মোহজাল (পর্ব: তেরো) - Women Words

মোহজাল (পর্ব: তেরো)

অনন্যা হক

মোমেনা আজ আর কদম আলীর বিছানায় যায় না। এ পাশের খাটে শুয়ে পড়ে।নাক ডাকার আওয়াজ টা জোরে হতে থাকে, মোমেনার ঘুম আসে না।তার মনে হয়, এই সংসারে সে মেহমানের মত।কিছু যেন তার না।

হঠাৎ পাশের বাড়ির জমির ভাই এর কথা মনে পড়ে।আসতে যেতে এ বাড়ির উপর দিয়ে যায়।কদম আলীর চাচাতো ভাই।

সেদিন এ পথে যাওয়ার সময় তার রান্না ঘরের বারান্দার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

তখন মোমেনা একাই বাড়ি তে।কেবলই বাজার খুলে বসেছে।

জমির আলী কে বলে,কেমন আছেন ভাই? কিছু বলবেন? ভাবি কই,কয়দিন দেখি না।

-সে তার বাপের বাড়ি গেছে।অনেক দিন পর গিল,থাকবি কিছু দিন।পোলাপানের পরীক্ষা শেষ তাই।

মোমেনা কি বলবে,বসতে বলবে কিনা বোঝে না। এ লোক টা কে নিয়ে তার মনের ভেতরে একটা খটকা লেগেছে আগেই।চলতে ফিরতে কেমন করে যেন তাকায় তার দিকে।মাঝে মাঝে কথা বললেও ঐ চলতে ফিরতে।কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি টা তার ভাল লাগে না।তাই মোমেনা সাবধানে থাকে।

আজই একেবারে কাছে এসে দাঁড়ায়।মনে হয় ঘরে বউ নেই সেই সুযোগে একটু ভাব করতে চায়।জীবন ভরে পুরুষ মানুষের এসব স্বভাব সে অনেক দেখেছে।স্বামী ছাড়া নারী বলে এসব অভিজ্ঞতা তার বেশি।

লোক টা কে সরল সোজা লাগে না।

কিন্তু জমির নিজেই একটা পিঁড়ি টেনে বসে বলে,ভাবি তো একাই থাক বাড়ি তে সারাক্ষণ, সঙ্গ দেয়ার কেউ নেই। ভাইজান যে কি করে এই বয়সে দোকানে এত!

-কি আর করবে,হিসাব ঠিক রাখে।তার আর কে আছে?

-ভাইজানের কথা থাক।হাতের কাজ রেখে একটু চা বানাও তো ভাবি।একদিনও তো তোমার হাতের চা খাইনি।

একা বাড়ি তে একা থেকে হাফিয়ে ওঠা মোমেনার খারাপ লাগে না,মন টা একটু ভিজে ওঠে।মনে হয়, থাক না একটু কথা বলি,কি আর হবি।

আচ্ছা বসেন,বানাচ্ছি চা।

জমির আলী বিভিন্ন গল্প শুরু করে।মোমেনা দেখে লোক টা কথা বলে কেমন হেসে হেসে,চোখ টা যেন তার উপরে ঘুরছে।

মোমেনার স্বভাবের ভেতরে কিছু ঝামেলা আগে থেকেই ছিল।সে এত নিরেট ভাল নারী কখনও না।তার একটু একটু ভাল লাগতে থাকে।কেমন করে যেন কথা বলছে জমির,মোমেনার শুধু হাসি পেতে থাকে।

এতদিন ধরে এই ঝিমানো বাড়ি তে শুধু মন মরা থেকে থেকে কেমন যেন মন টা শুকনো হয়ে ছিল তার।

-ভাবি,এত মন মরা হয়ে থাক কেন?কয় দিনের আর সংসার, এখনই কথা নেই মুখে?

-কি যে কন,একা বাড়ি তে কার সাথে কথা কব?ভুত পেত্নি আছে নাকি চারিপাশে যে তাদের সাথে কথা কব?

-কেন এই যে আমি ঘুরতে ফিরতে যাই চোখের সামনে দিয়ে চোখে পড়ে না আমারে, নাকি ভাইজানের ডরে এমন থাক?

-আমি কারোরে ডরাই না।

-তাই নাকি? তাইলে এখন থেকে এদিকে একটু নজর দিও।আমরাও তো একটু নজরের ভাগে পড়ি।

-কি যে কন,মোমেনা হেসে দেয় ফিক করে।

-বাবা,ভাবিরে হাসতে আজ প্রথম দেখলাম,হাসি ডা তো বেজায় মিষ্টি, তয়, ভাইজানের মনে হয় দেখার সময় নেই।সে আছে তার ছেলে মেয়ে দের নিয়ে চিন্তায়।

লোকটা কথা জানে বোঝে, তার প্রতি মনোযোগ টাও তার ভাল লাগে।মনে মনে ভাবে সম্পর্কে দেওরই তো,এটুকু রঙ্গ তামাশা করা কোন দোষের কিছু না।

চা বানানো শেষ হয়।মোমেনা গিয়ে বিস্কুট এনে, চা বিস্কুট সামনে দেয়।দুইজন মিলে খেতে খেতে জমিরের কথার তালে তালে মোমেনা হাতের কাজের খেয়াল হারিয়ে যায়।

ভাবির মাথা ভরা চুল, এখনও কত বড় একখান খোপা হয়। ভাই আমার বুড়া কালে ভালই একখান বউ খুঁজে বের করলো।

জমির জানে,কোন কথা বললে,এমন নারীর মনে কিছু টা নাড়া দেয়া সহজ।এ তার আজন্ম স্বভাব।

-কি যে কন না, মোমেনা একটু লজ্জা পায়।আপনি এত কিছু দেখেন?

যান তো আপনি,আমার কত কাজ এখন।সে চলে আসে কখন, খাবার দিতে দেরি হয়ে যাবেনে।হইছে আজ,পরে কথা কয়েন।

কতদিন পর একটু হাসলাম।আপনি ভাল হাসাতি পারেন।

আপনার ভাই এর মত মুখ গোমড়া না।

-সে তো এ গ্রামের সবাই জানে, ভাই আর আমি আকাশ পাতাল তফাৎ।

আজ কি রানবা ভাবি?

-এই যে বাজার পাঠাইছে আপনার ভাই, দেখতিছেন না? শোল মাছ দিয়ে লাউ দিয়ে রানবো।দুপুরে চলে আসেন,দুই ভাই এক সাথে খাবেন।

-না, আজ থাক।বাড়ি তে আমিও বাজার দিয়ে আইছি মা রে।

আর এক দিন এর চেয়ে ভাল কিছু রানলে কইও।

জমির ওঠে।যাই আজ ভাবি।কাজ করেন মন দিয়ে,রান্না যেন খারাপ না হয়,বলে,জমির চলে যায়।

মোমেনা খুশি মনে কাজ করতে থাকে।তাকে নিয়ে জমিরের প্রশংসায় তার মন টা অন্য রকম লাগে আজ।

তারও তাইলে ভাল লাগার মত কিছু আছে, এসব মনে এক ভাল লাগার আমেজ তৈরি করে।

জমিরের কথা সত্যি না মিথ্যা এসব যাচাই করার কিছু নেই যেন।

তার ভাল লাগে সে এটাই টের পায়।

মোমেনা একদিকে যেমন হাসিখুশি তেমন রাগি।এই বাড়িতে ঢোকার পর থেকে যেন কেমন এক পাথরের মূর্তির মত হয়ে গিয়েছ।শুধু যন্ত্রের মত কাজ করে যায়।

মনের মত কিছু নাহলে এখানে রাগ দেখানো তেও তার কোন সুযোগ নেই।

মন ছুটে চলে,এক এক দিকে।ভাবে, কালই স্বামী কে বলবে,বাপের বাড়ি যাবে ,কয় দিন থাকবে।ওখান থেকে শহরে আপা কে দেখতে যাবে।কত ভালবাসা দিছে তারে কত বছর ধরে।

কোন কথা শুনবে না, এ কেমন কথা।এই কথা টা তার শুনতেই হবে।নাহলে জোর করে চলে যাবে,যা হয় হবে।

মোমেনার ভেতরে সেই খাপছাড়া, বেপরোয়া ভাব টা আবার যেন ফিরে আসতে চাইছে।

রাত দুপুরে স্বামীর ঘুমন্ত শরীরের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবতে ভাবতে কখন যেন সেও ঘুমিয়ে পড়ে।

চলবে…

আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

মোহজাল (পর্ব: বারো)