তু পরের ওভারে তাইজুল আবার দারুণভাবে বাংলাদেশকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনলেন। ৪৪তম ওভারে তাইজুল ৮ রান দিলেও হাসমতুল্লাহ শহীদির মূল্যবান উইকেটটি নিলেন। হাসমতুল্লাহ শহীদি ১১০ বলে ৭২ রানের দারুণ একটি ফাইটিং ইনিংস খেলেছেন।

ম্যাচের ভাগ্য তখনো পেন্ডুলামের মত দুলছিল। কারণ মোহাম্মদ নবি তখনো দারুণভাবে ব্যাট করে আফগানদের স্বপ্ন দেখাচ্ছিলেন। ৪৪ ওভার শেষে আফগানদের তখন প্রয়োজন ৩৬ বলে ৪৯ রান। হাতে ৬টি উইকেট। ক্রিজে তখন মোহাম্মদ নবি। ৪৫তম ওভারে রুবেল দিলেন ১১ রান। আফগানদের স্কোর তখন ৪৫ ওভার শেষে ২২৮। হাতে তখনো ৪ উইকেট। ৪৬তম ওভারে ক্যাপ্টেন মাশরাফি আঘাত হানলেন শত্রু শিবিরে। আফগানদের স্কোর দাঁড়ালো ৪৬ ওভার শেষে ৪ উইকেট হারিয়ে ২৩৮ রান। ২৪ বলে দরকার ২৮ রান। ম্যাচে তখন চরম উক্তেজনা। যে কেউ এই ম্যাচ জিতবে এমন অবস্থা।

 

bd-afgan-1st-odi-2-women-wo

এই সময় আবারো আফগানদের রানের টুটি চেপে ধরলেন শাকিব। শাকিব নিচের দশম ওভারে মাত্র ১টি রান দিয়ে ম্যাচে ফেরালেন বাংলাদেশকে। তখন থেকে বাংলাদেশ দল আবারো উজ্জীবিত। এরপরের ওভারে অর্থ্যাৎ ৪৮তম ওভারে তাসকিন তুলে নিলেন সেই ঐতিহাসিক জোড়া উইকেট। ম্যাচ ঝুকে গেল টাইগার্সদের দিকে। ৪৮ ওভার শেষে আফগানদের স্কোর ৭ উইকেট হারিয়ে ২৪৫ রান। জয়ের জন্য প্রয়োজন ১২ বলে ২১ রান। ৪৯তম ওভারে রুবেল শেষ বলে রশিদ খানের উইকেট তুলে নিলে আফগানদের অবস্থান দাঁড়ায় ৮ উইকেট হারিয়ে ২৫৩ রান।

অর্থ্যাৎ জয়ের জন্য শেষ ৬টি বলে প্রয়োজন ১৩ রান। বাংলাদেশের তখন প্রয়োজন শেষ দুটি উইকেট। ৫০তম ওভার করতে আসলেন তাসকিন। প্রথম বলে মিরওয়াইজ আশরাফ নিলেন ২ রান। আফগানদের তখন প্রয়োজন ৫ বলে ১১ রান। দ্বিতীয় বলেই তাসকিন এলবিডব্লিউ করে দিলেন মিরওয়াইজ আশরাফকে। আফগানদের দরকার আরো ১১টি রান। টাইগার্সদের দরকার মাত্র একটি উইকেট।

তাসকিনের তৃতীয় বলে লেগ বাই ১ রান। চতুর্থ বলে দৌলত জর্ডান নিলেন ২টি রান। আফগানদের প্রয়োজন ২ বলে ৮ রান। তাসকিন ৫ম বলটি ডট দিলেন। এবার আফগানদের দরকার ১ বলে ৮ রান। বাংলাদেশের দরকার একটি উইকেট অথবা একটি মাত্র ভালো বল। শেষ পর্যন্ত তাসকিনের শেষ বলে দৌলত জর্ডান শাব্বিরের হাতে ক্যাচ দিলে অলআউট হয় আফগানরা। বাংলাদেশে জিতে যায় ৭ রানে।

ঠিক দশ মাস পর একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে নেমে টাইগার্সরা এক রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে শেষ পর্যন্ত আফগানদের বিপক্ষে জয় ছিনিয়ে নিয়েই বুক উঁচিয়ে মাঠ ছাড়েন।

এর আর টসে জিতে ক্যাপ্টেন মাশরাফি প্রথমে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন। আকাশের অবস্থা বিবেচনা করেই ব্যাট করার সিদ্ধান্ত। কারণ আকাশে বৃষ্টির খুব ভালো আলামত ছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশ ৩০০ রানের মত আশা জাগিয়ে শেষ ১০ ওভারে মাত্র ৬৮ রান তুলেছে এবং ৭টি উইকেট হারিয়ে আফগানদের মত ইনিংসের শেষ বলে অলআউট হয়। তার আগে তামিম ও মাহমুদুল্লাহ’র হাফ সেঞ্চুরি এবং শাকিব ও ইমরুলের নির্ভরযোগ্য ব্যাটিংয়ের উপর ভর করে ২৬৫ রানের একটি ফাইটিং স্কোর করতে সক্ষম হয়। যদিও আমি আজকে ২৮০ রানের প্রেডিক্ট করেছিলাম। মনে হচ্ছিল টাইগার্সরা অন্তত ১৫টি রান কম করতে পেরেছে। আজকের ম্যাচেও সেই ১৫ রানের কারণেই এত এত টান টান উক্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।

আগামী মাসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে নামার আগে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ তিনটি ওডিআই ও দুটি টেস্ট খেলবে। যার প্রথমটি আজ ৭ রানে জিতে নিল টাইগার্সরা। দশ মাস পরে ওডিআইতে মাঠে নেমে আবারো দর্শকদের মান রক্ষা এবং নিজেদের দারুণভাবে ম্যাচে ফেরার যে দৃশ্যায়ন আজ টাইগার্সরা করলেন, তাতে টাইগার্সদের জন্য হৃদয় নিড়ানো অভিনন্দন।

আজ সৌম্য সরকার একটি বল খেলে শূন্য রানে আউট হবার সময় বাংলাদেশের স্কোর ছিল ১ রান। সেই তলানি থেকে তামিম ও ইমরুল দারুণ একটি পার্টনারশিপ দিয়ে দলকে তুলে আনেন। তামিম একটু ছটফট না করলে আজকে সেঞ্চুরিটা আসতে পারতো। দলীয় সর্বোচ্চ ৮০ রান এসেছে তামিমের ব্যাট থেকে। কিন্তু তামিম বল খরচ করেছেন অনেক। যা তামিমের স্বাভাবিক খেলার সঙ্গে মোটেও যায় না। ৯৮ বলে তামিম করেছেন ৮০ রান। মাহমুদুল্লাহও বলের চেয়ে রান কম করেছেন। দলীয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬২ রান করতে মাহমুদুল্লাহর লেগেছে ৭৪ বল। শাকিব ৪০ বলে করেছেন ৪৮ রান। এছাড়া ইমরুল কায়েস করেছেন ৫৩ বলে ৩৭ রান। চৌকশ ব্যাট বলের জন্য ম্যাচ সেরা শাকিব।

আফগানদের পক্ষে দৌলত জর্ডান ছিলেন সবচেয়ে সফল বোলার। তিনি ১০ ওভারে ৭৩ রান দিলেও নিয়েছেন ৪টি উইকেট। আফগান বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো বল করেছে রশিদ খান। দারুণসব গুগলিতে টাইগার্স ব্যাটসম্যানদের নাকানিচুবানি খাইয়েছেন এই তরুণ আফগান লেগ স্পিনার। ১০ ওভারে ৩৭ রানে নিয়েছেন ২ উইকেট। এরপর ভালো বল করেছেন মোহাম্মদ নবি। নবি ১০ ওভারে ৪০ রান দিয়ে নিয়েছেন ২টি উইকেট। আজকের ম্যাচে আফগানদের ডেব্যু তরুণ বোলার নাভিন-উল হক মাত্র একটি উইকেট দিয়ে তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ান শুরু করলেন। ১০ ওভারে ৬২ রান দিয়ে নিয়েছেন মাশরাফি’র উইকেটটি। এটি নাভিনের ডেব্যু উইকেট।

বাংলাদেশের পক্ষে তাসকিন আইসিসি’র নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে মাঠে নেমে দারুণভাবে ম্যাচে ফিরেছেন। ১০ ওভার বল করে ৫৯ রান দিয়ে নিয়েছেন ৪ উইকেট। মূলত তাসকিনের দুই ওভারের দুই জোড়া উইকেট আজকের ম্যাচ জিততে টাইগার্সদের সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। ৪২ রানে মাশরাফি ২টি, ২৬ রানে শাকিব ২টি, ৬২ রানে রুবেল ১টি ও ৪৪ রানে তাইজুল ১টি উইকেট নেন। আফগানদের পক্ষে সর্বোচ্চ রান করেন হাসমতুল্লাহ শহীদি ৭২ এবং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭১ রান করেন রহমত শাহ।

টাইগার্সদের জন্য একাদশ গঠনে এখনো একটু খাপছাড়া ভাব রয়েছে। আমি সৌম্য সরকারকে ওয়ান ডাউনে নামানোর পক্ষে। তামিম ও ইমরুলকে দিয়ে ওপেন করানোরপক্ষে। পরের ম্যাচে আমি রুবেল ও তাইজুলের জায়গায় মোসাদ্দেক হোসেন ও সাইফুল ইসলামকে নেবার পক্ষে। সৌম্যকে আরো একটি ম্যাচ সুযোগ দিতে চাই। কারণ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যাতে সৌম্য ফর্মে ফিরতে পারে, সেই সুযোগটি দেবার জন্য। পাশাপাশি আজকে আমি সবচেয়ে বেশি হতাশ মুশফিকের উপর। মাহমুদুল্লাহ আউট হবার পর মুশফিকের কাছে যেটি আশা করেছিলাম, সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তবুও দিন শেষে টাইগার্সদের এই রুদ্ধশ্বাস কষ্টের জয় জয়ের ধারাকে টেনে নেবে এই প্রত্যাশা। জয়তু টিম টাইগার্স। জয়তু ক্রিকেট।

রেজা ঘটক, কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা