‘বীরাঙ্গনার বয়ান': ৭১'র করুণ আখ্যান - Women Words

‘বীরাঙ্গনার বয়ান’: ৭১’র করুণ আখ্যান

একুশের আলোকে নাট্য প্রদর্শনীর দ্বিতীয় দিন গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নবশিখা নাট্যদলের পরিবেশনায় ‘বীরাঙ্গনার বয়ান’ মঞ্চস্থ হয়। নাটকটি যেনো স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বাস্তব দলিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরাঙ্গনাদের নির্যাতনের নির্মম চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি এখানে এসেছে গণজাগরণ মঞ্চের কথা।

আধো অন্ধকার হল জুড়ে পিনপতন নিরবতা। হঠাৎ স্পট লাইট জ্বলে উঠলো। তার নিচে এক অর্ধ বয়সী নারী দাঁড়িয়ে। আলো তার উপর পড়তেই নিরবতা ভেঙে দিয়ে সালাম জানিয়ে তিনি নিজের পরিচয় দিলেন। নাম হালিমা বেগম। সাকিন যশোর জেলা। পরিচয়পর্ব শেষ করেই তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘আজ আপনারা আমাকে কিছু কথা বলার সুযোগ দিয়ে যত ভাবে সম্মানিত করেছেন এজন্য আমি কৃতজ্ঞ। আজ এখানে এসে দেখলাম হাজার হাজার জাগরণী জনতা। আপনারা আমারে মায়ের আসনে বসাইয়া সম্মান দিছেন।এইটা আমি কখনো ভাবি নাই। এখন মনে হইতাছে আমি কথা কওয়নের একটা উপযুক্ত জায়গা পাইছি। তাই ছুইটা আইছি আপনাগো কাছে। এই বীরাঙ্গনা মাতার বয়ান হুনাইতে। তখন সালটা ২০১৩। হেই ফেব্রুয়ারি মাসের ৫ তারিখ থাইকা আপনারা যুদ্ধ শুরু করছেন। আপনারা কেমন আছেন হেই কথা জিগাইবার দুঃসাহস আমার নাই। কারণ আমি জানি যুদ্ধের ময়দানে যোদ্ধারা কেমন থাকে।’

এ ভাবে বীরাঙ্গনা এ নারী গণজাগরণ মঞ্চে দাঁড়িয়ে একে একে বলতে থাকেন স্বাধীনতা যুদ্ধের করুণ কাহিনী। রাজাকারের ফাঁসির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চে দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকা এ নারীর জবানীতে ফুটে ওঠে ভয়াল ৭১।

নাটকের শেষাংশে বীরাঙ্গনা মাতা প্রলাপের মতো বলতে থাকেন, ‘মিলিটারি আর রাজাকারের নির্যাতনে কখন যে কবর খুড়া শুরু করলাম তা মনেই রাখতে পারি নাই। তাঁর পর থাইকা কবর খুড়তেই আছি। এই যে আমার মায়ের কবর, আমার ভাইয়ের কবর, আমার স্বজনের কবর, এই যে আমার মত নির্যাতিত নারীর কবর।’ এক পর্যায় প্রশ্ন করেন, ‘সবার কবরতো খুঁড়লাম, আমার কবর খুড়বো কেডা?’

যতদিন পর্যন্ত দেশের সকল যুদ্ধাপরাধিদের বিচার না হয় ততদিন পর্যন্ত জাগরণী জনতাকে ঘরে না ফেরার প্রতিজ্ঞা করিয়ে সমাপ্তি হয় নাটকের।

দর্শকেদের মুগ্ধ করে দিয়ে শেষ হয় নাটকটি। নাট্যকার রওশন জান্নাত রুশনীর রচনায়, খুরশেদুল আলমের নির্দেশনায় ও রকিবুল হাসান রুমনের সহ নির্দেশনায় এটি ছিলো নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন রকিবুল হাসান রুমন, তন্ময় বনিক, রাহেল আহমদ, প্রান্ত বনিক, ধ্রুবেশ দাশ অর্ন, অর্জুন সূত্রধর, সিথী চক্রবর্তি, প্রিয়াঙ্গকা চক্রবর্তী, আবু সুফিয়ান নাঈম, সন্দিপ চক্রবর্তী, বর্ণা চক্রবর্তী প্রমুখ। নাটকের আলোক পরীকল্পনা করেছেন হুমায়ুন কবির জুয়েল আর আলোক প্রক্ষেপণ করেছেন ইয়াকুব আলী।

নাটক শেষে সম্মিলিত নাট্য পরিষদের পক্ষ থেকে নবশিখা নাট্যদলের সদস্যদের হাতে অংশগ্রহণমূলক স্মারক তুলে দেন সাবেক সংসদ সদস্য ও সিলেট জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জেবুন্নেসা হক। এসময় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সাবেক প্রধান পরিচালক ব্যারিষ্টার আরশ আলী, সম্মিলিত নাট্য পরিষদের সভাপতি মিশফাক আহমদ মিশু, সাধারণ সম্পাদক রজত কান্তি গুপ্ত।

 

এসময় জৈবুন্নেছা হক নাটকের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, দর্শক সারিতে বসে আমার চোখের সামনেই যেন ৭১ সালের সেই ভয়াবহ দিগুলো ভেসে উঠছিলো। কান্নাজড়িত কন্ঠে নবশিখা নাট্যদলের সকল কর্মীদের সাবলিল অভিনয়ের জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, আজ যারা তরুণ, তাদেরকেই এই দেশকে কলঙ্কমুক্ত করার প্রত্যয় নিতে হবে। যুদ্ধাপরাধিদের বিচারের মাধ্যমে দেশকে কলঙ্কমুক্ত করতে সকল তরুণকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জেনে সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে।

নাট্য প্রদর্শনী ৩য় দিন আজ বুধবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় মঞ্চস্থ হবে নাট্য নিকেতনের নাটক ‘ভূমিকন্যা’। নাটকটি রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন চম্পক সরকার। সম্মিলিত নাট্য পরিষদ, সিলেটের আয়োজনে সিলেট নগরীর কবি নজরুল অডিটোরিয়ামে এ নাট্য প্রদর্শনী চলবে ১০ মার্চ পর্যন্ত।