’বাইশে শ্রাবণ’ এবং শান্তিনিকেতন - Women Words

’বাইশে শ্রাবণ’ এবং শান্তিনিকেতন

মিতু বালা

“বাইশে শ্রাবণ” শুনলেই মনের মধ্যে হাজার ভাবনা খেলা করে, তা কেবল মৃত্যু ভাবনা’য় সীমাবদ্ধ থাকে না। রবি ঠাকুরের পদচারণা বৃহত্তর জগৎ জুড়ে। তাই মৃত্যু নিয়ে তাঁর ধ্যান-ধারণা ছিলো ব্যতিক্রম। মৃত্যুর মধ্যেও যে সৌন্দর্য আছে এবং এটাও যে সহজ সাবলীল তা বোধহয় রবীন্দ্র সৃষ্ট সাহিত্যই প্রথম আমাদের জানান দিয়েছিলো। তিনি মৃত্যুকে খুব সুন্দর ভাবে গ্রহণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কাব্য মানস পটে মৃত্যু চিন্তার নানা ভাবের প্রতিফলন ঘটেছিলো। মৃত্যুকে কখনও তিনি বন্ধু রূপে কল্পনা করেছেন, কখনও সখা কিংবা প্রেমিকের রূপে ভেবেছেন। আবার কখনও মৃত্যুকে “অতি নিচ”,“অনুদার”,“সর্বগ্রাসী” বলে কটুকাটব্য করেছেন। পারিবারিক ভাবে মৃত্যু শোকে বারবার জর্জরিত হয়েছেন। তাই মৃত্যু ভাবনা উড়ো মেঘের মতো ঘুরেফিরে এসে নাঁড়া দিয়েছে তাঁর মানস লোকে। জীবনের শেষ বেলার উপলব্ধি অবশ্য কিছুটা দার্শনিক গোছের ছিলো; কিছুটা সংশয়,অস্পষ্টতা, উদাসীনতা ভর করেছিলো। ব্যক্তিগত ভাবে রবীন্দ্রনাথের একান্ত ইচ্ছে ছিলো মৃত্যুর পর শান্তিনিকেতনের অবাধ প্রকৃতির মাঝে বিলীন হয়ে যাওয়ার;কলকাতার আড়ম্বর পূর্ণ শোকযাত্রা তিনি কখনও চাননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজ নেই কিন্তু তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য জুড়ে এখনও তাঁর অবাধ বিচরণ চলছে। মহাকাল সৃষ্টিকর্মকে গ্রহণ করে আর ব্যক্তি মানুষ কালের গর্ভে হারিয়ে যায় – এমন ধারণাই “সোনার তরী” কবিতার অর্ন্তনিহিত গূঢ় অর্থে কবি ব্যক্ত করেছিলেন। ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে আমরা হারিয়ে ফেলেছি, কিন্তু তাঁর সৃষ্টির সুর এখনও ঝংকার দেয়,কথার ডালপালা মেলে। একান্তে জমিয়ে রাখা অজস্র প্রশ্নোত্তরের প্রত্যুত্তর দেয়। এটাও কি বেঁচে থাকা নয়?

আজও বাইশে শ্রাবণে তাঁর গান,কবিতা,নাটকে মুখরিত হচ্ছে চারিদিক। চিরন্তন তাঁর সৃষ্টি। অমলিন হবার নয়। আজও যেমন তাঁর গানের কথা চিরন্তন বলে মনে হয়। আগামীকালও এমনটা হবে। রবীন্দ্রনাথ এখনও চিরঞ্জীবী ।

কবি গুরুর প্রয়াণ দিবসে তাঁর সাধের শান্তিনিকেতনে এই বাইশে শ্রাবণে’র উদযাপনের রীতিটা খানিকটা ভিন্ন গোছের। “বৃক্ষরোপনে”র মাধ্যমে এই দিনটি উদযাপিত হয়।ভোরের বৈতালিক থেকে অনুষ্ঠানের শুভারম্ভ ঘটে। বিকেলে শোভাযাত্রা থেকে বৃক্ষরোপণ করার প্রক্রিয়াটিও শেষ হয় নানা ধরণের রীতিনীতিকে আবর্তিত করে। এই বৃক্ষরোপণ উৎসবে মূলত প্রকৃতিকে বরণ করা হয়। পুরোটা জুড়েই প্রকৃতি পূজার সাজসজ্জা। বৃক্ষরোপণে যে চারাগাছটি রোপণ করা হবে সেই গাছটি পালকিতে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সঙ্গে থাকে পঞ্চকণ্যা,পঞ্চপুত্র ও ছত্রবাহক। কলাভবনের পাঁচ জন ছাত্রীকেই পঞ্চকণ্যার রূপে সাজানো হয়। এদের পরনে রবীন্দ্র নৃত্যের অনুকরণে শাড়ি,ফুলের অলংকার ও উত্তরীয় থাকে। এই পঞ্চকণ্যাকে পঞ্চভূতের (যথাক্রমে:জল,বায়,অগ্নি,মৃত্তিকা ও প্রাণ) প্রতিনিধি হিসেবে মনে করা হয়। এদের হাতে থাকে জলের পাত্র, হাতপাখা, ধূপদানীর ধূপ,মাটির তাল এবং শাঁখ যথাক্রমে জলকে,বায়ুকে,আগুনকে,মৃত্তিকাকে এবং শুভ প্রাণের স্পন্দনকে প্রতীকায়িত করে। পঞ্চপুত্র হিসাবে সাজানো হয় পাঠভবনের পড়ুয়ারত ক্ষুধে শিশুদের, এদের পরিহিত পাঞ্জাবির রঙ, মাথায় থাকা মুকুটের কারুকার্য, কপালের সুসজ্জিত টিপের ফোঁটা যথাক্রমে ক্ষিতি, তেজ, ও ব্যোমকে নির্দেশ করে। এছাড়া ছত্র ও পালকি বাহক হিসেবে সাজানো হয় ছয়জন ছাত্রকে, এদের মধ্যে দু’জন ছত্র ধরে রাখে আর অন্য চারজন পালকি বাহকের কাজ করে। চারাগাছটি সুসজ্জিত করে পালকির মধ্যে বসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।পালকি জুড়ে চমকপ্রদ ফুলের সাজ। পালকির আগুপিছু করে ছত্রবাহকের হাতের ছাতাও ঝলমলে ও দ্যুতিময় শোভা ছড়ায়।বৃক্ষরোপণের স্থানেও আলপনা ও ফুলের সাজে সাজানো হয়।বিশাল শোভাযাত্রার উপস্থিতিতে চারা গাছটি রোপণ করা হয়। শ্লোক পাঠে মুখরিত হয় চারদিক। শাঁখ বাজিয়ে সুরধ্বনির সৃষ্টি হয়;পাখার বাতাস সঙ্গে ধূপের ধোয়ার সম্মিলিত সুগন্ধে রোপণ করা হয় চারাগাছটি।

রবি ঠাকুরের প্রয়াণে এমন উদযাপন তাঁর সৃষ্টিকে’ই জাগিয়ে তোলে। প্রকৃতি বন্দনাই রবি বন্দনায় রূপ নেয়। তাঁর প্রয়াণে এমন উৎসবেই জেগে উঠুক প্রকৃতি ও মনুষ্যত্ব।