মিতু বালা
আজ লিথিলার বিয়ে।মিষ্টি সুরে সানাই বাজছে। সানাইয়ে’র সুর মেঘের মতো উড়ে উড়ে জানান দিচ্ছে বিয়ের। আমার ব্যালকনি থেকে ওদের টিনের বাড়িটা দেখা যায়। টিনের গায়ে গাঢ় আকাশী রঙের প্রলেপের জন্য বাড়িটা দূর থেকেই চকচক করে। বিয়ের সাজে আজকে বাড়িটাকে আরো বেশি রঙিন মনে হচ্ছে। কাক ভোরে দধি মঙ্গলের আয়োজন হয়েছিল; শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনির আওয়াজে ঘুম ভেঙেছিল আমার। এখন, গায়ে হলুদ উপলক্ষ্যে কলসি কাঁখে জল আনতে পুকুরে যাচ্ছে সবাই। গায়ে হলুদের জল আনতে গিয়ে হঠাৎ দু’ মিনিটের ঝুম বৃষ্টির জল সবাইকে সিক্ত করে দিলো। পাশেই ঘাটলা বাঁধা একটা পুকুর আছে। ছোটবেলা থেকে পুকুরটা দেখছি। পুকুরটা এখনও জীবিত। শুনেছি পুকুরের মালিকানা বহুজনের নামে। ভাগবাটোয়ারা করলে খুব সামান্য অংশ সবাই পাবে। হয়তো-বা এজন্যই পুকুরটার অস্তিত্ব এখনও আছে। বরে’র বাড়ি থেকে বরে’র গায়ে মাখানো হলুদ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তা নিয়ে সবার হৈচৈ লেগেছে। এবং নানা স্ত্রী আচারের মধ্যে দিয়েই লিথিলা’কে সেই হলুদ মাখানো হচ্ছে । লিথিলা গাঢ় হলুদ রঙের একটা জামদানী শাড়ি পড়েছে সঙ্গে গোলাপী রঙের একটা ব্লাউজ। চুল গুলো আলতো করে একটা খোঁপায় জড়িয়ে রয়েছে। খোঁপা ভর্তি কাঠগোলাপ ফুল। খোঁপার কারণে ব্লাউজের পেছনের নকশাটা খুব নজর কাড়ছে। ব্লাউজের ঠিক পেছনে মা দুর্গার মুখ। সেলাই করা চোখের কাজটা বড্ড বেশি চটক দিচ্ছে। মা দুর্গার চোখটা যেন দূর থেকে ধেয়ে আসছে। কপালের ঠিক মাঝখানে কুমকুমের সাজ। কুমকুম দিয়ে হলুদের বিন্দু বিন্দু ফোঁটা তার মাঝখানে একপাশে লাল অন্যপাশে গোলাপি আভা। গলায় কাঠগোলাপ ফুলের একটা লম্বা মালা ঝুলছে। হাতে কাঠগোলাপ ফুলের চুড়ি দুলছে। লিথিলার মুখ জুড়ে আলো আঁধারের একটা ছায়া বিরাজ করছে। ওর মনে বিষন্নতা নাকি সুখ ভর করেছে সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে, আশপাশের মানুষেরা যে ওকে ঘিরে বেশ একটা উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি করেছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। একজন অন্যজনের মুখে হলুদ ছোঁয়াচ্ছে, কেউ সেটা সাদরে আহ্বান করছে কেউ আবার মুখ লুকিয়ে পালাচ্ছে। তবুও তাদেরকেও জোরজবরদস্তি করে মুখে হলুদ মাখিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বরং পালিয়ে যাওয়ার শাস্তি স্বরূপ তাদেরকে বেশি বেশি করে হলুদ মাখানো হচ্ছে। ধুম জোরে গান বাজছে। তারমধ্যে আবার কেউ ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। লিথিলার পিসি মাসীর দলবল বেশ হেলেদুলে নাচছে। পা’য়ে পা মিলিয়ে, হাতে হাত মিলিয়ে। লিথিলার বান্ধবী, বোনেরা দূর থেকেই হাত দুলচ্ছে। ওরাও আবার একটু একটু করে ঐ নাচের তালিকায় যুক্ত হলো। এবার লিথিলা কে টেনেটুনে নিয়ে যাওয়া হলো নাচের আসরে। লিথিলা এমনিতে লাজুক প্রকৃতির মেয়ে, তারপরও ওদের সঙ্গে কেমন সাবলীল ভাবে নাচছিলো। দূর থেকে সবটাই আমি দেখছিলাম।
এবার শঙ্খ কঙ্কন পর্ব শুরু হলো। লিথিলার হাতে শাঁখা-পলা পড়ানো হলো। শাঁখা-পলা হাতে পড়াতেই লিথিলার পুরনো বেশভূষা ঘুচে গেলো। পুরোদস্তুর, নতুন বউয়ের মতো লাগছে, শুধু সিঁথিতে সিঁদুরে’র প্রলেপ পড়লে সমস্তটা পরিপূর্ণতা পেতো।
আমি মলয় মুখোপাধ্যায়। লিথিলা আমার প্রতিবেশি এবং আজ থেকে প্রাক্তন প্রেমিকা। লিথিলার সঙ্গে প্রেমটা বেশি দিনের নয়। দেড় বছর ধরে আমরা প্রেম করছি। রূপে মুগ্ধ হওয়ার মতো রূপ লিথিলার কোনো কালেই ছিলো না, গায়ের রঙও চাপা ছিলো ; হাইটও খুব বেশি নয়, শর্ট বললেই চলনসই হবে। তবে ওর চোখ দু’টো আর ভ্রু যুগল ছিলো অসাধারণ ; চোখে কাজল দিলে এতো মায়া ভর করতো আর কপালের সেই কালো টিপ ; ভীষণ সাধারণ গোছের সাজসজ্জায় অভ্যস্থ ছিলো। ঠোঁটে লিপস্টিক পড়তো খুব কম। কিন্তু লাল টকটকে লিপস্টিক ছিলো আমার ভীষণ প্রিয়। অবশ্য এটা জানার পর আমার সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করতে গেলে মাঝেমধ্যে ওকে লাল লিপস্টিক পড়তে দেখতাম, কিন্তু তাতে ওকে বড্ড বেমানান লাগতো। পরে আমিই লিপস্টিক পড়তে নিষেধ করেছিলাম। লিপস্টিকে ওর চেহারার মায়াটা মলিন হয়ে যেতো। লিথিলার চেহারার ঐ অদ্ভুত আবেশেই আমি ওর প্রেমে পড়েছিলাম। লিথিলাও আমাকে ভালোবাসতো সেটা আমি উপলব্ধি করতে পারতাম। ও আমাকে মাঝেমধ্যে অকারণেই জিজ্ঞেস করতো, “আমি ওকে সত্যিই ভালোবাসি তো?”
“ভালোবাসি” শব্দটা বার বার বলতে ভালো লাগতো না, তারপরও মেয়ের মনরক্ষার জন্য বলতাম “ভালোবাসি”। প্রেম করতে গিয়ে মেয়েদের সম্পর্কে একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছে, কিছু মিথ্যে কথার ফুলঝুরি ওদের মন খুব খুশি করে।
মাঝেমধ্যে ও আমাকে বলতো, “তুমি একটু ব্যালকনিতে আসবা? তোমাকে একটু দেখব।”
ওর অনুরোধ রাখতেই আমি ব্যালকনিতে যেতাম। আমার যে খুব যেতে ইচ্ছে করতো তেমন কিছু নয় ,তবুও যেতাম। ছোটবেলা থেকেই সুন্দরী মেয়ের প্রতি আমার আসক্তি ছিলো অত্যাধিক। এর আগে আমার দু’টো গার্লফ্রেন্ড ছিলো। তারা ছিলো আমার মনের মতো, আমি যেমন সুন্দরী মেয়ে পছন্দ করতাম তারা ছিলো ঠিক তেমন। লিথিলা ঠিক তেমন গোছের ছিলো না তবুও ভালোবাসতাম। কারণ ওর ভিতর সেই অদ্ভুত আবেশ, বিষণ্ণ মায়া ছিলো। তবুও আমার কাছে মায়ার থেকে সৌন্দর্যের গুরুত্বটা ছিল বেশি। তবে সত্যি বলতে, আগের দু’জনের মতো ওর প্রতি আবেগ তেমন প্রবল ছিলো না। দিন যায় আবেগ সস্তা হয়ে যায়। কিন্তু লিথিলা’র প্রথম প্রেম ও ভালোবাসা ছিলাম আমি। তাই, আমার প্রতি ওর ছিলো ভরপুর আবেগ। ওর আমার প্রতি ভালোবাসার কখনো কমতি দেখিনি। কিন্তু মাঝেমধ্যে এই অত্যাধিক ভালোবাসাই আমার কাছে ন্যাকামি বলে মনে হতো। ওর এই আমাকে বেশি ভালোবাসতে চাওয়াটাই আমার কাছে নিজেকে দমবন্ধ “আমি”বলে মনে হতো। আমি ওর থেকে পালাতে চাইতাম, লুকোতে চাইতাম, ছুটতে চাইতাম। ওর কাছ থেকে চলে যাওয়ার, হারিয়ে যাওয়ার অজস্র অজুহাত খুঁজতাম। কিন্তু কোনো অজুহাতই পাকাপোক্ত করতে পারতাম না। সবই কেমন নড়বড়ে হয়ে যেতো শেষমেশ।তাই, দু’জন আবার দু’জনের ভালোবাসার বন্ধনে একসঙ্গে থাকতাম ।
আমি একটা প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করি এবং জাতিতে ব্রাক্ষণ হওয়ার সুবাদে এবং বাংলাদেশে ব্রাক্ষণের সংখ্যা কম থাকার কারণে মাঝেমধ্যে পূজো এবং বিয়ের সময় পৈতা ধারণ করে পুরুতের দায়িত্ব পালন করি। যদিও শিক্ষকতা বাদে অন্য কাজগুলো আমার মোটেও পছন্দের নয়। তবুও চাহিদার যোগান দিতে গিয়ে মাঝেমধ্যে পূজো অর্চনা, বিয়ে-শাদির দায়িত্ব পালন করতে হতো। আমি ছোট থেকেই ভালো দেখতে ছেলের তালিকায় যুক্ত ছিলাম। লোকমুখে কতোবার যে শুনেছি, “আমি নাকি বেশ ভালো দেখতে।” সেটা শুনে শুনে এবং নিজের মুখটা আয়নায় দেখে নিজের চেহারা নিয়ে মনের মধ্যে অদ্ভুত আত্ম অহমিকা কাজ করতো।
যেহেতু লিথিলা পঁচিশ বছর বয়সে’র কোঠায় পা দিয়েছিলো। তাই বাড়ি থেকে ওর বিয়ের জন্য জোর কদমে পাত্র দেখা চলছিলো। কিন্তু ওর বাবার নাক কিঞ্চিৎ উঁচু স্বভাবের হওয়ার কারণে অনেক সম্বন্ধ ভেস্তে গেছিল। এজন্যই বিয়েটা এতোদিন আটকে ছিলো। কিন্তু ঐ প্রজাপতি ব্রক্ষার কৃপাদৃষ্টি এবার নাকি লিথিলা’র উপর পড়েছে। তাই ওর বিয়ের ফুল ফুঁটেছে। হ্যাঁ, এই করোনার মধ্যেই ওর বিয়ের সানাই বাজছে। যদিও নির্দিষ্ট দূরত্ব সবাই বজায় রাখার চেষ্টা করছে এবং বারবার হ্যান্ড ওয়াস কিংবা জীবাণুমুক্তকারী জারমিসল হ্যান্ড রাব মাখছে। যেমন ধরা যাক প্রত্যেকে কনে’র গায়ে হলুদ দিতে গিয়ে হাতে হ্যান্ড ওয়াশ মাখলো। দূর থেকে এসব দেখে আমার তামাশা মনে হচ্ছিল। আর ক’দিন বাদেও তো বিয়েটা হলে হতে পারতো। যাক এসব, আমি তো বাঁচলাম। আমাকে তো আর বিয়ে করতে হচ্ছে না। আর প্রেম করেছি বলে বিয়েও করতে হবে নাকি। অদ্ভুত সব নিয়ম কানুন।
লিথিলা কিন্তু বেশ কয়েকবার বিয়ের কথা বলেছিলো। তবে হ্যাঁ ও শুধু বিয়ের কথা বলেছে, তবে কখনও সেটা নিয়ে জোরজবরদস্তি করেনি। ও বরাবরই শান্ত, নিস্তব্ধ। কাউকে কোনো বিষয় নিয়ে জোরাজুরি করা ওর আসলে স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ। লিথিলা বিয়ে বিষয়ক কোনো কথা বললে সেটাকে স্রেফ আমি পাত্তা দিতাম না কিংবা বিভিন্ন বিষয়ের অবতারণা করে আমি এই বিয়ে বিষয়ক আলোচনাকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। সত্যি স্বীকারোক্তি, আমি কখনও মন থেকে চাইনি ও আমার জীবনসঙ্গী হোক। ওকে ভালোবাসতাম না এমনটা নয়, কিন্তু মনের অজান্তে সর্বদা একটা সুশ্রী বউয়ের কল্পনা করতাম। তুলতুলে মিষ্টি সুন্দরী একটা বউ হবে আমার। ওকে বিয়ে করার কথা স্বপ্নেও ভাবিনি। প্রেমটাও তেমন ভাবে কখনও করে উঠতে চাইনি। কিন্তু কোথা থেকে কি করে যে প্রেমটা হয়ে গেলো বুঝে উঠতে পারিনি। ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে প্রথম ভীষণ খুশি হয়েছিলাম, বোধহয় কন্যা দায়গ্রস্ত পিতার থেকেও বেশি খুশি হয়েছিলাম।
তবে, লিথিলার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর একটু আলগা দরদ দেখাতে গিয়ে বলেছিলাম, “তুই তো বুঝিস ব্যাপারটা ; আমার পক্ষে কোনোদিনই তোকে বিয়ে করা সম্ভব ছিলো না। আমার পরিবার তোকে কখনই মানবে না। বরং এটা ভালো হয়েছে। তুই সুখে থাকিস, ভালো থাকিস।”
লিথিলা এসব শুনে সেদিন হো হো করে হেসে বলেছিলো, “আমি কি তোমায় কখনও বিয়ে করার জন্য বায়না করেছি কিংবা জোর খাটিয়েছি? বরং তোমার সবকিছুতে সবসময় হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলিয়েছি। প্রথম দিকে তুমিই আমার পিঁছু পিঁছু ঘুরেছিলে, তুমিই আমায় প্রেম নিবেদন করেছিলে। বরং আমি “না” বলায় তুমি আরো বেশি বেশি করে আমার পিছনে ঘুরেছো। আমি তোমায় বহুবার বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম, এটা হবার নয় ;আর তুমি তখন কতো বড়ো বড়ো উচ্চমার্গীয় কথা আমাকে শুনিয়েছিলে। আসলে কি জানো, ছেলেরা প্রেম নিবেদনের ক্ষেত্রে ঠিক যত ধাপ এগিয়ে থাকে, বিয়ের কথা শুনলে ঠিক ততো ধাপ পেছনে হাঁটে।”
“হ্যাঁ, এটা সত্যি তোমার প্রতি আগে থেকেই আমার একটা ভালো লাগা ছিলো। সেই ভালো লাগা থেকেই আমি প্রেমটাকে অগ্রাহ্য করতে পারিনি। আমিই তোমাকে প্রশয় দিয়েছি। আর প্রেমের মাঝামাঝি সময়ে তুমি ইনিয়েবিনিয়ে কথা বানিয়ে আমায় বুঝিয়ে দিয়েছিলে, তুমি আমায় কখনো বিয়ে করতে পারবে না।nএটা শোনার পরও, “শুধু তোমায় ভালোবাসি বলে রয়ে গেছিলাম। আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারিনি। কেনো জানি সব সময় শুধু মনে হতো, তোমার মনের পরিবর্তন হলেও হতে পারে। আমার সঙ্গে সারাটা জীবন পাড়ি দেওয়ার ইচ্ছে জাগলেও জাগতে পারে। তাই মাঝেমধ্যে কথা প্রসঙ্গে বিয়ে বিষয়ক কথা তুলতাম ; তোমার মনের অবস্থানটা আঁচ করার জন্য। কিন্তু বিয়ে শব্দটা শুনলেই তুমি সেটা ভীষণ সযত্নে এড়িয়ে যেতে মলয় দা।”
”আমি মনে মনে অনেক হেসেছি এটা ভেবে। তবে কি জানো, আমার বিয়ে না হলেও তোমায় জোর করে কখনও বিয়ে করার কথা মনে হয়নি। তবে হ্যাঁ, এটা সত্যি। এতো কিছুর পরও আমি তোমাকে ভালোবাসি, তবে এই বোকামি ভালোবাসার সদুত্তর আমার এখনও অজানা। তবে, আমার এই ভালোবাসা যেন “বোকা ভালোবাসা”ই থাকে, না হলে একদিন হবে তোমার অনুতাপ “
মলয় দা, ভালোবাসলে সুঁই সুতো দিয়ে ঘর বাঁধতে ইচ্ছে হয়। তার সঙ্গে রান্নাবাটি খেলার কথা মনে হয়। এই সুই সুঁতো ধরবার সাহস বা ইচ্ছে তোমার কখনও হয়নি।
তোমার মনে পড়ে নাকি জানি না, তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় তুমি তোমার জীবনের কতো শত স্বপ্নের গল্প আমাকে শোনাতে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে হলেও,সতোমার কোনো স্বপ্নের মধ্যে কখনও আমি ঠাঁই পাইনি। যাকে তুমি কখনও স্বপ্নে রাজ্যেই তোমার সঙ্গে কল্পনা করতে পারোনি। তার সঙ্গে বাস্তবে আদৌ তুমি কখনও পাশে থাকতে চাইতে কি ? ভালোবাসলে তাকে কাছে রেখে আগলে রাখতে হয়, শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখতে হয়। দূরে থেকে, “ভালো থেকো “ এ কথা বলে কাপুরুষেরা।
তুমি মুখে আমায় বলতে “ভালোবাসি” । কিন্তু তোমার পুরো স্বপ্ন জুড়ে আমার কোথাও স্থান ছিলো না। সেখানে শূন্য আমি।”
একনাগাড়ে এতো গুলো কথা শুনিয়ে গেলো লিথিলা, যে মেয়ে এতোদিন আমার বিপক্ষে গিয়ে একটা কথাও বলেনি ! সেই মেয়েকে এই প্রথমবার দম চাপা আগুনের মতো বিস্ফোরিত হতে দেখলাম। বহুদিনের জমিয়ে রাখা অভিমান তো, তাই বোধহয় এমন ভাবে বেরিয়ে এলো।
তবে লিথিলার এসব কথা শুনে তার কোনো প্রতিউত্তর আমার কাছে জানা ছিলো না। ও যেসব কথা বলেছিলো, সেগুলো চরম সত্যি ছিলো। কিন্তু রাগ হয়েছিলো এটা ভেবে লিথিলার মোটা মাথায় এই সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো ঢুকলো কি করে।
যাকগে, যে যাচ্ছে সে যাচ্ছে। আমি তো এমনটাই চেয়েছিলাম। মনে মনে আনন্দ করি। বিয়ে তো হচ্ছে মেয়ে’র। আমার আর থাকলো না কোনো দায়ভার। মুক্ত আমি। এখন ভালো দেখতে একটা মেয়ে’কে বিয়ে করতে পারলে আমার জীবন সোনায় সোহাগা হবে।
আমার আর কি চাই।
মনে মনে ভীষণ আনন্দ নিয়ে নিজেই বললাম, “প্রাক্তনের বিয়ে আর আমার বেজায় সুখ।”
কিন্তু এই সুখটাই অসুখে পরিণত হয়েছে গতকাল।
গতকাল বিকেলে লিথিলার বাবার একটা কথা শুনে মহা মুশকিলে পড়েছি মশায়। ওর বিয়ের জন্য যে ব্রাক্ষণ ঠিক করা হয়েছিলো সে নাকি হঠাৎই ভীষণ ঝামেলায় পড়ে গেছে। ঐ বিয়ের রাতে ঐ ব্রাক্ষণ নাকি এই শহরেই থাকছেন না। তাকে নাকি যেতেই হবে। অগত্যা এই স্বল্প সময়ে পুরুত পাবে কোথায়? এমনিতেও বাংলাদেশে পুরুতের টানাটানি। তখন এরা আমার ধুতিতে টান দিলো।
হ্যাঁ, আমার প্রাক্তনের বিয়ে আমি পড়াবো। ভাবা যায় এসব !
প্রথমটা শোনার পর গড়িমসি করেছিলাম। কিন্তু মেয়ের বাবার হাতে পায়ে ধরা অবস্থা। আর আমি তাদের দীর্ঘদিনের প্রতিবেশীও বটে। তাই দায়িত্ববোধও একটা আছে। তাই আর না করবার জো হয়নি। সব মিলিয়ে লিথিলার বিয়ের ব্রাক্ষণ স্বয়ং আমি। তার প্রাক্তন।
ওর বিয়েটা পড়েছে ঠিক মধ্যরাত্রিরে। রাত দু’টো বেজে ১০ মিনিটে। বরযাত্রীরা রাত সাড়ে বারোটার মধ্যেই পৌঁছে গেলো। লিথিলার মা মাসী একটা থালায় শঙ্খ,প্রদীপ, ধান, দূর্বা, ফুল, ফল, মিষ্টি ও কিছু বরণ সামগ্রী নিয়ে বরকে বরণ করলো। বরকে বাড়ির ভিতর নিয়ে গিয়ে তাকে যথারীতি খাতির যতœ করা হলো, যাকে বলে জামাই আদর আজ থেকেই শুরু হলো। “বউমা আদর” কথাটার প্রচলন নেই আমাদের সমাজে। কিন্তু “জামাই আদর” ব্যাপারটা পুরো সমাজে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে। এ পরিবারে সেই তথাকথিত “জামাই আদর”ব্যাপারটা চাক্ষুষ দেখলাম।
মাঝে একবার মনে হলো, “ইস! আদরটা তো আমিও পেতে পারতাম।”
আমি মলয় মুখোপাধ্যায় বিবাহের মন্ডপে আজ পুরুতের বেশে বসে আছি, আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য বিবাহের রীতি অনুযায়ী এক নাপিতও আছে। ঐ পাশ থেকে লিথিলার কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। ঘর থেকে পিঁড়ি করে বিয়ের মন্ডপে নিয়ে আসা হচ্ছে। তাই মায়ের গলা জড়িয়ে মা মেয়ের কান্নার ধুম লেগেছে। বরকে আগেভাগেই মন্ডপে নিয়ে আসা হয়েছে। এবার, লিথিলাকে পিঁড়ি করে মন্ডপে নিয়ে আসা হলে। কনে’র মুখ অবশ্য পান পাতা দিয়ে আড়াল করে রাখা হয়েছে।এবার, আমার মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে লিথিলা’কে পিঁড়িতে করে বরের চারপাশে সাত পাকে ঘোরানো হল। বিবাহ মন্ডপে সকলের জনসম্মুখে বর ও কনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে শুভ দৃষ্টির আদান প্রদান করলো।
প্রথা অনুসারে, বর-কনেকে এই প্রথমবার দেখে। যদিও আধুনিক কালে সব কিছুর সংস্করণ ঘটেছে। তাই, এটাই প্রথম দেখা নয়। এর আগেও দেখাশুনা হয়েছে, আশীর্বাদ হয়েছে। এটা বিয়ের সাজে বর কনে’র প্রথম মুখোমুখি দর্শন বলা যায়।
বর’তো বেশ মুগ্ধ হয়ে লিথিলাকে দেখছে। কিন্তু কনে মানে আমাদের লিথিলা মুখটা নিচু করে রেখেছে। মুখে হাসির কোনো লেশ নেই। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার ভীষণ দুঃখ হচ্ছিল। কিন্তু বিবাহ মন্ডপে উপস্থিত দু’ পক্ষের আতœীয় স্বজনের নানা রকম কথা কানে যেতে মন খারাপের রেশটা চলে গেলো।
একজন বলছে, বউদি তাকাও। আমার দাদা ওতোটাও দেখতে খারাপ নয়। ইস, দাদা কেমন ড্যাপড্যাপ করে দেখছে তোমায়। আর তুমি মুখটা আড়াল করছো। “
বউদি হওয়ার ঢের সময় বাকি রয়েছে। তাও বউদি বলার কতো বাহার। এসব সিনেমাটিক রঙ্গ কথা শুনে রাগে গা জ্বালা করছে। মনে হচ্ছে, বাংলা সিনেমা থেকে সেই বাসি পঁচা সংলাপ গুলো ধার করে নিয়ে এসেছে।
কেউ আবার বলছে, “লিথিলা তাকা বরের দিকে, এটা শুভদৃষ্টি যে।”
ইস, আমি বরের বেশে থাকলে লিথিলাকে এতোবার বলতে হতো না। সে এমনিতেই একটা মায়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো।
এখন এসব ভেবে কাজ নেই। নিজেই নিজেকে বললাম, “মলয় নিজের কাজে মন দাও, বিয়ে পড়াতে এসেছো। কাজটা ভালো ভাবে শেষ করে বিদেয় হও। এই মেয়ে আজ থেকে তোমার প্রেমিকা নয়। সে অন্য কারো বউ হতে চলছেৃ..।”
শুভ দৃষ্টির লোকাচার শেষ হয়ে কনে ও বরে’র মালা বদল পর্ব শেষ হলো। আজ থেকে দু’জন দু’জনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নিলো। মালা বদলে’র আক্ষরিক অর্থ এটাই বহন করে। আমি পুরোহিতে’র দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এবার বিবাহের মন্ত্র পড়তে আরম্ভ করলাম। বিয়ের যে মন্ত্রটা পড়তে গিয়ে আজকে আমার কথা সব থেকে বিমর্ষ হয়ে যাচ্ছিল :
“যদেতৎ হৃদয়ং তব তদন্ত হৃদয়ং মম।
যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্ত হৃদয়ং তবু্”
দুটো হৃদয়ের সঙ্গে, দুটো পরিবারের মধ্যে মেল বন্ধনের মন্ত্র উচ্চারিত হলো আমার মুখ দিয়ে। আমিও লিথিলাকে পর করে দিলাম, লিথিলা’র বাবাও কন্যাকে আজ থেকে অন্য কারো হাতে সমর্পণ করলো। লিথিলা’র সমস্ত ভরনপোষণের দায়িত্ব পেয়ে গেলো এই অজানা মানুষটি। আজ থেকে লিথিলা তার অর্ধাঙ্গিনী । সমগ্র জীবনের অর্ধেক সঙ্গীর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেল সামাজিক স্বীকৃতির মাধ্যমে।
লিথিলা সামাজিক লোকাচারের মাধ্যমে হলেও আজ থেকে অন্য কারো। সে আমার কেউ রইল না। অধিকার যতোটুকু ছিলো, সবটা হারিয়ে ফেললাম। আমার দোষে, নাকি ভাগ্যের পরিহাসে।
সামাজিক নিয়ম গুলোও কেমন !
চেনা নেই, জানা নেই ,সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা মানুষ শুধু এক বিবাহ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কেমন আপন হয়ে যায়। এক মন্ডপ ভর্তি মানুষ, সিঁথি ভর্তি সিঁদুরের মাধ্যমে কি দু’জন মানুষ সত্যি এক হতে পারে! কতজনকে’ই তো দেখলাম, বিয়ে করে লোকদেখানো সংসারে মেতেছে, আদৌ তাকে কোনো সংসার বলা যায় না। ভালোবাসা নেই, বিশ্বাস নেই, একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা নেই। এই তিন’টে ছাড়া আর যা কিছু হোক যথার্থ অর্থে সংসার হয় না।
আবার অনেকেই বিয়ের মাধ্যমে কেমন এক মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে। চাইলে তো লিথিলা’কে এই মায়ার বন্ধনে আমিও রাখতে পারতাম। আমি তো চাইলেই পারতাম।
কিন্তু কেনো করি নি ?
আমি তো ওকে এক কথায় এতোদিন অবহেলা আর অবজ্ঞা করেছি। ওর যথাযথ সম্মান, ভালোবাসা আদৌ কিছু দিয়েছি। আমি জাতিতে ব্রাক্ষণ হওয়ার দৌলতে লিথিলাকে স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিয়েছিলাম, ওকে বিয়ে করা আমার কখনই সম্ভব নয়। লিথিলা অবশ্য এটা শুনে কোনো বাক্য ব্যয় করেনি কিংবা কোনো কটুক্তি করেনি। কেমন অবলীলায় শুধু ভালোবাসে বলেই ও আমার কাছে রয়ে গেছিল। অথচ আমি ওকে কখনও বোঝার চেষ্টা করিনি। সব সময় অন্যদের সঙ্গে তুলনা করেছি। ওটা করেনি কেনো? ওটা কেনো করলো? এসব বলে আমি কতো কথা না ওকে শুনিয়েছি। একটা মেয়ে’র মানসিক টানাপোড়েন, সামাজিক অবস্থান, পারিবারিক বোঝাপড়া’র জায়গাটাকে কখনও ছুঁয়ে দেখতে চাইনি।
আমি ওকে আদৌ সঠিক মূল্যয়ণ করিনি। কাছে পেয়েও আজ আমি আমার ভালোবাসাকে হারাতে বসেছি এবং চোখের সামনে সেটা হারিয়েও ফেলছি।
আমার একটা বন্ধু এক সময় কথায় কথায় বলতো, মানুষের নাকি তিন’টে হাত। ডান হাত, বাম হাত আর অন্যটা অজুহাত। আমি লিথিলা’কে স্রেফ অজুহাত দেখিয়েছি। যেখানে এন্টিরিলিজিয়ান ম্যারেজ হামেশা হচ্ছে, সেখানে কিনা শুধু অন্য কাস্ট হওয়ার অপরাধে তাকে বিয়ে করার সম্মতি দেইনি। আসলেই, আমিই বোধহয় লিথিলার যোগ্য ছিলাম না। আমিই অমন মেয়ে ডিজার্ভ করি না।
তাই, সব সময় বামুনের ভেক ধারণ করে ওকে ঠকিয়েছি। নাকি আমিই ঠকেছি ?
কাউকে চিট করার সময় মনে মনে আমরা নিজেদের খুব হাই ক্লাসের মনে করি। মাঝেমধ্যে এটা ভাবি, ওর সঙ্গে আমি চিট করেছি, ও আমাকে নয়। বেশ অহং নিয়েই বলি, সম্পর্ক থেকে আমি সরে এসেছি। আমার এই সম্পর্কটা টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। তখন যে চিটিংবাজে’র বিপরীতে অবস্থান করে সে বেচারা কিংবা বেচারী ব্রেকআপের পুরো সময়টা জুড়ে কান্না করে আর হতাশায় ভোগে। সুইসাইডের কথাও মনে মনে ভাবে। আধপাগলারা সেটা করেও বসে। অন্যেরা এক প্রকার দেবদাসের মতো জীবনযাপন করে। জীবনের রং, রূপ, রস একেবারেই চলে গেছে, কিচ্ছুটি নেই বাকি এমন একটা ভাব ধরে বসে থাকে। কিন্তু এই মানুষটার এই বাজে সময়টা উতরে যেতে বড়োজোর এক বছর কিংবা দেড় বছর সময় লাগে।
তারপর, ঐ চিটিংবাজ মানুষটার প্রতিমূর্তি তার কাছে ভয়ংকর ভাবে ধরা দেয়। সে নিজেই মনে মনে ভাবে, ভাগ্যিস আমার সঙ্গে ব্রেকআপ করেছিলো। না হলে অমন একটা ছোটোলোকের সঙ্গে আমার থাকতে হতো। ঐ প্রাক্তনের মতো খারাপ মানুষ তার চোখে তখন আর কেউ নেই – cheater is always a cheater। এতোদিনের ভালোবাসাই তারপর মন্দবাসা’য় পরিণত হয়। আর দিন যায়, বিভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে চিটিংবাজের মনে এক ধরনের অনুশোচনা থেকে এটাও মনে হতে পারে, “সেদিন ঠিক করিনি ওর সঙ্গে কিংবা এটাও মনে হতে পারে যেটা করেছিলাম বেশ করেছিলাম, বেশ আছি! আহা! বেজায় সুখ।”
আজ এই বিবাহ মন্ডপে বসে এই অল্প সময়ে একটা তীব্র অনুভূতি আমার হচ্ছে , “আমি ঠিক করিনি, লিথিলার সঙ্গে। আমি ভুল করেছি। আমাকে এর মাশুল দিতে হলেও হতে পারে।”
বিয়ের সাজে কি স্নিগ্ধ সুন্দর শান্ত লাগছে লিথিলাকে। লাল বেনারসি, কানের দু কানে কানবালা, গলায় ময়ূরপুর সীতাহার, হাতে নক্সাচূড়। লিথিলা’র মামা বাড়ির লোকজন বেশ সম্পদশালী ছিলো। ভাগ্যদোষে, লিথিলা’র মায়ের এ পরিবারে বিয়ে হয়েছিলো। লিথিলা’র মুখেই কয়েকবার শুনেছিলাম ওর বিয়ের জন্য ওর দিদিমা’ই এই গয়না লিথিলার জন্য গড়িয়ে রেখেছে। দিদিমার ভীষণ পছন্দের নাতনী ছিলো লিথিলা। আর এই ভালোবাসা থেকেই লিথিলার এই স্বর্ণপ্রাপ্তি ঘটেছে।
বিয়ের যজ্ঞ অনুষ্ঠানে’র পালা আরম্ভ করেছি। কনে ও বর খই অগ্নাহুতি দেবে অগ্নিকে নিবেদন করে। যজ্ঞের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। তাতে ঘৃত, চন্দন দেওয়া আছে। কনে ও বর আপন মনে খই ছিটোচ্ছে। আমি একটু উঠে দাঁড়ালাম। চারিদিকে ধোয়া আর আগুনের গরম ভাপ বেরোচ্ছে। সবাই ধোয়া মুক্ত হতে একটু দূরে সরে দাঁড়াচ্ছে। শুধু কনে বর পাশাপাশি দু’জন। লিথিলার চোখে জল, এ জল অশ্রুজল না ধোঁয়ার জল ফোঁটা !
এবার, সিঁদুর দানের পালা। বিয়ের একদম শেষ ক্ষণে এসে উপস্থিত হয়েছি। ছোট্ট একটা দর্পণ দিয়ে বর কনে’কে সিঁদুর পরিয়ে দিল। সিঁদুরে’র ছিটেফোঁটা নাকে এসে পরলো। সিঁদুর নাকে পড়তেই আশেপাশের সবাই ফিসফিস করে কানাঘুঁষা আরম্ভ করলো। লিথিলা’তো অনেক বর সোহাগী হবে রে। এসব আমার কানেও এলো। সিঁদুর দান শেষে বর কনে’কে লজ্জা বস্ত্র দিয়ে মুখ ঢেকে দিলো। কিছুসময় বাদে, বরই প্রথম লজ্জা বস্ত্র সরিয়ে কনের মুখ দেখলো।
এখন আমার কাজ শেষ। নআমার এবার বাড়ি ফেরার পালা।
আর যা সংস্কার পরম্পরায় পালন করার রীতি রয়েছে তা দু’ই পরিবারের সহযোগিতায় আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে পালন হবে। বর কনে’কে দেখলাম এক সঙ্গে খেতে বসানো হয়েছে। আমাকে খাওয়ার জন্য জোর করা হচ্ছিল। আমি সটান না করে দিলাম। আমার আর সহ্য হচ্ছে না এসব ন্যাকামি। এরপর খেতে বসলে দেখবো কনে বর রাত জাগছে আর সঙ্গে বন্ধুবান্ধব রাত জেগে হৈহল্লা গল্পগুজব, গানের আসর জমিয়েছে। আমি প্রায় হন্তদন্ত হয়েই বাড়ি ফিরে এলাম। পরদিন সকালে আশীর্বাদ পর্বের সময় আমার একটু ডাক পড়েছিলো। আশীর্বাদের শেষে কনকাঞ্জলি’র পর্ব চললো। লিথিলা মাথার উপর দিয়ে চাল পিছনে ফেলে ওর মায়ের আচলে দিলো। মা বাবা’র ঋণ শোধ করার প্রতীকী আয়োজন বলা চলে এটাকে। আশ্চর্য, এতোদিনের ঋণ এইটুকু চালে কি শোধ হয় ? আর বাবা মা’য়ের ঋণ কি সন্তান শেষ করতে পারে? নিয়মের মধ্যেও কতো বালাই।
ভীষণ কাঁদছে মেয়েটা, বিদায়ের অশ্রু ভীষণ ভারি।
ইদানীং আমার বিয়ে’র জন্য মেয়ে দেখা চলছে। এক বছর ধরে কতো মেয়ে’যে দেখলাম। কিন্তু সেই এই হয় তো ঐ হয়না। কোনো না কোনো কিছুর গড়মিল। এক মেয়ের সঙ্গে তো আশীর্বাদের দিনও ঠিক হয়ে গেছিল। কিন্তু একদিন আগে ফোন করে তার প্রেমের কেচ্ছা শোনালো। তারপর সবকিছু ভন্ডুল হয়ে গেলো।
এখন আমি মেয়ে দেখা নিয়ে হতাশ।
মেয়ে দেখার কথা শুনলেই আতঙ্কিত হই। দু’বছর পার হয়ে গেলো। বয়সও বাড়ছে, সঙ্গে বিয়ের বাজারের চাহিদাও কমছে। আজও মনে হয় সেদিন ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো। লিথিলার সঙ্গে ভুল করেছি।
আজ ২০২২ এর বাইশে অক্টোবর ।
খুব ভোরে ঘুম ভাঙল। ভাবলাম একটু হাঁটাহাঁটি করি।
শরতের সকাল। শিশির ফোঁটা, শিউলি ফুলের ঘ্রাণ নিতে বেরিয়েও পড়লাম। সকালটা এখনও স্পষ্ট নয়। সূর্য একদিকে উঠছে অন্য আকাশে চাঁদের অস্তগামী সবটাই দেখা যাচ্ছে।
হাঁটতে গিয়ে আবছায়া অন্ধকারে হঠাৎ শিউলি ফুল মাড়িয়ে ফেললাম আর তক্ষুনি অকস্মাৎ নজরে এলো, শিউলি তলায় কেউ ফুল কুড়োচ্ছে।
কাছে গিয়ে দেখলাম, “সাদা থানে লিথিলা।”