মোহজাল (পর্ব: ষোল) - Women Words

মোহজাল (পর্ব: ষোল)

অনন্যা হক

সাত দিন হাসপাতালে ভর্তি রাখার পর একটু সুস্থ হলে রজব তার আব্বা কে নিজের বাসায় নিয়ে আসে।এখনও কদম আলীর অনেক কাশি,ওষুধ দিছে অনেক।খেতে হবে যতদিন ইনফেকশন না যায়।

রজবের ঘর দুটো,দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে থাকে।

এক ঘরে আব্বা কে রেখে অন্য ঘরে ছেলে মেয়ে নিয়ে উপর নীচ করে থাকে।

অনেক বছর একা নিজের মত থেকে সবার যে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল সেখানে একটা হঠাৎ রদবদলে সবাই কিছু টা অসুবিধার মধ্যে পড়ে। রজবের বউ ফরিদা এক মুখরা,খরদরজাল নারী।নতুন কালের থেকেই তার লাজ লজ্জা কম ছিল।কারো ভাল মন্দ, সুবিধা অসুবিধা তে তার কিছু যায় আসে না।সে তো শুরু থেকেই এমন দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত ছিল না।

তবুও রজব তাকে উপেক্ষা করে বাপ কে নিয়ে যায় বাসায়।পনেরো দিন হতেই ফরিদা বলে, এমন করে কতদিন চলবি,বাড়ির লোক বাড়ি দিয়ে আস।ওষুধ যা খাতি হবি কয়েই তো দিছে,এখন আর কি।কত শখ করে বিয়ে করলেন উনি,সেই বউ দেখেশুনে রাখুক।

ছেলে মেয়ে নিয়ে এমন ঠাসাঠাসি করে এক ঘরে আমার ভাল লাগতিছে না।উনি সারা রাত ধরে কাশে,আমার ঘুম ধরে না।

পরদিন সকালে উঠে সংসারের কাজ করতি হয় বুঝিছো?

-কি সব বলতিছো,একটু ভাল হোক তারপর তো যাবিই বাড়ি।আর একবার ডাক্তার দেখায়ে তারপর নিতি কইছে।এমন কর কেন,আব্বা আসে থাকিছে নাকি কোনদিন?

-আমি এতকিছু বুঝি না, তালি বড় একখান তিন রুমির বাসা নেও।

কত জমি গ্রামে পড়ে আছে,বাপের কাছ থেকে বুঝে নিতে তো পার না।কখন কি হয়,বয়স হইছে।এক না খাওয়া ঘরের মহিলা বিয়ে করছে,যদি সব হাতায় নেয় তো বুঝবা ঠেলা।

-আরে কি কও এসব, আব্বা কি এত কাঁচা মাথার লোক নাকি? আর ঐ মহিলারেও আমি দেখছি,এত সাহস পাবিনে।ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে থাকে।

ছেলে মেয়ে দুটো খাটের উপর ঘুমিয়ে আছে।দুজনে বিছানা করে নীচে শুয়ে আছে।পাশের ঘরে কদম আলী আধাখেচড়া ঘুমের মাঝে কাশছে কিছু পরপর।দুই জন খুব নীচু গলায় কথা বলে যাচ্ছে।রজব তবুও কিছু বুঝে বলে,কিন্তু ফরিদার গলা সহজে নামতে চায় না,মাঝে মাঝেই চড়ে যায়।

ভাবছে শ্বশুর ঘুমিয়ে আছে।

কিন্তু কদম আলীর চোখে ঘুম নেই।শরীর খুব খারাপ লাগে, একটু পর পর কাশির তোড়ে ঘুম হারাম তার।ছেলে, বউ এর দু একটা কথা তার কানে চলে আসে।

কদম আলী এমনিতেই এই আবদ্ধ ঘরে দিন দিন হাফিয়ে উঠছিল।তারপর বেটার বউ এর ভাবভঙ্গি সে টের পায়।ভাল লাগে না।তার আবার আত্মসম্মান বোধ আছে বেশ টনটনে।বাড়ির জন্য মন ছটফট করছে।রাতেই ভাবে,সকাল হলে ছেলে কে বলবে বাড়ি দিয়ে আসতে।

ওষুধ খেতে হবে, এখান থেকে বাড়ি গেলেই সে ভাল হয়ে যাবে।ওষুধ তো খাচ্ছে, এখানে তো সুস্থ লাগে না তার। এর থেকে ছোট বউ তাকে অনেক ভাল যত্নে সেবা করবে।

ফরিদা বলতে থাকে, এবার আব্বা কে বাড়ি রাখতি যায়ে তুমি আব্বা কে কবা সব দলিল পত্র বুঝায়ে দিতে।দরকার কও তো আমি যাই তোমার সাথে।

-কি কও,অসুখ শুনে গেলে না,ছেলে মেয়ের স্কুল, এখন কিভাবে যাবা?

-ওসব তোমার ভাবতি হবিনে।দুই পাঁচ দিন স্কুল কামাই দিলি কিছু হয় না।তোমার তো মুখচোরা স্বভাব, আমারে নিয়ে যাবা।

-আচ্ছা এখন ঘুমাতি দিবা? একেবারে ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ের তাল শুরু করে দিলে যে।

ফরিদা রজবের গায়ের উপর হাত টা রাখে।

রজব হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,উপরে খাটে ছেলে মেয়ে আছে খেয়াল নেই তোমার?

ঘুমাও এখন।

-আর কতদিন এমন করে চলবি?

-কাল নিয়ে যাব হাসপাতালে আবার দেখাতি,দেখি কি কয় ডাক্তার।শোন ফরিদা, আমার আব্বা, মা দুজনেই আমারে খুব ভালবাসতো, খুব যত্ন করে বড় করছে, কিইবা করলাম তাগের জন্যি! শুধু শেষ বেলায় বিয়ে ডা করে আমার মন ডা নষ্ট করে দিল।

কিন্তু মনে মনে ভাবে,ফরিদা যেমন মহিলা, আর তার যে বাসা,আয়,রোজগার, তাতে এ বাসায় কতদিনই বা তারে রাখতে পারবে।এই অসুখ টা নাকি ভাল না,ডাক্তার কইছে।অনেক চিকিৎসা করাতি হবি, টাকাও লাগবি ভাল। ভাল হবি কিনা ঠিক নেই।

আব্বা রে ভাল করে বুঝায়ে জমি তে তো হাত দিতিই হবি।এত টাকার গতি সে করবি কিভাবে?

হঠাৎ ফরিদা বলে ওঠে,বিয়ে করছে ভালই করছে।

তারে এখন দেখবি কিডা? চল যাই বাড়ি, ঐ মহিলা রে এখন ছোট মা না ডাকে তোমার উপায় নেই।

রজবও মনে মনে তাই ভাবে,এমন সময়, আর বিপদ আসবি আগে তো মাথায় আসে নাই।

বাড়ি গিয়ে মোমেনা কে ভাল করে তাকিয়েও দেখেনি মুখের দিকে।এখন তো তারে মা না ডেকে উপায় নেই।তার আব্বার ভাল মন্দ, সেবা যত্ন সব এখন তার হাতে।

বাড়ির অত বড় রাজত্ব ধরে রাখতে গেলেও তো কারো লাগে।হঠাৎ করে দুনিয়ার সব বাস্তবতা মাথায় চাপতে থাকে।

বাপের উপর রাগ,ক্ষোভ দূরে সরে যেতে থাকে।মা এর কথা মনে পড়ে, কেন এমন করে হঠাৎ চলে গেল,তাইলে তো এমন সমস্যা হতো না।

তার চোখে ঘুম নেই, ফরিদা পাশে ঘুমিয়ে গিয়েছে।এবার যে টাকা গুলো খরচ হলো,তাই তো ফরিদা কে ঠিক মত বলেনি।না জেনেই কেমন যেন গজগজ করছে।

সেই বা কি করবে, এসব চিকিৎসার অনেক খরচ। জটিল অসুখ বাঁধিয়ে বসে আছে কদম আলী।

সারা জীবন বিড়ি সিগারেট ছাড়তে পারলো না,এজন্যই মনে হয়।এখন ডাক্তার ছাড়তে বলছে।শোনার পর থেকে ভয়েই বাদ দিয়ে দিয়েছে।

ব্যাংকে অল্প কিছু টাকা ছিল,সব শেষ পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে।এরপরে আরো লাগবে,তার এখন নতুন চিন্তা যোগ হলো।

আবার এও ভাবে,তার আব্বা যেমন লোক,তাতে ছেলের অবস্থার খোঁজ খবর সে রাখে।

রজব ঘুমিয়ে পড়ে।

চলবে…

আগের অংশ পড়তে ক্লিক করুন

মোহজাল (পর্ব: পনেরো)