অনন্যা হক
মোমেনা কদম আলীর কথা মতই রান্নার জোগাড় করতে থাকে।নতুন কালের ফাইফরমাশ সব ভাল লাগে।আগে পরের বাসায় পরের ইচ্ছে তে সব করেছে।খাবারের কোন অভাব ছিল না।সবই তার হাতে ছিল, আপা কোন কৃপণতা করেনি কোন দিন।
তাও শুধু তো খাওয়ার ভেতরে সব কিছু থাকে না।কোথায় যেন একটা বড় কষ্ট সব সময় কাঁটার মত ফুটতো।
এই কদিনে সারা দিন ধরে কাজের উপর থাকে তবু মনে সেই আনন্দ, নিজের সংসার।
আমারে এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও,কদম আলী বারান্দা থেকে বলে।মোমেনা উঠে কল চেপে এক জগ ঠান্ডা পানি আর একটা গ্লাস নিয়ে যায়।পানি ঢেলে হাতে দেয়।
কদম আলী বলে,এখানে একটু বস।
-এখন বসলে চলে,কেবলই না বাজার আনলেন?
-আপনি আজ দোকানে গেলেন না?
-না, আজ আর যাব না,গরমে বেশ কাহিল লাগতিছে।টেবিল ফ্যান টা এইখানে একটু লাগায় দিয়ে যাও তো।
মোমেনা ফ্যান টা পাশের টেবিলে সেট করে দিয়ে নেমে চলে যায় রান্না ঘরের দিকে।
কদম আলীর একটা দোকান আছে গ্রামের বাজারে।ছোট একটা ছেলে কর্মচারীর কাজ করে আর নিজে থেকে তদারকি করে।ঘরে নতুন বউ আনার পর একটু কম থাকে দোকানে।
মোমেনা পাশের খড়ির ঘর থেকে পাটকাঠি আর খড়ি এনে চুলার পাশে জড় করে।এবার জায়গা টা পরিস্কার করে বাজার বের করতে থাকে।
কদম আলী দেখে বসে ফ্যানের বাতাস খেতে খেতে।কদিন আগেও মরিয়ম করতো কাজ গুলো, তবে আস্তে ধীরে।বয়সের ভারে নড়াচড়া ধীর গতিতে চলতো।আর সেখানে মোমেনার চলাফেরায় একটা আলাদা জোর দেখে।দেখতে ভালই লাগে।কিন্তু নিজের কথাও ভাবে সেই সাথে,দিন যাচ্ছে আর শরীরের গাঁথুনি ভাঙছে প্রতিনিয়ত।
হাঁটা চলায় একটা নিস্তেজ ভাব,মনের জোরও কমে আসছে যেন।
মোমেনা ওখান থেকে খেয়াল করে স্বামীর ঝিমুনি।
বলে,আপনার কি শরীর খারাপ? গোসলে যান।
-না একটু জিরোয় নি।তুমি কাজ শেষ কর।কল না চাপলে কেমনে করি? বড় গরম।
-কেন পুস্কনি তে যান,আমার রান্না হতে দেরি আছে।
কদম আলী বসেই থাকে।তার মনে অন্য চিন্তাও ঘুরপাক খাচ্ছে।
আর ঘরে বউ এনে এই বুড়া কালে নতুন নতুন সাধ আহ্লাদ যোগ হচ্ছে।সে এখন কদিন আর পুকুরে যেতে চায় না।কল তলায় গোসল করা শুরু করছে।
মোমেনা বালতিতে পানি ভরবে, সে ওখানে বসে তাকে দিয়ে গা ডলে, মুছে গোসল শেষ করবে।
মোমেনা কথা না বাড়িয়ে চুপ করে কাজ করতে থাকে।ভাবে,এই লোক তো কিছুই এখন আমারে ছাড়া করতে চায় না।এটা যে তার জন্য ভাল না খারাপ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
আজ রোদের তেজ টা খুব বেশি।গরমে অসহ্য লাগছে, তার মনে হয়, তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে কখন গিয়ে ফ্যানের পাশে একটু শুতে পারবে।
দুই চুলা ধরিয়ে রান্না শেষ করে তাড়াতাড়ি।ঘরে সব গুছিয়ে রেখে বড় ঘরের বারান্দায় এসে বসে।
তাকে দেখে কদম আলী বলে,যাও একটু তেল এনে মাথার তালু তে দাও।আর লুঙ্গি, গামছা আন ঘর থেকে।
কেবলই আসলাম একটু বসতে দেন।ভেতরে একটা রাগ ওঠে।কিছু বলে না।কেবল কদিন হলো,লোক টা কে এতটা বুঝে উঠতে পারেনি।বসে থাকে কিছুক্ষণ।
-যাও ছোট বউ,আমার খুব খিদে লাগছে।
-এই জন্যিই তো কইছিলাম, পুকুরি যান,এতক্ষণ গোসল হয়ে যাতো।আপনি মেলা অস্থির।
মোমেনার মুখে কথা ফুটতে থাকে আস্তে আস্তে।
এমন সময় ঘরের পাশের গলি দিয়ে দোকানের ছেলে টা ঢোকে।
মোমেনা তাকে দেখেই বলে,রাজু যা তো কল চেপে বালতি ভর,তোর দাদা গোসল করবে।
-ওর কি এত সময় আছে ,ওর খাবার দাও,খেয়ে দোকানে চলে যাক, দোকান বেশি সময় বন্ধ রাখা ঠিক না।
-যাবেনে, কত সময় আর লাগবি,যা বালতি ভর।
রাজু বাধ্য ছেলের মত চলে যায়।রাজু একটু ভয়ে ভয়ে থাকে।এ তো সেই পুরনো দাদী না,সে ওকে খুব ভালবাসতো।এ আবার কেমন হয়, পরে যে আসছে সে কি আগের জনের মত ভাল হবে কিনা তাতো জানে না।
এর কাছেই তো দুপুরের ভাত খেতে আসে।ভাবভঙ্গি দেখে খুব একটা সহজ সরল মনে হয় না তার।
আসলে তো মোমেনা ঘাড় তেড়া, খামখেয়ালী নারী।এরা কেউ এখনও বুঝতে পারেনি।রুপ টা বের হতে একটু সময় লাগবে।কতদিন আর নিজের স্বভাব চেপে রাখতে পারবে।আসছে পর থেকে নতুন পুরনো বলে কিছু বোঝার উপায় নেই। এত বড় সংসার, শুধু কাজ আর কাজ, শেষ নেই কোন।
তার উপর আছে স্বামীর ফাইফরমাশ যখন তখন।
মোমেনা কল তলায় আর যায় না।খাবার খুলে বারান্দায় বসে থাকে।গোসলের জায়গা টা বাইরের দিকে টিন দিয়ে ঘেরা।মগের ঝপঝপ করে গায়ে পানি ঢালার শব্দ পাচ্ছে,লোক টা কি একটু রাগ হলো নাকি ভাবে। আবার ভাবে হোক। সব কিছু তে খুশি করা যায় নাকি?
এই কদিনে বুঝছে তার সব খুশি তো ঐ লোক দেখবে না।জীবন ভরে শুধু কর আর করে যাও,পরের জন্য,সে নিজের সংসার হোক,আর পরের সংসারে হোক।
কদম আলী কল তলা থেকে বের হয়ে আসে।
মোমেনা ওঠে।
মাটির দাওয়ার ঘর।
রান্না ঘরের বড় বারান্দায় এক পাশে একটা চৌকি আছে। ওখানে পাটি পেতে রাখা থাকে।ওখানে বসেই খাবার খায় এরা।
মোমেনা এমনিতেই খুব কাজের।চারিদিকে খুব পরিষ্কার করে ঝকঝকে করে রাখে।দেখতে ভাল লাগে।
মোমেনা ডাকে, আসেন খাবার খুলে বসে আছি।রাজু জগ টা নিয়ে পানি ভরে নিয়ে এদিকে আয়।
ওরা দু’জন এসে বসে।কদম আলী খেতে বসে বলে,তোর নতুন দাদীর হাতের কাজ তোর আগের দাদীর মতই,তাই না রে রাজু?
-হ দাদা।
-ভাল করে পেট ভরে খা।দাও ওরে আরো একটু ভাত দাও।
মোমেনা থালায় ভাত তুলে দেয়।দিয়ে নিজের ছেলেদের কথা ভাবতে থাকে।
চলবে…
আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন