ইন্টার-এ্যাকশন্যাল ভ্যান্ডালিজম, ভিখু বা মজনু - Women Words

ইন্টার-এ্যাকশন্যাল ভ্যান্ডালিজম, ভিখু বা মজনু

অদিতি ফাল্গুনী

মূল প্রসঙ্গে যাবার আগে একটি জরুরি বিষয়ে কথা বলে নিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্যাতিতা বোনটিকে কি আসছে ১২ জানুয়ারিই পরীক্ষা দিতে হবে? আমাদের ‘সুমহান কর্তব্যে কঠোর’ বিশ্ববিদ্যালয় কি তাদের একশো বছরের অচল নিয়মগুলো বাস্তবিক কোনদিনই বদলাবে না?

ফেসবুকে অনুজ রাফি শামসের পোস্ট থেকে জেনেছিলাম যে বাবাকে হারিয়ে উদ্ভ্রান্ত ২১/২২-এর রাফি তার ডিপার্টমেন্টে আসন্ন পরীক্ষার ভার মাথায় নিয়ে যে শিক্ষককে গিয়ে বলেছে, ‘স্যার- আমার বাবা মারা গেছে!’ অচল, নিরেট শিক্ষক উত্তর করেছে, ‘তাতে আমি কি করব?’

আমার ত সেকেন্ড ইয়ারে উঠেই আট মাস কেমো নিয়ে পুরো বছরটাই ড্রপ গেছিল। আবার তার দু’বছর পর একটি সার্জারিতে ছ’মাস ঘরবন্দী থেকে মাত্র তেরো দিনের ক্লাস করে যে পরীক্ষা দিয়েছিলাম, তাতে সব মিলিয়ে একশো নম্বরের পরীক্ষাই মিস গেছিল। এটা পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে ভাবাও যাবে না। আমি অনলাইনে (অন্তর্জাল) ডাচ সমাজবিজ্ঞানের এক বছরের কোর্স করছি, সেখানে তৃতীয় সেমিস্টারটির সময় দু’বার পেছানোর আবেদন জানালাম। তারা ব্যক্তিগত সমস্যা শুনে সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল। কাজেই, হে অতি মহান অতি সুপ্রাচীন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়…হে ‘গাভি বিত্তান্ত’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়…হে বেগুনী-হলদে-ডোরা কাটার ঢাবি…এই অদম্য মনোবলের মেয়েটি ১২ তারিখ পরীক্ষা দিতে রাজি থাকলেও আপনারা তারা দৈহিক-মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে ক’দিন পরেও পরীক্ষা নিতে পারেন এবং এই সব অচল নিয়ম-কানুন বদলানোর বিষয়টি না হয় এই মেয়েটিকে দিয়েই শুরু করেন। অবশ্য হালে কিছু তরুণ শিক্ষক এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে খানিকটা মানবিক আবহ তৈরি করছেন। ঢাকা ভার্সিটির এই নির্যাতিতা ছাত্রীর পাশে সারারাত ঢাবির যে দুই নারী শিক্ষক ছিলেন, তাদের এই ফাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে রাখি। গভীর সমবেদনা ও শ্রদ্ধা জানাই ঢাবির শিক্ষক জোবাইয়া নাসরীন বা আমাদের বন্ধু কণাকেও যে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কিছু রাজনৈতিক ক্যাডার ছাত্রীদের হাতে প্রহৃত হয়েছে।

এবার প্রশ্ন মজনু ধর্ষণকারী কি নয়? আমি ত আ  সলে আইনের ছাত্রী। সমাজবিজ্ঞানের যে কোর্স করছি, সেখানেই ‘ইন্টার-এ্যাকশনাল ভ্যান্ডালিজম’ নামে একটি পরিভাষা জানতে পেলাম। ‘ইন্টার-এ্যাকশনাল ভ্যান্ডালিজম’ কি জিনিস? সমাজবিজ্ঞানীরা দেখছেন যে, ধরা যাক নিউইয়র্কের কোন ব্যস্ত রাস্তায় একটি শ্বেতকায়া নারী হাঁটছেন যিনি মধ্যশ্রেণির নারী। তার সাথে গল্প করার ছলে নানা প্রশ্ন বা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ইভ টিজিং শুরু করে দিচ্ছে হয়ত বর্ণগত ভাবে আফ্রিকান বংশোদ্ভুত ও একইসাথে দরিদ্রতর বর্গের কোন কালো পুরুষ। শ্বেতকায়া ও উচ্চতর শ্রেণি অবস্থানের নারীটি তখন ‘প্রতিরোধ’ হিসেবে সেসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে হনহন করে হাঁটতে থাকেন। অথবা ধরা যাক, কোন শ্রেণি কক্ষে এক শিক্ষক পড়াচ্ছেন। দশটি ছাত্র-ছাত্রী মন দিয়ে শুনছে। একজন হয়তো এর ভেতরেই মোবাইল ধরছে। শিক্ষক সেটা নিয়ে কিছু বললে সে উল্টো শিক্ষকের সাথেই ‘অভদ্র’ আচরণ করছে। সোজা বাংলায় অবস্থানগত ভাবে অধীনস্থ যখন ‘অধীনতা’ মানতে চায় না এবং উল্টো সেটা ভাঙ্গার চেষ্টা করে, সেটাই হলো ‘ইন্টার-এ্যাকশানাল ভ্যান্ডালিজম।’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গা হিম করা গল্প ‘প্রাগৈতিহাসিক’ নিশ্চিত মনে আছে সবার? বাগদি বনে ডাকাতি করতে গিয়ে হাতে চোট খাওয়া ভিখুকে মানবিক করুণার জায়গা থেকে ঘরে এনে খাইয়ে দাইয়ে, বিশ্রাম করিয়ে সুস্থ করার চেষ্টা করলো প্রহ্লাদ। তার দারুণ প্রতিদান দিল সে সুস্থ হয়ে উঠেই প্রহ্লাদের অনুপস্থিতিতে তার স্ত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। তবে মেয়েটি শক্ত-সবল ছিল এবং সে প্রতিরোধ শুধু করতে পারে তা’ নয়- স্বামী ও ভাইকেও জানিয়ে দেয়। তারপর ত’ মেয়েটির বর ও ভাই মিলে ভিখুকে আবার পিটিয়ে জঙ্গলে না রাস্তায় ফেলে আসে! গঙ্গার তীরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারীরা অবগাহনে গেলে তাদের শাড়ি বদলানোর সময় ভিখু থাকে। নিশ্চিত তার চোখের চাহনি আর দশটি ‘ভিক্ষুকে’র চেয়ে অন্য রকম ছিল বলে মেয়েরা তাকে ধমকায় বা তার সামনে ভয় পায়। শুনুন, আজ এই বয়সে এসে বলতে কোনই দ্বিধা নেই- ভার্সিটি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় ডিপার্টমেন্টের পিকনিকে যাবার সময় বাসের জানালা থেকে যে ষাটোর্দ্ধ, লাঠি ভর বৃদ্ধকে দয়া করে খুচরো টাকা ভিক্ষা দিলাম, সে পরমূহুর্তেই জানালা থেকে হাত বাড়িয়ে আমার বুকে হাত রেখেছিল। বাস চলতে শুরু করে এবং আমি চেঁচিয়ে উঠতে যাবার সময়েই আমার পাশে বসা সহপাঠিনী গোটা ঘটনা দেখে ফেলে ঠান্ডা মাথায় উপদেশ দেয় একটুও ‘না চেঁচাতে।’ নাহলে ক্লাসের ‘অন্যরাই’ আমাকে খারাপ ভাববে। ঐ বুড়ো ভিক্ষুক যেটা করেছিল সেটাও ‘ইন্টারএ্যাকশনাল ভ্যান্ডালিজম।’ এই ইন্টারএ্যাকশনাল ভ্যান্ডালিজমের ভয়ে আমরা মেয়েরা কাঁচা বাজারে কম যাই, চাঁদনী চক গাউসিয়ার ভিড় ভয় পাই, বাস টার্মিনাল লঞ্চ ঘাট ভয় পাই- কি ভয় পাই না? পাড়ার ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ক্রেতা বেশি হলে এই প্রায়-প্রৌঢ় বয়সেও ভয় পাই, শহরে রাত বাড়তে থাকলে ভয়, সন্ধ্যার পর রিক্সাওলা মূল সড়ক ছেড়ে গলির শর্টকাটে গেলে ভয়…এবং আমরা মেয়েরা সমাজবিজ্ঞানের পরিভাষা পড়ে বা না পড়েও জানি যে অধ:স্থন বর্গের পুরুষও যেকোন মূহুর্তে ‘ইন্টারএ্যাকশনাল ভ্যান্ডালিজম’ ঘটাতে পারে। এদেশের বৃহত্তম দুই সংবাদপত্রের মালিক শিল্পপতির ঘরে পার্টি চলার হৈ চৈ-এর সুযোগ নিয়ে পনেরো বছরের শাজনীনকে ধর্ষণ ও খুন করে তারই বাড়ির ড্রাইভার অথবা কাজের ছেলে। ইন্টারএ্যাকশনাল ভ্যান্ডালিজম। গতকালই ভাবছিলাম যে কমলকুমারের ‘অন্তর্জলি যাত্রা’য় যশোবতীর সাথে ডোম যুবকের সংলাপ এই পরিভাষার আওতায় আসবে কিনা? পরক্ষণেই মনে হলো, কখনো না। যশোবতীকে তার কাঁচা মাংস নিয়েই ঘাটের মরা বুড়োর চিতায় উঠতে হবে। তরতাজা যুবক ডোমের মুখে সমাজের এই ভয়ানক ‘কাঠামোগত সহিংসা’র প্রতি ক্ষোভ বরং যশোবতীকে সেই মানসিক অবস্থায় কিছুটা হলেও স্বান্তনা দিয়েছে। সেখানে এই ‘ইন্টারএ্যাকশনাল ভ্যান্ডালিজম’ হয়ে যায় ‘হিউম্যান ইক্যুইটি’ বা ‘মানবিক ন্যায়পরতা।’ যশোবতী বুঝতে পারে তার প্রতি জীবনের এই চূড়ান্ত নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে কোন না কোন মানুষ অন্তত: ক্ষুব্ধ। কাজেই মজনু আসলে ধর্ষণকারী কি নয় এসব প্রশ্ন অর্থহীন। শুধু যে ক্ষমতাবান বর্গের মানুষের ভেতর সম বা অধ:স্থন শ্রেণির নারীর প্রতি আকাঙ্খা থাকে, তা’ নয়। উল্টোটাও আছে। সময় ও সুযোগের অভাব মাত্র। হ্যাঁ, অভিজাত জুয়েলারির দোকানের মালিকের ছেলেকে ধরতে না পারলেও মজনুকে তাড়াতাড়িই ধরা গেছে। পোশাক কর্মীর তুলনায় ঢাবির ছাত্রী নির্যাতিত হলে আমরা কেন বেশি ক্ষুব্ধ হই? হ্যাঁ, আমাদের শ্রেণি ক্রোধ ত’ আছে। সেই সাথে ঢাবির ছাত্রী নিগ্রহ হলে আমরা বুঝতে পাারি হিমশৈলের চূড়াও আর নিরাপদ নয়। সেই ঢাবি ছাত্রী যদি সিএনজি চালকের হাতে ধর্ষিতা হয়, তখন র‌্যাবের সুখী কর্মকর্তারাও অসুখী হয়ে পড়েন এবং তারাও নড়ে-চড়ে বসেন। বসতে বাধ্য হন। ঢাকা ভার্সিটি ১৯৫২-৬৯-৭১-৯০ করেছে। আইয়ুব থেকে এরশাদ সবাইকে ফেলেছে। এর ছাত্রীর গায়ে টোকা লাগলে র‌্যাব কর্মকর্তারা জানেন যে তাদের নিজেদের বাঁচা কঠিন হবে। আর যে বিপুল নগর দারিদ্র, নদী ভাঙ্গন, অশিক্ষা, অভাব বা মাদকাসক্তি লক্ষ লক্ষ ভিখুর সৃষ্টি করেছে আমাদের মহানগরীতে, সেই সব মজনু বা ভিখুদের সামাজিক সংশোধনের বিষয় নিয়ে আর একদিন লিখব না হয়। আপাতত: এই মজনুকে শাস্তি দিতে হবে। পরের লক্ষ লক্ষ মজনুকে ‘ভিখু’ বা ‘মজনু’ হয়ে ওঠা থেকে কিভাবে রক্ষা করা যায় সেটাই ভাববার।