বাঁচো বন্ধু, কষ্ট কিসের? - Women Words

বাঁচো বন্ধু, কষ্ট কিসের?

খলিলুর রহমান ফয়সাল

একটা মেয়ে আমার কারণে মরতে চেয়েছিল। আই রিপিট, একটা মেয়ে আমার কারণে মরতে চেয়েছিল। যেদিন আমি এটি জেনেছি সেদিন বুক ফাটিয়ে খোদার কাছে বলেছিলাম, খোদা মেয়েটিকে বাঁচিয়ে দাও, আর পারলে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দাও। খোদা আমার কথা সেদিন শুনেছিলেন। বুক ফাটিয়ে খোদার কাছে যা চেয়েছি, খুব কমবারই তিনি আমাকে নিরাশ করেছেন। আম্মা মারা যাওয়ার পরপর বাসা থেকে আমাকে ফোন দেয়া হলো, তিনি খুব অসুস্থ আমি যাতে তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসি। বুকটা দরাম করে উঠলো, এক ঘন্টা আগে ফোনে আমি যার আওয়াজ শুনলাম সে অসুস্থ হয় কি করে? তখনি বুঝলাম মা আমার নাই, নয়তো যাবে যাবে করছে। খোদার কাছে বুক ফাটিয়ে চাইলাম, মায়ের আর অবাধ্য হবো না খোদা, মা কে ফেরাও। খোদা সে রাতে আমার কথা রাখেন নি। তবে মেয়েটার বেলা রেখেছিলেন।

মেয়েটা আমাকে খুব ভাল বাসতো, সে আমাকে বর হিসেবে চাইতো। তবে আমি কখনো স্ত্রী হিসেবে তাকে চাইতাম না। খুব জিদ ছিল তার। একবার রাগ করে হাত কেটে একাকার অবস্থা। তার বান্ধবীরা আমাকে ফোন করে গালাগাল শুরু করলো, কেমন পাষাণ মানুষ গো আপনি। তখন শুধু ক্যারিয়ারের কথা ভাবতাম। ক্যাম্পাস, সংগঠন, অনুষ্ঠান, সাংবাদিকতা তার উপর টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির টেকনিক্যাল চাপ। বলে রাখা ভাল পরিচয় হওয়ার আগেই বড়লোকের এ ললনাটি মাদকাশক্ত ছিল। এটা আমার সবচে পীড়া দিতো। তাদের বাড়ি গাড়ি অনেক, সে তুলনায় আমি মিসকিন বলা চলে। তাছাড়া আরেকটা মানুষের দায়িত্বও নেয়ার মতো ম্যাচুরিটি হয়তো তখন আসেনি। এতো ধকল আমি নিতে পারছিলাম না। এদিকে জিদ্দি মেয়েটাকেও বোঝানো যাচ্ছে না। একসময় আমি ভয় পেতে শুরু করলাম। আগেই বলেছি তাকে কখনোই প্রেমিকার চোখে দেখতাম না। তবে সে যাতে বুঝতে না পারে অভিনয় করার চেষ্টা করতাম-তুমি যা চাও তাই হবে। অভিনয়ে কাঁচা আমি প্রতিদিন ধরা খেতাম। ভাল থাকার অভিনয় করতে করতে একসময় আমিও মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। এক সন্ধ্যায় মেয়েটি তিনপাতা ঘুমের বড়ি খেল। ওর মা আমাকে ফোন দিল, বাবা যে মেয়েকে আমি জন্ম দিয়েছি সে মেয়ে আমার কথা না ভেবে তোমার জন্য মরতে চাইছে। আমি কি করবো? আমি বললাম, চাচী আমাকে মাফ করবেন। আত্মহত্যায় ব্যর্থ হওয়ার পর সে আস্তে আস্তে যেন বদলে যেতে লাগলো। তখন বলতে গেলে আমি তার হাতের পুতুল ছিলাম। তাঁকে বাঁচাতে যা বলতো তা করতাম। রেজাল্ট একমসয় আরো খারাপ হতে শুরু করলো। পাগলী মেয়েটাকে সুস্থ করতে গিয়ে আমি নিজেই অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম।

ঐ সময় আমার একটা ভাল বন্ধু ছিল। নানান চাপে জর্জরিত এই আমাকে সেবা করতে তার কতই না ধকল গিয়েছে, সেটা ভাবলে এখনো কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে আসে। একবার কথার ছলে আমি ছাদ থেকে লাফ দিতে চাইলাম। সে আমাকে আটকে নিজেই এক পা ছাদের কিনারায় নামিয়ে দিল। মৃত্যুকূপে দাঁড়িয়ে সেরাতে বন্ধুটি বলেছিল, তুই মরলে আমিও মরবো। বাঁচলে দু বন্ধু এক সাথেই বাঁচবো, মরলে একসাথেই। সত্যি বলছি, সেদিন মৃত্যুকে খুব ভয় পেয়েছিলাম। তখন থেকেই অনেক কোটি বছর বাঁচার ইচ্ছে আমার। খুব ইমোশনাল কিছু বয়স পার করেছি। আম্মা মারা যাওয়ার পর সবাই ভেবেছিল আমি পাগল হয়ে যাবো। কিন্তু ব্যাপারটা উল্টো হলো, এমন শক্ত হলাম, দুনিয়ার কোন কষ্টই আমাকে এখন আর ছুঁতে পারে না সেভাবে। আমাকে বাঁচতে হবে। সারা জীবন যে বাবা, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমাকে বড় করছে তাঁর জন্য বাঁচতে হবে। মা মরা ছোট ভাইদের জন্য বাঁচতে হবে। গ্রীষ্ম শেষে বর্ষা যায়। শরৎ হেমন্ত শীত বসন্ত। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আজ সবাই দূরে। যে মেয়েটি আমার জন্য মরতে চেয়েছিল সে এখন খুব ভাল আছে, বন্ধুটিও বেঁচে আছে তবে বন্ধুত্ব আর নাই। আশার কথা কি জানেন আমিও বেঁচে আছি।

এ লেখাটি লেখার কারণ কয়েকটি। প্রথমটি হলো, সে মেয়েটির আজ জন্মদিন। বহুদিন পর তার সাথে কথা হলো। নিজেদের পুরানো পাগলামী নিয়ে খুব হাসাহাসি হলো। একটা ছেলের সাথে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ের আগে চুটিয়ে প্রেম করছে সে। দ্বিতীয় কারণটি হলো, ইদানিং কেন জানি মনে হচ্ছে আমার কোটি বছর বাঁচার সাধটা পূরণ হবে না। মরণব্যাধি বাসা বেঁধেছে শরীরে। টুপ করে যদি মরে যাই তাহলে এ জীবনে আমার আরো কয়েকবার যে জন্ম হয়েছে সে কথা কাউকে বলা যাবে না। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারনটা হলো আমার প্রিয় কিছু মানুষ আমার আগের বেলার মতো দিনকে দিন ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছেন। আত্মহত্যা করতে চাইছেন। কয়েকজন সফল হতে হতে বিফল হয়েছেন। হতাশা, ক্লান্তি, রাগ, দু:খ ভর করেছে তাদের মাথায়। ঘুমাতে চাইছেন এ মানুষগুলো, এমন ঘুম যাতে আর উঠতে না হয়। তাদের জন্যই আমার আজকের লেখা। ঘুম থেকে উঠতে হবে ভাইয়া, তা না হলে সুন্দর সকালটা কে দেখবে? কান্না বন্ধ করতে হবে আপু নইলে মুক্তোঝড়া হাসিটা কে হাসবে?

লেকচার দিতে আমরা সবাই উস্তাদ কিন্তু একটা মানুষ কতটুকু কষ্ট পেলে সুন্দর এ পৃথিবী ছেড়ে নিজের জীবন শেষ করে দিতে চায় তা একমাত্র সে ই জানে। তবু বলছি, নিজের জন্য না মরে এবার না হয় অপরের জন্য বাঁচুন। এ বাঁচায় সার্থকতা আছে, শান্তি আছে। যাকে দোষী বানিয়ে মরতে চাইছেন তাতে তার কিছু আসে যাবে না বরং আপনার ও আপনার পরিবারের-পরিচিতদের লসটাই বেশি হবে। এরচে বরং আরো ভালভাবে বেঁচে দেখিয়ে দিন-এই দেখো তুমি ছাড়া আমি বড্ড ভাল আছি। হ্যা কষ্ট হবে, খুব কষ্ট হবে। যে ঘাসফুল মাড়িয়ে আপনি প্রতিদিন হাঁটেন তার কথা ভাবুন, রাস্তার ঘেউ ঘেউ করা কুকুরটার কথা ভাবুন, গোলাপ বিক্রি করা ছিন্নমূল শিশুটির কথা ভাবুন, মায়ের শরীরের ঘামের ঘ্রাণের কথা ভাবুন, তাও যদি ভাবতে না পারেন নিজের কথা ভাবুন। আপনার কি সুন্দর পা, কি সুন্দর চুল, কি সুন্দর ঠোঁট- এক বার হেসে ফেলুন না। হতাশা, ক্লান্তি, রাগ, দু:খ পালিয়ে যাবে। প্লিজ আর একবারও নিজেকে মেরে ফেলার কথা ভাববেন না। প্রিয় পাঠক, আমি ও আমরাও যে আপনাকে অনেক ভালবাসি। অন্তত আমাদের ভালবাসার জন্য, আমাদের মুখটির দিকে চেয়ে বাঁচুন। কথা দিচ্ছি-সাথে ছিলাম, আছি, থাকবো…