শান্তা মারিয়া
চীনের খাবার নিয়ে অনেকেরই নানা রকম প্রশ্ন রয়েছে। চীনে প্রথমবার যারা যান তারা নাকি অনেকেই খাবারের কষ্টে পড়েন। এখানে আমি বলতে চাই যে, চীনে গিয়ে সঠিক খাবারটি যদি বেছে নিতে পারেন, তাহলে দেখবেন চীনে সুস্বাদু খাবারের অভাব নেই। চীনের খাবারের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। বিশ্বব্যপী খ্যাতিও আছে। চীনা খাবারে বিশেষ কিছু মশলা ব্যবহার করা হয় যা অত্যন্ত সুস্বাদু। চীনের বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন রকম কুইজিন রয়েছে। এরমধ্যে আমাদের বাংলাদেশের মানুষের টেস্টের সঙ্গে যায় শিংচিয়ান ও সিচুয়ান প্রদেশের খাবার। চীনেরও প্রধান খাদ্য ভাত। ফ্রাইড রাইসও পাওয়া যায় প্রতিটি রেস্টুরেন্টে। ছাও ফেন মানে ফ্রাইড রাইস। এটা অর্ডার করলে অবশ্যই খেতে পারবেন। বিভিন্ন রকম ছাওফেন আছে। যেমন ডিমের, মাংসের ইত্যাদি। ডিমের (চিতান) ছাওফেন বেশ সুস্বাদু।
চীনের সুস্বাদু খাবারের মধ্যে বিখ্যাত হলো রোস্টডাক ও হটপট। রোস্ট ডাকের চীনা নাম ‘খাওয়াইয়া। কয়েক ধরনের রোস্টডাক আছে। তারমধ্যে আমি যে রকমটা প্রথম খেয়েছিলাম সেটা হলো, পাতলা করে কাটা সেদ্ধ হাঁসের মাংসের ফালি। সেটা খুব পাতলা হাতরুটির মধ্যে নিয়ে পেঁচিয়ে নিতে হয়। সঙ্গে বিভিন্ন রকম চাটনি থাকে সেটা দিয়ে খেতে হয়। বেশ ভালো স্বাদ। আরেকটি সুস্বাদু খাবার হলো হটপট বা হুয়োকুয়ো। হটপট পরিবেশনেরও বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। বড় রেস্টুরেন্টে হটপটের টেবিল আলাদা। সেখানে টেবিলের মধ্যে চারকোনা বা গোল দুটি ডিশ বসানো থাকে। টেবিলের নিচে চুলা বসানো রয়েছে। ডিশে ফুটন্ত পানি রয়েছে। সেটা মসলা দেওয়া। পাতলা ফালি করে কাটা মাংস, সবজি, নুডলস ইত্যাদি থাকবে টেবিলে। নিজের খুসি মতো খাবার ওই ফুটন্ত মশলা দেওয়া ডিশে ফেলতে হবে। একটু সিদ্ধ হলে সেটি চপস্টিক দিয়ে তুলে খেতে হবে। সঙ্গে নেওয়া চলবে বিভিন্ন স্বাদের সস।
ছোট ছোট রেস্টুরেন্টে হটপট পরিবেশনের জন্য ছোট ছোট পাত্র রয়েছে। এই পাত্রের নিচেই আগুন জ্বলতে থাকে। পদ্ধতি একই। পাত্রে থাকে মসলা দেওয়া পানি। সেই ফুটন্ত পানিতে খাবারগুলো ফেলে সিদ্ধ করে নিতে হয়। হটপট প্রথম নাকি আবিষ্কার করেছিলেন চেঙ্গিজ খানের বাবুর্চি। মঙ্গোলিয়ার স্তেপে দারুণ ঠাণ্ডা। খান-ই-খানানের তাবুতে খাবার নিয়ে যেতে যেতেই সব ঠাণ্ডা হয়ে যেত। চেঙ্গিস খান বাবুর্চিকে হুমকি দিয়েছিলেন যে, খাবার ঠাণ্ডা হলে মাথা কাটা যাবে। প্রাণের দায়ে আবিষ্কৃত হয় হটপট- গরমাগরম খাবার দেওয়ার এই পদ্ধতি।
চীনে গিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আরেকটি সমস্যা হয় হালাল খাবার নিয়ে। এটাও হয় না জানার কারণে। চীনের প্রতিটি শহরের প্রতিটি রেস্টুরেন্ট পাড়ায় হালাল খাবারের দোকান আছে, রেস্টুরেন্ট আছে।
চীনে দশটি রেস্টুরেন্ট পাশাপাশি থাকলে তার মধ্যে একটি মুসলিম রেস্টুরেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। মুসলিম রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ডে আরবিতে বিসমিল্লাহ অথবা হালাল শব্দটি লেখা থাকে। মুসলিম রেস্টুরেন্টে নিশ্চিন্ত মনে খাওয়া চলে। কারণ এখানে কোনোভাবেই শূয়োর বিক্রি হয় না।এখানে পাওয়া যায় শিক কাবাব। ইয়াংরো ছুয়ান মানে ছাগলের মাংসের কাবাব। দারুণ সুস্বাদু, সঙ্গে মসলা দেওয়া নান রুটি। ছাও ফেন বা ফ্রাইড রাইস পাওয়া যায়। আর পাওয়া যায় ডিপ ফ্রাইড বিন বা বরবটি ভাজা। চিংড়িমাছ ব্রেড ক্র্যাম্প দিয়ে বা এমনি ভেজে দেওয়া হয়। বলাবাহুল্য এটি খুবই সুস্বাদু খাবার। মাছের অনেক রকম ডিশ পাওয়া যায়। ব্রাউন সসে ডোবানো একধরনের ডিশের নাম হোং শাও ইয়ুয়ে। মাছের এই ডিশটি নাকি চেয়ারম্যান মাও সে তুংয়ের খুব প্রিয় ছিল। সবজির কাবাব খুব মজার ডিশ। এগুলো বারবিকিউ পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়। নাম হলো শওখোও। এগুলো মাংসেরও হতে পারে। কোয়েল পাখির ডিম, বিভিন্ন রকম মাশরুম, বেগুন, ক্যাপসিকাম, টমাটো ও বিভিন্ন রকমের সবজি শিকে গেঁথে বারবিকিউ করে শওখোও বানানো হয়। উপরে ছিটিয়ে দেওয়া হয় জিরা ও মরিচের গুঁড়ো। চীনে রাস্তার ধারে দেদারসে বিক্রি হয় মিষ্টি আলু পোড়া এবং ভুট্টা সেদ্ধ। এগুলো দামে বেশ সস্তা। আরও পাওয়া যায় ডিম পরোটা। তোওফু ভাজা বেশ মজার। আলু ভেজে উপরে মসলা ছিটিয়ে দেয়া হয়। সেগুলোও খুব মজার।
নুডুলস পাওয়া যায় বিভিন্ন রকম। চাও মিয়ান হলো ফ্রাইড নুডুলস। খুবই ভালো স্বাদ। ইউননান রাইস নুডুলসও খুব বিখ্যাত। খেতেও সেই রকম মজার।
চীনে আসল মজা হলো ফল খেয়ে। কত রকমের ফল যে পাওয়া যায় এখানে। আম পাওয়া যায় ছোট্ট ছোট্ট। ভীষণ মিষ্টি। লিচু, আঙুর, চেরী, স্ট্রবেরি, আনারস, আপেল তরমুজ, ড্রাগন ফ্রুট, নানা রকম কুল আর বেরি মেলে দেদার। ফলের রস পাওয়া যায় অসংখ্য রকমের।
চীনের সবচেয়ে বিখ্যাত পানীয় হলো চা। এরা বলে ছা। কত কিছু দিয়ে যে চা বানায় এরা। জেসমিন বা বেলী ফুল শুকিয়ে তৈরি হয় বিখ্যাত জেসমিন টি। আরও আছে গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা ইত্যাদি ফুলের চা। চাপাতা দিয়ে যে চা হয় সেটিও আমাদের মতো নয়। শুকনো চা পাতা ফুটন্ত গরম পানিতে ফেলে দিলে দেখা যায় পুরো পাতা মেলে দিয়েছে। সেই পাতা ভেজানো পানি খাওয়া হয় কাপের পর কাপ। কারও বাড়িতে বা অফিসে গেলে পরিবেশন করা হয় চা। কাপ খালি হলেই আবার ভরে দেওয়ার নিয়ম। কারণ খালি কাপ মানে অকল্যাণ। তাই কয়েক কাপ পান করে আর চা খাবার ইচ্ছে না থাকলে কাপ ভরা অবস্থাতেই রেখে দিতে হয়। এখানে বিভিন্ন টি হাউজ আছে। সেগুলোতে চা পরিবেশনের পাশাপাশি নৃত্যগীত প্রদর্শনের ব্যবস্থা আছে। বিখ্যাত বেইজিং অপেরা পরিবেশন করা হয় লাওশে টি হাউজে।
চীনে চিয়াওজা বা ডাম্পলিং বিখ্যাত। এগুলো নানা স্বাদের হয়। খেতে হয় সেদ্ধ রসুন দিয়ে বা কোনো সস দিয়ে। দারুণ স্বাদের খাবার।
চীনের বিভিন্ন শহরে আছে ফুডস্ট্রিট। সেসব জায়গায় বেড়াতে যেতে ভীষণ মজা। প্রতিটি শপিংমলে ফুড কোর্ট আছে।
চীনের খাবার কিন্তু বেশ স্বাস্থ্যকর। আর ভেজাল একেবারেই নেই। ঢাকায় থাকলে আমি সবচেয়ে বেশি মিস করি চীনের খাবার।