পিরিয়ড নিয়ে সংকোচ কাটবে কবে? - Women Words

পিরিয়ড নিয়ে সংকোচ কাটবে কবে?

অদিতি দাস

বিশ্ব মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন ডে আজ (২৮ মে)। ঋতুকালীন সময়ে নারীদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক সংস্থা ডব্লিউএএসএইচ-এর উদ্যোগে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে ২০১৪ সাল থেকে দিনটি পালন করা হচ্ছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য রাখা হয়েছে ‘ইটস টাইম ফর অ্যাকশন’।

ঋতুস্রাব একটি স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। প্রতিবার মাসিকের সময় ২০ মিলিলিটার থেকে ৮০ মিলিলিটার পর্যন্ত রক্ষক্ষরণ হয়। তাই এ ঘাটতি পূরণের জন্য মেয়েদের বা নারীদের স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া উচিত বলে জানিয়েছেন ভারতের ফর্টিজ এস্কর্টস হার্ট ইনস্টিটিউটের প্রধান ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিস্ট দলজিত কৌর।এ সময় আয়রন ও প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার, ভিটামিন সি, শক্তি বাড়ানোর জন্য খাবার, আঁশ জাতীয় ও ভিটামিন বি ১২ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার উপদেশ দিলেন তিনি।

স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিরিয়ড নিয়ে সচেতনতা বাড়লেও, এখনো অপরিচ্ছন্নতা আর নিরাপদ পিরিয়ডের অভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছেন দেশের কর্মজীবী নারীরা। এখনো অনেক মেয়ে বা নারীরা পুরোনো কাপড় ব্যবহার করছেন, এতো দাম দিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার সামর্থ তাদের নেই। অনেকেই জানেননা কয় ঘন্টা পর বদলাতে হয় ন্যাপকিন। ফলে বন্ধ্যাত্বতা আর জরায়ু ক্যানসারের মতো জটিল রোগ হচ্ছে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশে এই বিষয়টি নিয়ে আলাপ বা প্রকাশ্যে কথা বলা অনেকটাই ট্যাবু হিসেবে দেখা হয়। পিরিয়ড নিয়ে রয়েছে নানাবিধ কুসংস্কার, যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এখনো স্যানিটারি ন্যাপকিন কিনে কাগজে মুড়িয়েই বাড়ি নিয়ে আসতে হয়, তীব্র ব্যথা বা ব্লিডিং হলেও, দুর্বলতা বা ক্লান্তি লাগলেও তা নিয়ে তেমন আলোচনা করা যায়না। তবে কিছু কিছু সচেতনতামূলক টিভি কমার্শিয়াল দেখা যাচ্ছে ইদানিং,  এর মধ্যে ‘সেনোরা’র কমার্শিয়ালটি বিশেষভাবে নজর কেড়েছে।

স্কুল ছাত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে ভয় কাজ করে তা হলো স্কুলে যাওয়ার পর যদি হঠাৎ মাসিক শুরু হয়।  স্কুলে পড়াকালীন সময়ে আমার মনেও এ ভয় কাজ করতো। শিক্ষার্থীদের এ ভয় দূর করার জন্য দেশের ১১টি জেলার ১১টি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে জরুরি প্যাড কর্নার চালু করেছেন শাকির মাটি ও মারজিয়া প্রভা নামের দুই তরুণ-তরুণী। তাঁরা পর্যায়ক্রমে ৬৪ জেলায় এ কর্নার চালু করতে চান। সম্প্রতি তাদের এ কার্যক্রম নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রথম আলো। প্রশাসনের পক্ষ থেকে যথাযথ অনুমতি নিয়ে কোনো স্কুলে কর্মশালা বা অন্য কোনো কার্যক্রম চালানোর সময় এলাকার লোকজনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে মারজিয়াদের। তারপরেও তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। সারা দেশে এখন পর্যন্ত ৭২ জন স্বেচ্ছাসেবক এ কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছেন।

প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রথমে একটি বিদ্যালয়ে প্যাড কর্নারের জন্য ২০০ স্যানিটারি প্যাড পৌঁছে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের জরুরি ভিত্তিতে প্যাড প্রয়োজন হলে পাঁচ টাকা বা যার সামর্থ্য আছে সে বেশি টাকা দিয়ে একটি প্যাড কিনে ব্যবহার করবে। সমবায় পদ্ধতিতে প্যাড বিক্রির টাকা জমা হবে। প্যাডগুলো বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে থাকে সততা স্টোরে। আর পুরো কার্যক্রম তদারকির জন্য একজন নারী শিক্ষককে দায়িত্ব দেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। জমানো টাকা থেকে আবার প্যাড কিনে রাখা হয়। ব্যবহারের পর প্যাড নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার জন্যও ব্যবস্থা করে দেয় মারজিয়ার দলের সদস্যরা। কর্নার চালু হয়ে গেলে পরে স্কুলের তত্ত্বাবধানে কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এ উদ্যোগ দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হচ্ছেন।

শুধু প্যাড কর্নার চালুর পাশাপাশি বিদ্যালয়ে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করেন তাঁরা। এতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা উপস্থিত থাকেন। শিক্ষার্থীরা মাসিক নিয়ে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা বলে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেন।

প্রতিবেশি দেশ ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে ১১৫ কিলোমিটার দূরের গ্রাম কাথিখেরা। হাপুর জেলার এ গ্রামের মেয়ে ২২ বছরের স্নেহা। কাজ করতেন গ্রামের ছোট্ট একটি কারখানায়। যেখানে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি হয়। ২০১৭ সালে তিনি কাজ শুরু করেন। এখন সেখানে ১৮ থেকে ৩১ বছর বয়সী সাত জন নারী কাজ করছেন। মাসে আড়াই হাজার রূপি বেতন। কারখানাটিতে প্রতিদিন ৬০০ পিছ প্যাড উৎপাদন হয়। ‘ফ্লাই’ নামে তা বাজারজাত হয়।

উপমহাদেশের অন্যান্য অনেক অঞ্চলের মতো কাথিখেরা গ্রামেও মেয়েদের ঋতুস্রাব একটি নিষিদ্ধ বিষয় ছিল। গ্রামের বেশিরভাগ নারীরা মাসিকের সময় সেখানে পুরনো শাড়ি বা বিছানার চাদর কেটে ব্যবহার করতেন। ‘’অ্যাকশন ইন্ডিয়া’ নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলি নিয়ে কাজ করতে শুরু করে এবং কাথিখেরা গ্রামে স্যানিটারি ন্যাপকিন উৎপাদনের জন্যে একটি কারখানা স্থাপন করে। তখন থেকে আসলে সেখানে অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়। এখন গ্রামের অন্তত ৭০ শতাংস নারী স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করছেন।

স্নেহাদের সেই গল্প নিয়ে নির্মিত হয় তথ্যচিত্র ‘পিরিয়ড অ্যান্ড অব সেনটেন্স’। তথ্যচিত্রটি পেয়েছে এবারের অস্কার পুরস্কার। ইরানি-মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা রায়কা জেতাবচি এটি নির্মাণ করেছেন। আর প্রযোজনা করেছেন উত্তর হলিউডের কিছু শিক্ষার্থী। তথ্যচিত্রটি নির্মাণ করতে স্নেহার গ্রামে গিয়েছিলেন নির্মাতা।

অস্কার ঘোষণার আগে স্নেহা বলেছিলেন, ‘আমিই প্রথম কাথিখেরার কেউ-যে কিনা দেশের বাইরে যাচ্ছে।’ তিনি অস্কারের কথা শুনেছিলেন এবং জানতেন যে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় সিনেমার পুরষ্কার। তবে কখনো সে অনুষ্ঠানটি দেখা হয়নি। আর কখনোই ভাবেননি যে অস্কারের লাল কার্পেটে তিনি থাকবেন।

স্নেহার কথা থেকেই সহজে বুঝে নেওয়া যায় অল্প হলেও পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। স্নেহা বলছেন, ‘আমি এখন গ্রামে স্বীকৃত এবং সম্মানিত। সবাই বলছে যে তারা আমাকে নিয়ে গর্বিত।’

মাসিকের সময় চলতি পথে নারীর নানা রকম অস্বস্তিতে পড়তে হয়। সেরকম এক অস্বস্তি থেকে মুক্তি দিতে এসেছেন শোভন মুখোপাধ্যায় নামে এক তরুণ। কলকাতার এ তরুণ বিভিন্ন পাবলিক টয়লেটে স্যানিটারি প্যাড রাখার ব্যবস্থা করেছেন। অন্তত কিছু পাবলিক টয়লেটে যাতে সুস্থ ও স্বস্তিদায়ক পরিবেশ পান নারীরা সেজন্য তিনি পরিশ্রম করে চলেছেন। যদিও শুরুতে তিনি ভাবছিলেন, শৌচাগারে গিয়ে নিজ উদ্যোগে স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখার বিষয়টি তার আত্মীয়-বন্ধুরা কীভাবে দেখবেন। তবে পরিজনরা উৎসাহ দিচ্ছেন। তাঁরাও অনেকে এগিয়ে এসেছেন শোভনের কাজে সহযোগিতা করতে। কলকাতার বিভিন্ন বস্তি এবং কাছাকাছি কিছু গ্রামে এবার থেকে বড় দল তৈরি করে স্যানিটারি ন্যাপকিন পৌঁছে দেবেন তারা। দলের প্রত্যেক সদস্য এর জন্য দিনে দু’টাকা করে ব্যয় করবেন বলে ধার্য হয়েছে। মাসে ৬০০ টাকা উঠে যাবে এক-একটি দল থেকে। সেই টাকায় পরিষ্কার স্যানিটারি প্যাড পেয়ে যাবেন অনেক নারী।

ঋতুমতীদের জন্য পরিচ্ছন্ন পরিবেশের উপর বরাবরই জোর দেন স্ত্রীরোগ চিকিৎসকেরা। রাস্তাঘাটে পরিষ্কার শৌচালয় না পেয়ে আমাদের দেশের মেয়েরা অনেক সময় দিনভর শৌচালয় ব্যবহার করেন না। সেটা শরীরের জন্য ক্ষতিকর।

বিদেশের যে কোনও বড় শহরের ব্যস্ত জায়গায় পরিচ্ছন্ন শৌচালয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। সিংগাপুরে আমি যে ক’বছর ছিলাম, যেখানেই গেছি বিষয়টি লক্ষ্য করেছি। অস্ট্রেলিয়ার সিডনির প্রতিটি বাস-রেলস্টেশনে নারীদের জন্য শৌচালয় তো বটেই, থাকে টয়লেট সিট স্যানিটাইজারও। এমনকি, ছোট্ট দেশ কম্বোডিয়ার বিভিন্ন শহরে পাবলিক টয়লেটের পরিচ্ছন্নতা চোখে পড়ার মতো।
চলতি বছর আরও একটি খবর দৃষ্টি কেড়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্যের বিদ্যালয়গুলোতে মেয়েদের ঋতুস্রাবের বিষয়টি শিক্ষা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে শুধু মেয়েরাই নয় সব শিক্ষার্থীই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিষয়টি নিয়ে পড়ার ও জানার সুযোগ পাবে।
মেয়েদের মাসিকের বিষয়টিকে বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পেইন বা প্রচার কাজ চালিয়ে আসছিলেন এলিস স্মিথ। এই সিদ্ধান্তটিকে ভীষণ ইতিবাচক হিসেবে স্বাগত জানিয়েছেন ২৩ বছর বয়সী এলিস। মাত্র ১৪ বছর বয়সে স্মিথের মাসিক সংক্রান্ত জটিলতা প্রথম ধরা পড়ে। আরও অনেক নারীর মতই তারও পিরিয়ড নিয়ে তৈরি হয় ক্রনিক বা দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। আর খুব সহসা সেটি সেরে যাবারও কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তাই নিজের অসুখ ধরা পড়ার পর থেকেই এই বিষয়ে তিনি সোচ্চার হয়ে উঠেন এবং বিষয়টিকে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তির দাবি তোলেন। তার মতে, পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তির ফলে খুব শিশু বয়স থেকেই মেয়েরা জেনে যাবে কোন ধরণের মাসিক স্বাভাবিক আর কোনটি স্বাভাবিক নয়।
পিরিয়ডের সময় তীব্র ব্যথা হওয়া, ক্লান্ত অনুভব করা, তলপেটে ও মূত্রাশয়ে জটিলতা অনুভব করার ঘটনা অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটে। তবে অনেকের ক্ষেত্রে এটি ক্রনিক ও অত্যন্ত পীড়াদায়ক হয়ে উঠে। ডাক্তারি ভাষায় এই পরিস্থিতিকে বলা হয় ‘এন্ডোমেট্রিয়োসিস’। মেয়েদের ওভারি ও তার আশপাশে অতিরিক্ত টিস্যু জন্মানোর ফলে এই সমস্যার জন্ম হয়।

বাংলাদেশের নারীরা মাসিকের সময় যে দুটো জিনিস মূলত: ব্যবহার করেন তা হচ্ছে পুরনো কাপড় এবং স্যানিটারি ন্যাপকিন।

২০১৪ সালে সরকার এবং আইসিডিডিআরবি’র চালানো ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভেতে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শতকরা ৮৬ ভাগ নারী এখনো মাসিকের সময় পুরনো কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করেন।

স্যানিটারি প্যাড ছাড়া আর যেসব পণ্য বাজারে পাওয়া যায় তার মধ্যে আছে- মেনস্ট্রুয়াল কাপ, টেম্পন, পুনরায় ব্যবহারযোগ্য স্যানিটারি ন্যাপকিন এবং পিরিয়ড প্যান্টি।

১৯৩৭ সালে মেনস্ট্রুয়াল কাপ উদ্ভাবিত হলেও, এর জনপ্রিয়তা গত কয়েক বছরে বেড়েছে। এই মূহুর্তে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সরকারিভাবে এটি উৎসাহিত করা হচ্ছে এবং সে অনুযায়ী জনপ্রিয়ও হচ্ছে।

পিরিয়ড বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সবারই এগিয়ে আসা উচিত। তবেই দূর হবে ঋতুস্রাব সংক্রান্ত স্বাস্থ্য ঝুঁকি। পিরিয়ডের দিনে এবং অন্যান্য দিনে ভালো থাকুক সকল নারীরা, মেয়েরা।

লেখক: সম্পাদক, উইমেন ওয়ার্ডস