মা গো আমি তোমার চরণ, করব শরণ, আর কারো ধার ধারব না মা - Women Words

মা গো আমি তোমার চরণ, করব শরণ, আর কারো ধার ধারব না মা

অদিতি দাস

মা ডাকটির মাঝে যে আবেগ লুকিয়ে আছে, আর কোনো শব্দে সেরকম আবেগ নাই। সবচেয়ে মধুরতম শব্দ মা।

যেহেতু আমরা একটি দু:সহনীয় সময় অতিক্রান্ত করছি, তাই অনেকের মা-ই হয়তো এই সময়ে অসুস্থ। একটু অক্সিজেনের জন্য হাসপাতালের আইসিইউ তে ভেন্টিলেটরের পাশে শুয়ে অসহনীয় যন্ত্রণা ভোগ করছেন যেসব মায়েরা, তাদের সন্তানরা মাকে বাঁচাতে সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছেন। আমি জানি সেসব সন্তানদের অবস্থা। কিংবা যেসব সন্তানেরা কোভিড আক্রান্ত-তাদের মায়েরা বিনিদ্র কাটাচ্ছেন একেকটি রাত। সবচেয়ে খারাপ আছেন তারা-যারা এই মহামারীতে মাকে হারিয়েছেন।

আজ মা দিবস। আসলে সঠিক করে বললে মা বিহীন মা দিবস। কিন্তু না থেকেও যে কী তীব্রভাবে থাকা যায়-সেটাই প্রমাণ করলে মা। শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে তুমি, আমার যে প্রিয় খাবারটা তুমি রান্না করতে-সেটা রান্না করতে গেলেও তুমি, সন্ধ্যাবেলায় চা খাওয়ার সময় তুমি, লেখালেখি করলে তুমি, গান গাইলে তুমি, আমার কোনো সাফল্যে সবচেয়ে আনন্দিত হওয়া মানুষ তুমি, আমার ভুলগুলো নিয়ে বিরক্ত হওয়া তুমি,  মনে হয় যেনো প্রতিটি নি:শ্বাসের সাথে তুমি আছ। কত কথা জমে বুকটা ভারি হয়ে আছে-সেগুলো কাকে বলব মা?

সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন মা, যদি আমার ছেলেবেলায় ফিরে যাই-বাবা, আমার ভাই ও আমাকে খাইয়ে, রেডি করে স্কুলে পাঠাতেন। দাদাভাই আর আমার জন্য টিফিন দিয়ে দিতেন। তারপর নিজে খেয়ে না খেয়ে স্নান করে ভেজা চুলেই কর্মক্ষেত্রে যেতেন। প্রায় বিকেলে বাসায় ফিরে খেয়ে একটু রেস্ট নিতেন। তারপর আবার রান্না, ঘরের অন্যান্য কাজ। তোমাকে এরকমটি দেখেই তো বড় হয়েছি। মিশুক কিন্তু ব্যক্তিত্বময়ী ছিলেন আমার মা। শরীর-মন খারাপ লাগলে তোমার কাছে গেলেই শান্তি লাগত। আবার এরকম সময় ও গেছে যে আমাদের তীব্র ঝগড়া হতো, অভিমান করে ভাত না খেয়েও থেকেছি কতদিন। এখন যখন ক্লান্ত শরীরে নিজের খাবার রেডি করতে হয়-তখন মনে হয় সে সময়ে কত বোকাই না ছিলাম। আমি যে শক্ত মন মানসিকতা পেয়েছি-তাতো তোমার কাছ থেকেই পাওয়া-ভাঙব তবু মচকাবনা।

মিষ্টিমাসির সাথে

মায়ের পরে যার কথা না লিখলে অন্যায় হবে-তিনি আমার মিষ্টিমাসি-আমার দ্বিতীয় মা। ভয়ংকর রকমের ঠান্ডা মেজাজের, মেধাবী, ধৈর্যশীল, দায়িত্বশীল, স্নেহশীল একজন মানুষ। বিসিএস ক্যাডার ছিলেন, এডিশনাল সেক্রেটারি হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন। ঘর-সংসার সামলে এতো বড় দায়িত্ব সামলিয়েছেন। তীব্র ব্যক্তিত্ব থাকলেও অহংকারের ছিটেফোঁটা নেই। একমাত্র ছেলেকে বিয়ে করিয়ে তিনি এখন শাশুড়ি। আর শাশুড়ি হিসেবেও তিনি সফল। এদেশের মেয়েরা যেখানে শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতিত, কিন্তু তিনি কত আদরে যে ছেলের বউকে রেখেছেন, না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। নিজের বাসার পর যে বাসাটাকে আমার আপন বাসা মনে হয়-সেটা হলো মিষ্টমাসির বাসা।

এদেশের তাবৎ মায়েরা রান্নাঘরেই জীবন কাটিয়ে দেন, সন্তানদের মঙ্গল কামনাই যেনো তাদের মূল কাজ। আবার এমন মা ও আছেন যারা সন্তানদের প্রতি অন্ধ, দোষ-গুণ পরিমাপ করেন না, ছেলে সন্তানদেরকে সঠিক শিক্ষা দেন না যে কিভাবে একটা মেয়েকে বা নারীকে শ্রদ্ধা করতে হবে, মানুষ ভাবতে হবে। আবার অনেক মা-ই ৭১ সালে ছেলেকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন, সন্তানের জন্য নিজের প্রাণ দিয়েছেন -এরকম কত কত সাহসী মা ছিলেন এবং আছেন পৃথিবীতে। মা দিবসে পৃথিবীর সকল মায়েদের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

মাকে হারালে মায়ের মূল্য বেশি করে বোঝা যায়। তাই বেঁচে থাকতেই মা’র প্রতি সবাই যত্নশীল হোন। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের প্রতি খেয়াল রাখুন, তাদেরকে সময় দিন।

 

কবিগুরুর জন্মদিন ছিল কাল। মা রবীন্দ্রসঙ্গীত খুব পছন্দ করতেন, গুনগুনিয়ে গাইতেন ও। তাই কবিগুরুর লাইন দিয়েই লেখার ইতি টানছি-

”যখন অনাদরে চাই নি মুখে ভেবেছিলেম দুঃখিনী মা
আছে ভাঙা ঘরে একলা পড়ে, দুখের বুঝি নাইকো সীমা।
কোথা সে তোর দরিদ্র বেশ, কোথা সে তোর মলিন হাসি—
আকাশে আজ ছড়িয়ে গেল ঐ চরণের দীপ্তিরাশি!
ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে॥
আজি দুখের রাতে সুখের স্রোতে ভাসাও ধরণী—
তোমার অভয় বাজে হৃদয়মাঝে হৃদয়হরণী!
ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।”